Site icon আলাপী মন

প্রবন্ধ- সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র, লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র,
লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
-সুনির্মল বসু

 

 

এক বছর মহালয়ার দিনে পিতৃতর্পণ উপলক্ষে একটি অতি জনপ্রিয় দৈনিকে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, এই লেখাটির গভীরতা আমাকে এতটাই আবিষ্ট করেছিল যে, সেইদিন থেকে আমি লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অনুগত ভক্ত হয়ে যাই। ভাবনাকে কত গভীর উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায়, সেই প্রথম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় রচনায় তা প্রথম প্রত্যক্ষ করি।
এরপর একে একে পড়ে ফেলি, বৃষ্টিতে নিশিকান্ত, টাংকী সাফ, বৃষ্টির ঘ্রাণ, ফুটপাতের দোকান, যতীন বাবুর চাকর, বাসস্টপে কেউ নেই, প্রভৃতি রচনা।
প্রথম ধাক্কা খাই, লেখকের স্বকন্ঠে পঠিত, দেখা হবে, গল্পটি শুনে। দেখা হবে, সাধারণ কথা। কিন্তু বলিষ্ঠতম লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন,তা সত্যিই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মনে হয়, এ যেন ঈশ্বরীয় বাণী। কেউ যেন তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নেন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস একে একে পড়েছি, ঘূনপোকা, মানবজমিন, দূরবীন, বাঘু মান্নার বরাত, অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার, কাগজের বউ, পাতালঘর, জন্মান্তর, ঝিকরগাছায় ঝঞ্ঝাট, প্রভৃতি রচনা।
তিনি বহু লিখেছেন। যেমন, মজার কাহিনী, শ্যামলাল ভাবছে। আমি সুমন, দুখিরাম, দীপুর অংক, বীরেন বাবুর প্রত্যাবর্তন, প্রভৃতি। শবর সিরিজের গল্প লিখেছেন, ঈগলের চোখ।
ভূতের গল্প লেখাতেও ভারী দক্ষ তিনি। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক, শুধু কিশোর মনে নয়, বড়দের কাছেও এইসব গল্পের আলাদা টান আছে।
মনে আছে, গণেশের মূর্তি, লক্ষ্মী পেঁচা, আমাকে দেখুন, গোঁসাইবাগানের ভূত, এই সব কাহিনী আমাদের এক আশ্চর্য রহস্যময় জগতে নিয়ে যেত।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার মধ্যে যে গভীরতা লক্ষ্য করেছি, সেটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি তাঁর লেখা পড়বার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাঁর ভাষা স্টাইল স্বতন্ত্র। মনে আছে, বৃষ্টিতে নিশিকান্ত, গল্পের শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, “কেচ্ছা কেলেঙ্কারির মতো বৃষ্টি হয়ে চলেছে কয়েকদিন।”
দেখা হবে, গল্পে একসময় লিখেছেন, “ছেলেবেলায় যেমন পাশ ফিরে মায়ের পিঠের দিকে শুতাম, এখন পৃথিবীর উল্টো পিঠের দিকে যেন পাশ ফিরে শুচ্ছি।”
ছেলেবেলার বর্ণ গন্ধ এখন আর পাই না।
বর্তমান সময়ে যখন চারদিকে ভাঙ্গনের খেলা চলেছে, আমাদের পৃথিবীটা স্বার্থপরতার কারণে, বিবেকহীনতার কারণে, মূল্যবোধ হারাবার কারণে যখন ছোট হয়ে আসছে, তখন যে মূল্যবোধের কথা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন রচনায় পরিবেশন করেছেন, তা পাঠ করলে, মানুষের মধ্যে শুভ চেতনা ফিরে আসবে।
সামান্য বিষয় নিয়ে লেখার শুরু করলেও, বারে বারে এই যশস্বী লেখক মানুষের শুভ চেতনাকে সাহিত্যে পরিস্ফূট করেছেন, নব নব আঙ্গিকে। অনেকেই চলে গিয়েছেন। রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী প্রমুখ।
দীর্ঘায়ু হোন এই লেখক। লেখার মধ্যে এই যে গভীরতা, বাংলা সাহিত্যে ইদানীং তা একান্তই দুর্লভ। কাহিনী বিন্যাসে, চরিত্র চিত্রনে, প্রকাশভঙ্গিতে, সংলাপ ব্যবহারে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অনন্য।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “কাহিনীর প্রথম লাইনটা হাতে পেয়ে গেলে, আপনা-আপনি অসংখ্য চরিত্র এসে তাঁকে দিয়ে যেন লিখিয়ে নিয়ে যায়।” তিনি গল্পে বা উপন্যাসে বরাবর একাধিক চরিত্র
এনে থাকেন। অনেক চরিত্র নিয়ে কাজ করার মধ্যে লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নান্দনিক আনন্দ খুঁজে পান।
আগামীতে তাঁর কাছে অনেক অনেক মহৎ সৃষ্টির উপহার পাবো, আশা করি।
অসম্ভব গুনী এই জীবনী শিল্পীর প্রতি হৃদয়ের বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

Exit mobile version