গল্প

গল্প- বিজ্ঞাপনের বয়ান

বিজ্ঞাপনের বয়ান
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

হঠাৎ পূর্বদিকের আকাশখানি ঢেকে গেল কালো মেঘে। ছাদে জামা কাপড় তুলতে গিয়ে পূবের পানে চেয়ে রইল স্তব্ধ নয়নে অহনা। চৈত্র মাস শেষ হতে দেরি আছে । তবুও আজকাল বিকালের দিকে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল। এই ঝড়বৃষ্টিকে কালবৈশাখী বলছে কিনা আবহাওয়া দপ্তর তা টিভিতে কিংবা ইনটারনেট থেকে জানা হয় নি অহনার। তবে দামাল হাওয়া যেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে বাইরের প্রকৃতিকে ঠিক তেমনি একটা ঝড় উঠেছে অহনার অন্তঃপুরে।

প্রায় দশ বারো বছর ধরে যে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে গড়ে তুলেছিল তার প্রেম কাহিনী তা বোধহয় এবার আছড়ে পড়তে চলেছে কঠিন বাস্তবের মাটিতে। ঝড় বোধহয় উঠলো। তাই তাড়াতাড়ি কাপড় জামাগুলো জড়ো করে ছাদের লোহার কালো গেটটা দরাম করে বন্ধ করে দিয়ে নীচে নেমে এলো অহনা।

ইতিমধ্যে অহনার মা সোমা হন্তদন্ত হয়ে এঘর ওঘর ছোটাছুটি করে জানালাগুলো বন্ধ করছে। অহনাকে দেখা মাত্রই বিরক্তির সুরে বলে, তুই কখন গিয়েছিস ছাদে জামা কাপড় তুলতে বল তো? দেখছিস ঝড় উঠেছে তাড়াতাড়ি নেমে আসবি তো।

অহনা ঠিক কলের পুতুলটির মতো জামাকাপড়গুলো সোফায় রেখে জানালা বন্ধ করতে লাগলো। অন্যমনষ্কতার জন্য জানালর কিনারায় আঙুলটা পড়ে যাওয়ায় উঃ করে চিৎকার করে উঠলে সোমা ছুটে এসে বলে, কি যে করছিস না তুই! আরে বাবা আজকাল তো ব্রেক আপ কতজনের হচ্ছে। কিন্তু তোর মতো বোধহয় এতো উতলা কেউ হয় না। আরে বাবা কি করবি বল? অর্জুন তো নিজেই তোর শর্ত মানতে রাজি হচ্ছে না। সেখানে তোর কি কিছু করার আছে?

‌অহনা যে অর্জুনের ওপর রাগে ফুঁসছে তা তার ফোলা নাকের ডগা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্রিজার থেকে বরফের ট্রে-টা বের করে কয়েকটা বরফের টুকরো বের করে অনামিকাতে টিপে ধরলো। বেশ বদ রক্ত জমেছে মনে হচ্ছে।
‌এই ক’দিন আগে পর্যন্ত অহনা অনামিকার দিকে তাকিয়ে ভাবতো 6.5mm এর হীরের আংটিটার কথা। যেটা অর্জুন ওর জন্য কিনে রেখেছে।

‌কিন্তু সেই কাঙ্খিত হীরের আংটিখানা ও ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা বোধ করে নি অহনা সেদিন। তা হবে দিন চার আগের কথা। অহনাকে নিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে গিয়েছিল অর্জুন। অহনা ভীষণ রকমের এক্সসাইটেড ছিল এই প্রতীক্ষিত ডিনার নিয়ে।

‌এতকাল অহনা অর্জুনের সঙ্গে দেখা করেছে দামোদর ব্যারেজে বা কখনো ট্রয়োকা পার্কে। আর খুব বেশি হলে আইনক্সে গিয়েছে। আর যখন স্কুলে পড়তো তখন তো জল খাওয়া কিংবা বাথরুম যাওয়ার নাম করে টিচারদের চোখ এড়িয়ে সিঁড়ির নীচে বা কখনো পার্কিং এড়িয়াতে দেখা করতো।

