Site icon আলাপী মন

গল্প- রোমহর্ষক

‌ রোমহর্ষক
-সুমিতা দাশগুপ্ত

 

 

রোববারের সকাল। বাড়ির সকলের ব্রেকফাস্ট পর্ব সারা।
সুরমা দেবীও স্নান পুজো সেরে সবে দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে খবরের কাগজখানা খুলেছেন ,বিল্টুনের উত্তেজিত গলা কানে এলো , “ঠাম্মা ও ঠাম্মা।” চেঁচাতে চেঁচাতে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে সদা চঞ্চল বিল্টুন, একটুতেই মহা উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে।
“কী হলো আবার?”– চোখ তুলে চাইলেন সুরমা দেবী।
“শোনো না,ঐ যে মামা দাদু , তোমার বড়দা গো , ফোন করেছিলেন”।
” কী হয়েছে তাঁর?”
“কিচ্ছু হয় নি , ফোন করে বললেন, ঐ যে ‘কলকাতা’ না কী যেন একটা ক্লাবের মেম্বার তিনি , তাঁরা নাকি এই শীতে ভিনটেজ কার রেস করবেন, ভিনটেজ কার রেস মানে জানো তো ,ঐ যে পুরনো দিনের সব গাড়ির মিছিল বের হয় , রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে মানুষ জন হাত নাড়ে,সেই রকম। এবারে সেই রেসে তোমাদের ঐ যে ছোটবেলার পেল্লায় গাড়িখানা ,যেটা মামা দাদু যত্ন করে পুষে রেখেছেন, সেটাকে ক্লাবের লোকেরা মিছিলে সামিল করতে চান। অমন পুরোনো মডেলের গাড়ি নাকি এই তল্লাটে আর নেই!”
“ও ,তা বেশ তো, তবে পথে নামালেই তো আর হলো না , সেটাকে তো রাস্তায় খানিকক্ষণ চালাতেও হবে। অত পুরোনো গাড়ি কী আর এখন চলবে?”
“আরে সবটুকু শোনোই না। ও সব ওঁরা দেখে নিয়েছেন। তাই তো লিষ্টিতে নাম লিখে নিয়েছে। আসল কথাটা হলো যেদিন ঐ শোভাযাত্রা বের হবে , সেইদিন বাড়ির কেউ কেউ পুরনো দিনের মতো সেজেগুজে ঐ গাড়িতে চড়ে যাবে ,আর দর্শকদের দিকে চেয়ে হাসিমুখে হাত নাড়বে। গাড়ির মাথার ছাদটাও তখন আগেকার মতোই গুটিয়ে রাখা হবে যাতে সবাই দেখতে পায়!কী দারুণ ব্যাপার , তাই না ! জানো তো ঐ গাড়িতে আমিও যাচ্ছি , তার জন্য দাদু নতুন ধুতি চাদর কিনে আনবে বলেছে।”
“ও আচ্ছা, তাই বলো, এটাই তাহলে আসল কথা!” মৃদু হেসে বিল্টুনের চুলটা একটু ঘেঁটে দিলেন সুরমা দেবী।
“আচ্ছা ঠাম্মা ,ঐ গাড়িটা নিয়ে সেই গল্পটা আরেকবার বলো না।”
“আহা সে গপ্পো
তো কতবার শুনেছিস্ “
” তা হোক, সে কবে শুনেছিলাম , ভুলে গেছি আর একবার বলো না, প্লিজ।”
মৃদু হেসে কাগজটা পাশের টেবিলে ভাঁজ করে রাখলেন সুরমা দেবী। বিল্টুন মোড়াটা টেনে এনে ঠাম্মার কাছে ঘনিয়ে এলো।
সেই কতকাল আগের কথা ,আজও যেন টাটকা তাজা । সুরমা দেবী একেবারে ডুবে গেলেন মনের মধ্যে,
ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—
” আমাদের ছেলেবেলাটা কেটেছে মধ্যপ্রদেশের একটা ছোট শহরে , আমার বাবার কর্মস্থলে। চাকরির সূত্রে বাবাকে প্রায়‌ই ট্যুরে যেতে হতো। কখনও দুই একদিনের জন্য, কখনও বা ফিরতে সপ্তাহ ঘুরে যেত। সঙ্গে থাকতো দক্ষ ও বিশ্বাসী ড্রাইভার রামাদীন।
মা আমাদের নিয়ে কোম্পানির বাংলোতেই থাকতেন । দাদা, দিদি আর আমি ওখানকার স্কুলে পড়াশোনা করতাম।
