গল্প

গল্প- অযোধ্য পাহাড়ের উপহার

অযোধ্য পাহাড়ের উপহার
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

-না, না আমি ঐ বউয়ের মুখ দর্শন করতে চাই না। এখুনি এই বাড়ি থেকে ওকে চলে যেতে বল তোরা।
– চুপ কর মা প্লিজ। একটু শান্ত হও। লক্ষ্মীটি মা আমার, এই রকম করো না।
তুমি যেমন পুত্রহারা হলে তেমনি পয়মন্তীও স্বামীহারা হলো। একবার তো ভাবো সে কথা। মাত্র একটা মাস কাছে পেলো নিজের বরকে। নিজের ঘর তৈরি করতে না করতেই খড়কুটোর মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল নিয়তি। আমার তো পয়মন্তীর সামনে গিয়ে দুটো সান্তনা দেওয়ারও সাহস নেই।
ওর মা আর বোনই কাছে আছে। এই কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে চলেছে তৃপ্তি। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, আমাদের এমন কপাল ভাইয়ের দেহটা দাহ করারও সুযোগ পেলাম না।
প্রতিমা দেবী তার একমাত্র ছেলে প্রলয়ের ছবিটা বুকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। আর পাগলের মতো নিজের মনেই বলে চলেছে, সব শেষ করে দিল রাক্ষুসী। কত করে বারণ করেছিলাম, যাস না, যাস না তোরা পাহাড়ে হানিমুন করতে। তারপরই ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন আর বিলাপ করে বলতে লাগলেন, হে ভগবান আমি জ্ঞানত কারোর কখনো কোনো ক্ষতি করি নি। তাহলে আমার কেন এতবড় ক্ষতি হলো!
তারপরই বলে ,জানিস তৃপ্তি আমাদের ঠাকুর ঘরের পূব দিকের জানালাটাতে একটা ঘুঘু পাখি বাসা করে মাঝে মধ্যেই। দু’ একবার বাচ্চাও ফুটিয়েছে। কিন্তু বড্ড নোংরা করে বলে এবার যে বাসাটা করেছিল তা আমি হারানকে দিয়ে ফেলা করিয়ে ছিলাম।
হ্যাঁ রে তৃপ্তি ঘুঘু পাখির বাসা ভেঙে দিলাম বলে কি ভগবান আমার সুখের সংসার তছনছ করে দিল?
তৃপ্তি প্রতিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সবই অদৃষ্ট মা। এর ওপর তো কারোর হাত নেই।
দু’টোতে কত আনন্দ করে হানিমুন করতে গিয়েছিল। তোমার কথা মতো দূরে না গিয়ে পুরুলিয়ার অযোধ্যায় গেল। তোমার কথা মতো কোনো রির্সটে না উঠে মেজ জেঠুর বাড়িতে উঠলো। এরপরও তুমি পয়মন্তীকে রাক্ষুসী বলছো!
এবার কটমট করে প্রতিমা দেবী তৃপ্তির দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে ছিল সন্তানহারা মায়ের গভীর আক্রোশ। খুব দ্রুত চলছে যে তার হৃৎপিণ্ড তা তার বুকের শাড়িটার ওঠা নামা দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে।
প্রতিমা ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, আমি কি বলেছিলাম ওখানে পিকনিক করতে যেতে। দুজনে মিলে বেড়াতে যাচ্ছিস যা, না দলবেঁধে হুল্লোড় করতে কে বলেছিল? তারপর দল ছুট গাভীর মতো হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে আবার বিলাপ শুরু করলো।