‌অহনা আর অর্জুন এক ক্লাসের ছোট বড়। অহনা তখন সেভেন আর অর্জুন ক্লাস এইটে। সাদা জামা আর নীল স্কার্ট, পায়ে কালো নিউপোর্ট জুতো, লাল ফিতে দিয়ে লম্বা দুটো মোটা মোটা বিনুনি। মাঝে মধ্যে ঠোঁটে লিপগ্লস আর একটু পারফিউম। ক্লাস সেভেনেই বেশ ডেভলপ চেহারা ছিল অহনার। তার ওপর সুন্দর মুখশ্রী যা দেখে স্কুলের ছেলেদের প্রেম নিবেদনের লম্বা লাইন থাকতো অহনার পিছনে। তবে কিশোরী অহনা কাউকে পাত্তা দেওয়ার মেয়ে নয়।
‌ক্লাস সেভেনের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার পর একদিন হঠাৎ অর্জুনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে দোতলার সিঁড়িতে ওঠার সময়। অর্জুন নীচে থেকে ওপরে উঠছিল আর অহনা ওপর থেকে নীচে নামছিল তড়িৎ বেগে। অর্জুন প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে, দেখে চলতে পারিস না। এক থাপ্পড় মারতে হয়। অসভ্য মেয়ে কোথাকার।

‌অহনা তার দিঘল কালো চোখগুলোকে বিস্ফোরিত করে বলে, আমি যদি অসভ্য মেয়ে হই তুমিও একটা অসভ্য ছেলে। একেবারে যাচ্ছে তাই।

‌ব্যাস তখন থেকেই শুরু টেরিয়ে টেরিয়ে একে অপরকে দেখা, একে অপরের সাইকেলের চাকার হাওয়া খুলে দেওয়া, যখন তখন মুখ বেঁকানো এইসব আর কি। এইসব দুষ্টুমি করতে করতে দুটো কিশোর কিশোরী যুবক যুবতী হয়ে উঠল। তারা নিজেরাই উপলব্ধি করতে শুরু করে যে তারা একে অপরকে চোখে হারায়।
‌অহনা তখন ক্লাস ইলেভেনে। প্রথম প্রেমপত্র লিখলো অর্জুনকে। ভীষণ টেনশন ছিল। অর্জুন কি উত্তর দেবে এই ভেবে তো তার হৃদস্পন্দনের হার’ও বেড়ে গিয়েছিল বেশ।

‌না অর্জুন নিরাশ করে নি। তবে ঠিক প্রেমপত্র অর্জুন লেখে নি। লিখেছিল একটা চিরকুট ।তাও মাত্র তিনটি শব্দ ‘আমার বউ হবি?’

‌অহনাও সেদিন আর কোনো লিখিত জবাব দেয় নি তারপর। তবে অর্জুনকে সে দিয়েছিল তার সদ্য যৌবনে পা রাখা চঞ্চল হৃদয়। এদিক ওদিক নয় একদম অর্জুনের মনের সাথে স্টেপেল করে দিয়েছিল নিজের মনখানা।
‌সেই মন’ও ছিঁড়ে গেল টুকরো টুকরো হয়ে।

নাওয়া, খাওয়া প্রায় বন্ধ। আজ দুপুরে অহনার অত্যন্ত প্রিয় খাসীর মাংস বানিয়ে ছিল সোমা। মাংসের ঝোল দিয়ে এক গ্ৰাস ভাত মুখে তুলতেই কেমন আলুনী লাগলো অহনার। অহেতুক এক খাবলা নুন মিশিয়ে মাংসের ঝোলের টেস্ট ফেরাতে গিয়ে পুরো মাংসটাই নুনে পোড়া করে দিল। ভাতের থালাতে যে দু’ ফোঁটা চোখের জলও ফেলেছিল তা লক্ষ্য করেছিল তার মা। তবে নীরবতাই শ্রেয় মনে করেছিল সোমা। সেও তো জানে কাছের মানুষের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে কেমন মোচড় দেয় মনটা।

‌তবে এখন অহনার আঙুলটা জানালায় চাপা পড়ে যাওয়ায় সোমা খুব রেগে ওঠে। আসলে মায়ের মন তো। সন্তানের ব্যথায় বড্ড ব্যথিত হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে গ্যাস ওভেনটা জ্বেলে একবাটি জল গরম করতে বসালো। তারপর স্নেহভরে বলে, শুধু বরফের সেঁক দিলে হবে না সোনা আমার। আয় এখানে আয়। একটু উষ্ণ গরম জলে আঙ্গুলটা ডুবিয়ে রাখ প্লিজ।