সেবার, কিছুদিন হলো বাবা ‌ গিয়েছেন ট্যুরে , দিন দুয়েকের মধ্যেই ফিরবেন , এমন সময় কলকাতা থেকে দাদুর টেলিগ্রাম এলো , ফুল পিসির বিয়ে হঠাৎ ঠিক হয়ে গেছে , পাত্রপক্ষের দাবি সামনের সপ্তাহেই বিয়ে দিতে হবে‌ ,না হলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আর দিন নেই, পাত্রপক্ষ অতো দেরি করতে নারাজ, অগত্যা—।
আমাদের মধ্যে তো আনন্দ আর উত্তেজনার সীমা নেই , কোন জামা পড়বো , নতুন বালাজোড়া মা নিশ্চয়ই পড়তে দেবে এবারে কিন্তু গলার হার যে নেই কী হবে? পড়াশোনা ছেড়ে এইসব আলোচনায় মত্ত আমরা দুই বোন, কিন্তু আসল সমস্যা হলো বাবাকে খবর দেওয়া! মনে রাখতে হবে, সে যুগে ফোনের এতো সুবিধা ছিল না।যাইহোক, মা কীভাবে যেন, খবরটা পাঠিয়ে দিলেন। বাবাও এসে পড়লেন তড়িঘড়ি।
সেইসময় কলকাতায় আসার জন্য ট্রেন‌যাত্রাই সবচেয়ে সুবিধাজনক , কিন্তু কলকাতার ট্রেন ধরতে হলে আমাদের তখন ছোটরেলে করে জংশনে এসে ট্রেন ধরতে হতো। এবারে সেটা সম্ভব হবে না , একে সময় কম ,তায় সঙ্গে প্রচুর লটবহর, গয়নাগাঁটি , বিয়ে বাড়ি বলে কথা!
আমাদের এই গাড়িটা তখন সদ্য‌ই কেনা হয়েছে , একেবারে আনকোরা, তাই বাবা ঠিক করলেন গাড়িতেই কলকাতায় যাওয়া হবে। বাবা আর রামাদীন ভাগাভাগি করে গাড়ি চালাবে। পথে অনেক ডাকবাংলো রয়েছে , সুবিধেমতো জায়গায় রাত কাটিয়ে নেওয়া যাবে। ট্যুরের চাকরির কল্যাণে এই অঞ্চলের সমস্ত রাস্তাঘাট বাবার নখদর্পণে।
ঠিক হলো পরদিন খুব ভোরেই র‌ওনা দেওয়া হবে ,আসলে পথে শোন নামে একটা বড়ো নদী পড়ে , সেটা পার হবার একটা ব্যাপার আছে। তখন ঐ নদীর উপরে কোনো ব্রিজ ছিলো না। বিশাল এক ভেলায় করে নদী পারাপার করতে হতো। ট্রাক হলে একেকবারে একটা করেই পার হয়, আমাদের মতো প্রাইভেট কার হলে, কয়েক জন মানুষ‌ও,গরু ছাগল নিয়ে ভেলায় চড়ে বসে। সন্ধ্যের পর পারাপার বন্ধ হয়ে যাবে, ওপারে আবার রাস্তার দুই ধারে বেশ কয়েক মাইল জুড়ে জঙ্গল। বাবা চাইছিলেন বেলাবেলি ঐ পথটুকু অতিক্রম করে যেতে। সেইমতো ,পরদিন‌ই খুব ভোরে আমরা র‌ওনা দিলাম। তখনও আকাশের এক কোণে শুকতারা মিটমিট করছে। বাগানের লম্বা লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ , হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে আমাদের বিদায় জানালো।
প্রথমদিকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো ,আমরা সময়মতো পথে থেমে থেমে জলখাবার , দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে নিচ্ছি। দারুণ একটা পিকনিকের মতো ব্যাপার। সে কী আনন্দ!! হঠাৎ ঘটলো ছন্দপতন। এক জায়গায় রাস্তা আটকে দিয়েছে পুলিশ। কী যেন একটা কারণে সামনে রাস্তা বন্ধ।
ঘন্টা দুয়েক আটকে থেকে , আবার যখন যাত্রা শুরু হলো ,তখন বেলা পড়ে আসছে।
নদীর ধারে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গেল । সমস্ত আকাশ অস্তরাগে রাঙিয়ে সূর্যদেব ধীরে ধীরে পাটে বসছেন, নদীর জলে আবীর গুলে দিয়েছে কেউ ।
