Site icon আলাপী মন

প্রতিবেদন- পর্দা

পর্দা
-সুনির্মল বসু

পর্দা বলতে বুঝি, একটা আড়াল, একটা আবরণ। অনেকের চোখ এড়িয়ে পর্দার মাধ্যমে একটা আড়াল রচনা করবার সচেতন প্রয়াস। আর্থিক অবস্থান অনুযায়ী প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পর্দা ব্যবহারের রীতি প্রচলিত আছে। আমি যেখানে থাকি, সেখানে চর্ম শিল্প কারখানার উচ্চপদস্থদের বাড়ি দামি দামি দৃষ্টিনন্দন পর্দা দেখেছি। শোনা কথা, একজন ছিঁচকে চোর নাকি ওই পর্দার কাপড় চুরি করে জামা বানিয়েছিল। আমি অবশ্য নিজের চোখে সেই জামা কেমন দেখতে হয়েছিল, তা দেখিনি।
পর্দা শব্দটি বৃহৎ অর্থে ব্যবহার করলে, দেখা যায় যে, অনেকেই ট্রামে বাসে ট্রেনে-অফিসে-আদালতে, অন্যের কাছে গোপন করার জন্য এমনি আড়াল রচনা করে থাকেন। এখানে পর্দা দৃশ্যমান না হলেও,
অনুভবে উপলব্ধি করা যায়।
সৎকাজ ও অসৎ কাজের মধ্যে পর্দা থাকে। হাল আমলে প্রেম-ভালোবাসা খুল্লামখুল্লা হয়ে গেছে। আমি প্রাচীন মানুষ, আমাদের সময়ে প্রেম ভালোবাসার মধ্যে খানিকটা পর্দা প্রথা চালু ছিল। চিঠি চালাচালি চলতো গোপনে। মনে হয়, দীর্ঘ বিরহ
ভালোবাসাকে আরো গাঢ় করে তুলতো।
পর্দা অনেক সময় ভয়ের কারণ বটে। ছাত্র অবস্থায় হেড স্যারের ঘরে ডাক পড়লে, ওই পর্দাটা তখন গায়ে জ্বর এনে দিত। অফিসে বড় সাহেবের ঘরে ঢোকার আগে মনে হতো, নিশ্চয়ই আমার কাজে কোথাও ভুল হয়েছে। এক্ষেত্রেও পর্দা ভয়ের প্রতীক।
যৌবনে পছন্দের নারীকে কোনো মোহময় বিকেলে জানালার পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে, দিনটা ভালো হয়ে যেত। নিজেকে মনে হতো, আলেকজান্ডার, কিংবা নেপোলিয়ন।
জীবনে পর্দার মাহাত্ম্য বলে শেষ করা যায় না। শুধু জীবনে কেন, মরণেও পর্দার গুরুত্ব থেকে যায়।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি শুনুন, মৃত্যুর কিছু আগে বিখ্যাত লেখক জর্জ বার্নার্ড ‘শ ঘরের সকলকে অনুরোধ করেছিলেন, জানালার পর্দাটা সরিয়ে দাও, আলো আসুক।
সকালবেলায় পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তরুণ আলো ঘরে ঢোকে, মানুষের জন্মের সময়টাও, পর্দা সরিয়ে প্রথম আলো দেখার মতো বিস্ময় মেশানো চরম আনন্দ। আবার মৃত্যু মানে, চলমান জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়া, যেন পর্দা টেনে দেবার মতো ব্যাপার।
পর্দা শুধু আড়াল রচনা করে না, পর্দা ভালোবাসায় গভীরতা দেয়। পর্দার আড়াল টুকু কখনো কখনো অনেক দামি হয়ে ওঠে। জীবনের গভীর ব্যঞ্জনা তার মধ্যে ফুটে ওঠে।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই পর্দা সুখে দুঃখে আনন্দ বেদনায়, স্মৃতিতে স্মরণে থেকে যায়।
জীবনে পর্দার মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করা যায় না। পর্দা শব্দটি ছোট, কিন্তু তার গভীর ব্যঞ্জনা জীবনের প্রতি পদে পদে তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

Exit mobile version