Site icon আলাপী মন

কবিতা- ভুবনডাঙার পঞ্চা

ভুবনডাঙার পঞ্চা
-সুমিত মোদক

 

 

তোর মনে আছে পঞ্চার কথা!
আমাদের পঞ্চার কথা …

যে পঞ্চা তরতর করে গাছে উঠে পড়ে
পেড়ে আনতো
পাখির ডিম কিংবা পাখির ছানা;
আমাদের দেখিয়ে আবার রেখে আসতো পাখির বাসায়;
সেই পঞ্চা …

বহু যুগ পরে হঠাৎ আজ দেখা;
আমি তো চিনতেই পারিনি;
এতোগুলো বছরে ওর মুখটা ভুলে গিয়েছিলাম;
ভুলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক নয়;
অথচ, ও ভোলেনি …

সেই যে কবে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে
এ শহরের আধখানা আকাশ-জীবনে
থেকে গেছি
তা আর খেয়াল নেই;
পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র, সংসার…
এখন এ জীবন-স্বাভাবিক ছন্দে…

আগে তখন পূজার সময় গ্রামের বাড়ি যাওয়া হতো;
সে পাঠও অনেক যুগ উঠে গেছে;
তখন, পূজা কদিন পঞ্চার সঙ্গে দেখা হতো…
গল্প করতো;
ছেলেবেলা গল্প, পাখির ছানা পেড়ে আনার গল্প, সংসার বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ের গল্প;
পঙ্গু বোনটার গল্প, আন্দোলনে সময় নিখোঁজ হয়ে যাওয়া দাদার গল্প…
সেই যে বাবা-মা ভেঙে পড়লো, আর কোনোদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না…

সেই ছেলেবেলায় একদিন আমাদের দেখাবে বলে পাখির বাসা থেকে পেড়ে নিয়ে আসছিল পাখির ডিম;
অসাবধানে একটা ডিম হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়;
সে দিন দেখেছিলাম ওর অসহায় মুখটা;
সে মুখটা হয়তো কোনদিনও ভুলতে পারবো না;
তার পর থেকে আর কোনদিনের জন্য পঞ্চা,
পাখির ছানা বা ডিম পেড়ে আনতো না.…

সেই পঞ্চার সঙ্গে দেখা হলো আজ;

কদিন ধরে স্ত্রীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না;
হঠাৎ-ই ভর্তি করতে হলো নার্সিং হোমে;
রক্তের প্রয়োজন.…
এদিকে শহর, রক্তের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না;
খরচ করেও রক্ত মিলছে না;

এমন সময় এক মানুষের সন্ধান পাওয়া গেল;
মোটা টাকার বিনিময়ে নিজের রক্ত বিক্রি করে;
এ মানুষগুলো টাকার বিনিময়ে নিজের রক্ত বিক্রি করে ;
সে টাকায় ওদের পরিবারের পেট চলে;
দুবেলায় একমুঠো খেয়ে টিকে থাকে
গোটা পরিবার;

এভাবেই টিকে আছে আমার দেশ,
আমার ভারতবর্ষ;
এভাবেই টিকে থাকে .…

স্ত্রীর রক্তের চাহিদাটা পূরণ হলো ঠিকই;
কিন্তু, মাথায় একটা ভূত চেপে বসলো;
দেখার ইচ্ছা হলো একবারের জন্য
নিজের রক্ত বিক্রেতাকে,
গোটা একটা ভারতবর্ষকে;

দালালকে বলে-কয়ে রাজি করালাম;
সেখানে গিয়ে বেশ কিছুটা অবাক হতে হলো;
মানুটাকে খুবই চেনা;
তবে কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারলাম না;
ছন্দ কাটলো যখন বুভুক্ষু এক ভারতবর্ষ
রক্তের বিনিময় টাকাটা নিতে চাচ্ছিল না আর;

”বন্ধু কি কখনও বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিতে পারে!”

মাথার উপর ভেঙে পড়লো সারাটা আকাশ;
কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল বাতাস,
আমার আমিত্ব;

“কিরে চিনতে পারলি না!
আমি পঞ্চা, ভুবনডাঙার পঞ্চা …”

এর পরের শব্দগুলো আর শুনতে পাই নি;

যে নিজের জীবনের বাজি রেখে মাঝে মধ্যে নিজের রক্ত বিক্রি করে;
যার ইনকামের একমাত্র পথ এটাই …
সে কিনা টাকা নিলোই না, কেবলমাত্র ছেলেবেলার বন্ধু বলে!

আমার সারাটা শরীর কখন যে জমাট বেঁধে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি;
কেবল তাকিয়ে ছিলাম পঞ্চার দিকে;
আমার শৈশবের দিকে, আমার পাড়া-গাঁ, আমার ভারতবর্ষের দিকে …
সম্বিত ফিরলো দালাল ছেলেটার ঝাঁকুনিতে;

ততক্ষণে পঞ্চা দৃষ্টি থেকে অনেক দূরে;
হয়তো পা বাড়িয়েছে গ্রামের পথে!
হয়তো বা নতুন কোনও ক্রেতার কাছে …

তোর কি মনে আছে পঞ্চার কথা!
আমাদের পঞ্চার কথা!
আমার পঞ্চার কথা!

Exit mobile version