সেদিন আবার নদীর এপারে গঞ্জের হাট ছিল, হাট ফেরত দেহাতি মানুষজন ,গরু ,ছাগলের ভীড়ে, নদীতীর একেবারে ছয়লাপ।
পাশে ধাবার কাছে দুটো লরি দাঁড়িয়ে। চালকদের জোরদার খানাপিনা চলছে। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সুরার বোতল। আমাদের দেখেই কিনা কে জানে ,‌উল্লাস, হুল্লোড় একেবারে তুঙ্গে। ওদিকে ভেলায় পারাপার চলছিলোই।
কোন‌ও মতে চা জলখাবার খাইয়েই বাবা আমাদের গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। লরিচালকদের লোলুপ দৃষ্টির মর্ম ঐ ছোটবয়সেও বুঝতে অসুবিধা হলো না আমাদের।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতেই চাইছিলেন বাবা, কিন্তু বাদ সাধলোঐ লরির ড্রাইভাররা। খাওয়া ফেলে উঠে এসে পারাপারের অগ্রাধিকার নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে দিল।
বাবা সরে দাঁড়াতেই চাইলেন , কিন্তু সেখানেও সমস্যা , তাদের খাওয়া আর শেষ‌ই হয় না।
অবশেষে , অনেকক্ষণ পরে একখানা ট্রাক র‌ওনা হলো।তারপর দ্বিতীয়টির পালা। কিন্তু না! হুকুম জারি করা হলো আমাদের গাড়িটা ভেলায় তুলতে। ঘাটের কর্মচারীদের একজন বাবার পরিচিত। সঙ্গোপনে বলে গেলেন , ওদের মতলব সুবিধের ঠেকছে না। ওরা চাইছে আপনাদের গাড়িটাকে মাঝে রেখে ঘেরাবন্দী করার, যাতে ওপারে জঙ্গলের নির্জন রাস্তায় লুটপাটের সুবিধা হয়। ইদানীংকালে এই ধরনের বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে বলে কানে আসছে।
শুনুন আপনাদের বাঁচানোর জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো , বাকিটা আপনাদের ভাগ্য আর ঈশ্বরের দয়া।
আপনাদের গাড়ি চলে যাবার পর নানা অজুহাতে পিছনের লরিটাকে পার করতে দেরী করবো , তারমধ্যে যা করার আপনাদের‌ই করতে হবে। ভেলায় পার হবার সময়টুকুতেই প্ল্যান করে নিন। প্রথম ট্রাকের দুজনের সঙ্গে এঁটে ওঠাটা তবু, চারজনের চাইতে সহজ হবে। একটাই ভরসা এরা মদ খেয়ে ঈষৎ বেসামাল। ধাক্কাধাক্কি হলে ভারসাম্য হয়তো রাখতে পারবে না , অবশ্য ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে , অবস্থা বুঝে কাজ করবেন।
ওপারে নেমে ,দেখা গেল রাস্তা পরিষ্কার শুনশান। আধমাইলটাক নির্বিঘ্নেই যাওয়া গেল , কিন্তু জঙ্গল শুরু হবার একটু পরেই সব আশঙ্কা সত্যি করে ,দেখা‌ মিলল লরিখানার। সেটা পথের উপরে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা।
ড্রাইভার আর খালাসি, ঈষৎ অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় পথের উপরে দাঁড়িয়ে , হাতে পিস্তল ।
রামাদীন প্রস্তুত‌ই ছিল। সবাইকে গাড়ির মধ্যেই বসে থাকতে বলে , গাড়ি থেকে নেমে মাথার উপরে হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে সোজা এগিয়ে গেল ওদের দিকে । পরিস্থিতির আকস্মিকতায় ওরা থতমত খেয়ে কি করবে বুঝে ওঠার আগেই রামাদীন কাছাকাছি গিয়ে লাফিয়ে উঠে এক লাথি কষালো হাতের অস্ত্রটা লক্ষ্য করে। ছিটকে পড়ে গেল অস্ত্রখানা ,সেই সুযোগে রামাদীন বেসামাল ড্রাইভারকে একধাক্কায় মাটিতে ফেলে পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে একলাফে লরির ড্রাইভারের সিটে উঠে বসলো , গাড়ির চাবিটা ঝুলছিলোই ,রামাদীন অনায়াসে লরিটায় স্টার্ট দিয়ে সোজা চালিয়ে দিল ওদের লক্ষ্য করে। হতভম্ব হয়ে, প্রাণ বাঁচাতে ওরা দুজনে তখন মাঠঘাট পেরিয়ে দে ছুট।