‌অহনা তার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো রান্নাঘরের দিকে। তারপর আঙুলটা হালকা গরম জলে ডোবাতে ডোবাতে বলে, অর্জুনকে বিয়ে করতে গিয়ে যদি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হয় তাহলে এমন বিয়ের দরকার নেই আমার।

‌সোমার জীবনে বেঁচে থাকার রসদ হচ্ছে তার একমাত্র মেয়ে অহনা। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে যখন বিধবা হয় তখন অনেকে তার অকাল বৈধব্য নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করে বলেছিল, আজকালকার দিনে মেয়েদের চল্লিশটা এমন কি আর বয়স। করে ফেল একটা ডিভোর্সী কিংবা বিপত্নীক কাউকে বিয়ে। তুইও সঙ্গী পাবি আরি মেয়েটাও একটা বাবা পাবে।
‌সোমা অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন যে আর তৃতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে কাজ নেই। মেয়ে মানুষ হলে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে তার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। তবুও আজ অহনার কথা শুনে সোমা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বলে, বিয়ে করলে কি কেউ মাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে যায়? মাঝে মধ্যে তো আসবেই মায়ের কাছে।

‌অহনা ডান হাতটা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ করে বলে, এইখানেই তো আমার আপত্তি। কেন আমি মাঝে মধ্যে বাপের বাড়িতে আসবো? মাঝে মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে যাবো না কেন?

‌সোমা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, এটাই যে সমাজের নিয়ম সোনা। বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে। বছরের পর বছর ধরে তো এই নিয়মটাই চলে আসছে।

‌-যে নিয়মের সঠিক যৌতিকতা নেই সেই নিয়ম বয়ে বেড়ানোর কি কোনো মানে আছে? মেয়েদের বিয়ে হলেই অন্যের ঘরে চলে যেতে হবে এ আবার কি কথা!

– আরে বাবা, তোকে বিয়ে করে যদি অর্জুন আমাদের বাড়িতে থেকে যায় তাহলে লোকে তো ওকে ‘ঘরজামাই’ বলবে। এটা তো একটু বোঝ। ওটা কি অর্জুনের জন্য সম্মানের হবে?

‌অহনা গরম জলের বাটি থেকে হাতটা তুলে বলে, ঘরজামাই শব্দটা কি গালি না নোংরা কথা?
‌-তা এক রকম খারাপ কথা তো বটেই। ঘরজামাই শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে থাকে যে, জামাই নিষ্কর্মা, অলস। মোট কথা সে শ্বশুরবাড়ির আশ্রিত।

‌-অর্জুন যে এর একটাও নয় সেটা তুমি, আমি এবং পাড়া প্রতিবেশী সকলেই ভালো করেই জানে। অর্জুন সরকারি চাকরি করে, ঘর বাড়ি ওর যথেষ্ট আছে। সুতরাং ওকে তো কোনো ভাবেই ঘরজামাই বলা যায় না। বরং আমার মাইনে এখন অর্জুনের থেকে কম।

‌সোমা বলে, দেখ অহনা এই ব্যাপারটাতে অর্জুনের আপত্তি সবথেকে বেশি। ও তো মানতেই রাজি হচ্ছে না বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে।

‌অহনা এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আর বলে, আমার ভালোবাসার থেকে ওর কাছে সমাজটা বড় হয়ে গেল। সমাজের বস্তা পচা অনুশাসন সে মেনে নিতে পারছে বিনা বাক্যব্যয়ে আর আমার প্রস্তাবটা ওর কাছে একবারের জন্য বিবেচ্য বলে মনে হল না।

‌জানো মা হোটেলের মায়াবী নীল আলোয় অর্জুন যখন আমাকে ডায়মন্ডের রিং খানা পরিয়ে দিয়ে বললো, এনগেজমেন্ট কিন্তু হয়ে গেল। এবার শুধু লোক খাওয়ানোটা বাকি। সামনের আষাঢ়ে ভাবছি তোকে পার্মানেন্ট ভাবে আমাদের ঘরের মেম্বার করে নিয়ে যাবো।

‌তখন আমি বেশ আনন্দ করে বললাম, এই মেম্বারশিপটা একটু চেঞ্জ করে নিলে হয় না?
‌অর্জুন ভ্রু কুঁচকে বলে, মানে?