হঠাৎ কানে এলো পয়মন্তীর মা ডাক খানি। প্রতিমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলের বৌ। তাকে নতুন বৌ বলা যায় না কি মৃত ভর্তৃকা বলা যায় বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই। মাত্র একটা মাস প্রলয়ের বউ হয়ে সে কাটালো। এখনো শরীরের প্রতিটা অঙ্গে লেগে আছে প্রলয়ের শ্বাস প্রশ্বাস।
পয়মন্তীর নিরাভরণ দেহ, আলুথালু একটা হাত খোঁপা, সাদা থান এইসব দেখে প্রতিমা পাগলের মতো চিৎকার করে বলে, তৃপ্তি ওকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বল।আমি ওর এই চেহারা দেখতে পারছি না। কত সখ করে আমার ঘরের বউ করে এনেছিলাম। মনে হতো ওর মতো মেয়ে আমার ঘর আলো করে রাখবে কিন্তু ওতো আমার ঘর অন্ধকার করে দিল।

তৃপ্তি এবার ধমকের সুরে বলে, পাগলের প্রলাপ বন্ধ করো মা। কেন তুমি পয়মন্তীকে দোষী করেছো। গিয়েছিল তো ওর সবাই মিলে আনন্দ করতে। ভাই যদি ঝর্ণার জলে পাকামো করে হাত ধুতে গিয়ে পা স্লিপ করে পড়ে যায় পয়মন্তী কি করবে?

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পয়মন্তী কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার চোখের সামনে তলিয়ে গেল প্রলয়ের দেহ। আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার স্বামীর মৃত্যু। অগ্নিকে সাক্ষী করে শপথ নিয়েছিলাম সব আপদ বিপদ দুজনে একসাথে লড়বো। কিন্তু কৈ পারলাম আমি?

তৃপ্তি তার মায়ের কাছ থেকে উঠে এসে পয়মন্তীকে ধরে ধরে নিয়ে আসে প্রতিমার কাছে। পয়মন্তী ক্ষীণ কন্ঠে বলে, মা আমি আজই বাপের বাড়ি যেতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?
প্রতিমা হঠাৎ সব শোক ভুলে দৃঢ় কন্ঠে বললো, সেই ভালো। ওখানে থাকলে অন্তত তোর মুখ দর্শন আমাকে করতে হবে না।

পয়মন্তী আবার লেখাপড়াটা শুরু করেছে।যদিও প্রলয়ের চাকরিটা ওরই পাবার কথা। তবুও সে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করতে চায়। প্রলয়ের বড় ইচ্ছে ছিল পয়মন্তী যেন এম.এ.টা কমপ্লিট করে।
দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে বই খাতা নিয়ে পড়তে বসেছে পয়মন্তী। বই-এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা ময়ূরের পালক পেল সে। বিয়ের পর প্রলয়ের ডায়েরিতে পালকটা দেখেই আবদার করে চেয়ে নিজের ইতিহাসের খাতার পাতায় রেখে দিয়েছিল বাপের বাড়িতে এসে।
পালকটার গায়ে আলতো হাত বুলাতেই চোখগুলো তার জলে ঝাপসা হয়ে উঠলো। এমন সময় কাঁধে একটা হাতের ছোঁয়া অনুভব করলো। তাড়াতাড়ি চোখের জল সামলে মুখ ঘুরিয়ে দেখে তার শাশুড়ি মাতা দাঁড়িয়ে। চেয়ার থেকে উঠে তাড়াতাড়ি প্রণাম করে জিজ্ঞেস করে, মা আপনি হঠাৎ এলেন?
কার সঙ্গে এসেছেন?

প্রতিমা মৃদু হেসে বলে, তোর কথা ভীষন মনে হচ্ছিল তাই চলে এলাম। তবে একা আসি নি। নীচে চল। গিয়ে দেখ কার সাথে এলাম।