রামাদীন বাবাকে গাড়িটা নিয়ে পিছন পিছন আসতে ব’লে, ট্রাকটা চালিয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো সামনের দিকে । রামাদীনের পরিকল্পনাটা ঠিক বোধগম্য না হলেও সেই মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে ও-ই সেনানায়ক। বাবা বিনা প্রতিবাদে ওর নির্দেশ মেনে চলছিলেন। আমাদের হাতে বিশেষ সময়ও তো নেই , পিছনের ট্রাকটা এসে পড়লো বলে!
প্রায় মাইলখানেক গিয়ে রামাদীন ট্রাকটাকে পথের পাশের নয়ানজুলিতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ির চাবিটা ছুঁড়ে দিলো দূরের মাঠে। তারপর তড়িঘড়ি
আমাদের গাড়িতে উঠে এসে ,স্টিয়ারিং হুইল ধরলো। পিছনের ট্রাকটা আমাদের ছেড়ে কথা ক‌ইবে না। অত‌এব দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে হবে আমাদের।
রামাদীন গাড়িতে স্পিড তুললো। সে যুগের গাড়ি এই যুগের মতো‌ এতো গতিসম্পন্ন ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল পিছনে ধেয়ে আসা ট্রাকটার, আমাদের নাগাল পেতে বেশীক্ষণ লাগবে না। আমাদের বাঁচার জন্য অন্য কিছু একটা করতেই হবে।
এবার বাবা আসরে নামলেন , একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে, বাবার নির্দেশে রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ঢুকলো ঝোপ জঙ্গলে প্রায় ঢেকে যাওয়া একটা কাঁচা রাস্তায়। ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে যেতে যেতে একটু দূরেই দেখা মিলল ভগ্ন ও পরিত্যক্ত এক ডাকবাংলোর। মাথার ছাদ পড়োপড়ো , ভাঙা ফটক, বাতিস্তম্ভ কাঁটা ঝোপে ঢাকা। বাবা ইতিমধ্যে নেমে পড়েছেন ঝোপের ভাঙা ডালপালার যথাসম্ভব মেরামতিতে , যাতে রাস্তা থেকে আমাদের জঙ্গলের পথে নেমে আসার চিহ্ণটুকুও কেউ খুঁজে না পায়। বাবার দুই হাত রক্তাক্ত, শার্ট ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। ওদিকে দূরে অন্ধকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ধেয়ে আসা তীব্র হেডলাইটের আলো। সম্ভবত শিকার ফসকে যাবার আক্রোশে উন্মত্ত তারা।
বাবা তড়িঘড়ি গাড়িতে উঠে পড়লেন। তাঁর নির্দেশে
অবশেষে ঐ ডাকবাংলোর ফটকের সামনে আসা গেল। আপাদমস্তক কাঁটায় আবৃত বাংলোটি বাইরে থেকে প্রায় অদৃশ্য। আন্দাজে সামান্য একটু পথের নিশানা মিলতেই গাড়ির সমস্ত আলো নিভিয়ে রামাদীন সবেগে আরোহীসহ গাড়িটা ঢুকিয়ে দিলো কাঁটাবনে,আর কী আশ্চর্য দুর্ভেদ্য সেই কণ্টকবন একেবারে মায়ের মতোই , আঁচল চাপা দিয়ে লুকিয়ে ফেললো আমাদের।
সাধে কী আর এত বছর ধরে এতো যত্নে গাড়িটাকে আগলে রেখেছে দাদা!

Exit mobile version