‌-এই ধরো এতো বছরের বিয়ের নিয়মের আমরা কিছু পরিবর্তন ঘটালাম। মেয়েরা বিয়ের পর বাক্স গুছিয়ে ছেলেদের বাড়িতে থাকতে রাজি হয়ে যায় পাকাপাকি ভাবে।রাজি হয়ে যায় এটা বললে ভুল হবে। অনেক মেয়ে তো বাধ্য হয়েই শ্বশুরবাড়িতে থাকে।তাই বলছিলাম আমাদের বিয়ের পর কিন্তু তুমি আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে পাকাপাকি ভাবে। অবশ্যই নিজের বাড়ি যাবে মাঝে মধ্যে।

‌আসলে মা তো একা মানুষ। আমি যদি পাকাপাকি ভাবে তোমাদের বাড়িতে থাকি তাহলে মায়ের খুব অসুবিধা হবে। আর আমি ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই এটা তুমি ভালো করেই জানো।

‌তারপরই ঠোঁট ফুলিয়ে অহনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, জানো মা আমার কথাগুলো শোনা মাত্রই অর্জুন কি বললো, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে অহনা। বিয়ের পর কোনো ছেলে যদি পাকাপাকি ভাবে শ্বশুরবাড়িতে থাকে তাকে লোকে কি বলে জানো তো? ঘরজামাই। দেখো অহনা তোমাকে আমি ভালোবাসি ভীষণ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমি ঘরজামাই হয়ে থাকবো। তোমার এইসব উদ্ভট প্রস্তাবে আমি মোটেই রাজি নয়। এখনো সময় আছে তুমি ভেবে দেখো আমাদের সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত যেতে পারে কিনা?’

‌মা অর্জুনের চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমার একটা কথাও বলতে ইচ্ছা করে নি। শুধু হীরের আংটিটা আঙুল থেকে খুলে অর্জুনের মুখে মেরে এসে ছিলাম। আর সেই মুহুর্তে আমার মনে হয়েছিল আংটিটা অর্জুনের মুখে মারলাম না। মারলাম আমাদের ঘুনধরা সমাজের মুখে। যারা পরিবর্তন চায় না বিভিন্ন অযৌক্তিক নিয়মের। তবে এই কদিনে আমি ভেবে দেখলাম যে ছেলে তার হবু স্ত্রী’র অসুবিধার তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র নিজের ঠুনকো মান সম্মানের কথা ভাবে সেই ছেলে যতই সৎপাত্র হোক না কেন তার যে একটা উদার মন নেই তা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি।

‌তারপর চোখের জল সামলে অহনা বলে, ‘মা একটা খাতা পেন আনো তো। একটা বিজ্ঞাপন লিখতে হবে।’
‌সোমা অবাক হয়ে বলে, ‘বিজ্ঞাপন! কিসের বিজ্ঞাপন?’

‌অহনা একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, আমার বিয়ের। বয়ান টা এইরকম হবে, ‘পূঃবঃ কায়স্থ মিত্রর ৩০/৫’৭”M.A সুচাকুরে স্থায়ী ভাবে শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করতে ইচ্ছুক পাত্র চাই।’ পাশে ফোন নাম্বার ও ঠিকানা থাকবে। ঠিক আছে না মা?

‌অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে সোমা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আর মনে মনে বলে, অর্জুনের সঙ্গে এত দিনের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটলেও মেয়েটা বাঁচতে ভুলে যায় নি এখনও। হে ঈশ্বর অহনার মনের মতো একখানা পাত্র কি আমাদের সমাজ থেকে পাওয়া যাবে? যার কাছে সমাজের থেকে মানুষ হবে প্রধান। যার কাছে লোকের কথার থেকে বেশি প্রাধান্য পাবে স্ত্রী’র আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসা।


Loading

One Comment

Leave A Comment

<p>You cannot copy content of this page</p>