পয়মন্তীদের নিচের তলায় বসার ঘরে বসে আছে এক সুপুরুষ যুবক। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল চোখগুলো। অসম্ভব স্বচ্ছ চোখের মণিগুলো। পয়মন্তীর মা’ও সেখানে ছিল। উনি ব্যস্ত হয়ে বলে, আয় পয়মন্তী। এর সাথে আলাপ করিয়ে দিই।
এর নামও প্রলয়। প্রলয় রায়। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এখন পুরুলিয়াতে পোস্টিং।
পয়মন্তীর ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না কেন হঠাৎ এই অপরিচিত যুবককে তার শাশুড়ি নিয়ে এলো তাদের বাড়ি।
তবে পয়মন্তীর কৌতুহলের নিরসন ঘটায় তার শাশুড়ি প্রতিমা দেবী। উনি পয়মন্তীর হাতটা ধরে বলে, তোর কাছে একটা জিনিষ চাইবো দিবি ?
পয়মন্তী বিনা সংকোচে বলে, বলুন কি চাই?
-তুই আবার সংসার করবি কথা দে আমাকে।একটা বছর তো কেটে গেছে। এবার একটা বিয়ে কর।

পয়মন্তী যেন আকাশ থেকে পড়ল। সে ভাবতেই পারছে না তার শাশুড়ি স্বয়ং এই কথা বলছে। আর তাছাড়া সে নিজেও বিয়ের জন্য মোটেই তৈরি নয়। এখন সে মাস্টার্স কমপ্লিট করতে চায়। তাছাড়া প্রলয়ের চাকরিতেও তাকে জয়েন করতে হবে। এরমধ্যে আবার বিয়ে থাওয়া!
পয়মন্তী খুব শান্ত ভাবে বলে, আমি এখনও নতুন করে বিয়ের কথা ভাবি নি। এম.এ. টা কমপ্লিট করে প্রলয়ের চাকরিটাতে জয়েন করবো। এইরকম ভাবনাই মাথায় আছে।
প্রতিমা দেবী বলে, সে তো ভালো কথা। তবে আমার অনুরোধটাও একটু ভেবে দেখ।
পয়মন্তীর মা’ও অনুরোধের সুরে বলে, প্রলয় কিন্তু যথেষ্ট ভালো ছেলে। জীবনে চলার পথে একটা ভালো সঙ্গী কিন্তু সবার দরকার।
কানা উঁচু থালায় ভর্তি ভর্তি জল রাখলে যেমন টলটল করে ঠিক সেই রকম টলমল করছে পয়মন্তীর মনটা। কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তখন প্রলয় রায় নিজে এগিয়ে এসে বলে, বিয়ে করতে যদি এখনি সংকোচ হয় তাহলে এখন আমরা বন্ধু তো হতে পারি? যদি কখনও মনে হয় বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বৈবাহিক সম্পর্কের জায়গা নেবে তখন নাহয় ভাবা যাবে।
প্রতিমা দেবীও তাড়াতাড়ি প্রলয় রায়কে সমর্থন করে বলে, এটা একদম ঠিক বলেছো প্রলয়। পুরুলিয়া কেড়ে নিয়েছিল এক প্রলয়কে আবার পুরুলিয়াই ফিরিয়ে দিল আর এক প্রলয়কে। ভাগ্যিস মেজদার বাড়ি গিয়েছিলাম। তাই তো তোমার দেখা পেলাম।
পয়মন্তী ভেবে নে অযোধ্যা পাহাড় তোর জন্য এই উপহারটা পাঠিয়েছে।
প্রতিমা দেবীর দেওয়া উপহারটা পয়মন্তী সেদিন সংকোচ ভরে গ্ৰহণ করলেও জীবনের মাঝ তরীতে এসে বেশ বুঝতে পারছে প্রতিমা দেবীর দেওয়া উপহারের গুরুত্ব।
প্রলয় রায় আজকাল পয়মন্তীর বিরাট একটার ভরসার জায়গা। প্রলয়ের মতো সহৃদয় স্বামীর সহযোগিতায় পয়মন্তী তার পুরানো শ্বশুর বাড়ি, বর্তমান শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ির মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য বজায় রেখে, চাকরি বজায় রেখে দিব্ব্য চলছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেও চলবে।

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page