পায়ের চিহ্ন নিয়ে পড়ে থাকা পথখানি যায়
-সুনির্মল বসু
গেস্ট হাউসের সামনে সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ যখন টো টো থেকে নামলাম, তখন গাছের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ। চারদিকে মৃদু ঠান্ডা বাতাস, মাইকে কোথাও কার্তিক পূজো উপলক্ষে গান বাজছিল। গেস্ট হাউসের কর্মীরা সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। দোতলা, তিনতলায় আমাদের থাকবার জন্য ঘর বরাদ্দ করা ছিল। সেখানেই আমরা বিশ্রামের জন্য পৌঁছলাম। চা-বিস্কুট এলো। পাখাটা হালকা করে চালিয়ে দিয়ে, আমরা নতুন জায়গাটা নিয়ে পর্যালোচনা এবং পরিকল্পনা জুড়ে দিলাম।
ইতিপূর্বে হাওড়ার স্টেশনের আঠারো নম্বর প্লাটফর্ম থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে চড়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতায় এসেছি।
সব সুদ্ধ দশজন। যোগীজী বয়সে তরুণ। উত্তরপ্রদেশে জন্ম। ধ্যান, প্রাণায়াম শেখান। সাত্ত্বিক মানুষ।
কলকাতার বাসিন্দা, বর্তমানে ঋষিকেশ নিবাসী চন্দ্রানী ট্রেনের ভেতর সকলের হাতে শর্মার বিখ্যাত খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।
ট্রেনের ভেতর গল্প জমে উঠলো। সারাটা পথ কথা চললো, অপরিচয়ের দেওয়াল গেল সরে। যেন একে অন্যের কাছে কত দিনের পরিচিত।
গেস্ট হাউসে রাতের খাবার একসময় পৌঁছে গেল। শীতের পোশাক আনা হয়েছিল। কিন্তু প্রথমদিকে এখানে পাখা চালাতে হয়েছিল। ভোররাতে অবশ্য পায়ের কাছে থাকা কম্বল টেনে নিতে হয়েছে।
পরদিন সকাল বেলা যে যার পছন্দ মতো লুচি মিষ্টি
খেয়ে গড়বেতার গভীর জঙ্গলে সদলবলে ঢুকে পড়লাম। পায়ের নীচে লাল মাটি, চড়াই উৎরাই পথ। পথের দু’ধারে ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলে মাঝে মাঝে হাতির দেখা মেলে।
জলাশয়ের পাশে হাতির পায়ের ছাপ দেখা গেল। দেদার ছবি তোলা হলো। চারদিকে এত বর্ণময় সবুজের সমারোহ, লাল মাটির সোঁদা গন্ধ, বনফুলের বর্ণ সুষমা, গাছপালা ও বৃক্ষলতার জগৎ, মানুষের মনকে উদাস করে দেয়।
মনে পড়ছিল, এমনই বিজন অরণ্যে হাঁটতে হাঁটতে একালের শক্তিমান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একদিন লিখেছিলেন, হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান।
মনে পড়ছিল, কবি বীরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা,
সারাজীবন পাতাঝরা বৃক্ষ তুমি…
সারা জীবন পাতা ঝরা বৃক্ষ তুমি,
তুমি অকালে পাতাঝরার আগেই নিজেকে জেনেছিলে, এই থেকে ঘর তোমাকে দেখলে হেসেছে মাইকেল, কিন্তু মাইকেলের ছিল মাত্র চোদ্দ বছর,
সারাজীবন পাতাঝরা বৃক্ষ তুমি,
কবিতা, জানলে না।
এই নিবিড় অরণ্য প্রচুর কাঁটা লতার জঙ্গল। বুনোফল ও বুনোফুলের সমাবেশ। চোর কাঁটার মতো কেমন যেন স্মৃতির মাঝে জড়িয়ে যায়। এই ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতিগুলো মনে থাকে। কখনো কখনো বিরল মুহূর্তে স্মৃতিগুলো কথা বলে ওঠে অনর্গল।
আমার কবি অরুণ মিত্রের কবিতার লাইন মনে পড়ছিল,
ফুল ফোটবার শব্দ তুমি শুনেছিলে,
আমার হয়নি শোনা, আমার কি দোষ,
মধ্যরাতে একা একা বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো লাগেনা আমার,
যে অর্থে আমার তোমাকে চাই, সে অর্থে কবিতা ভালোবাসি আমি, তবু কেন ফেরাও আমাকে, ফুল ফোটবার শব্দ তুমি শুনেছিলে, আমার হয়নি শোনা,
আমার কি দোষ।
মহিলা সদস্যারা নিজস্বী তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
একসময় বন জঙ্গল পেরিয়ে ১৭৯৭ সালে প্রতিষ্টিত শিব মন্দির দেখতে যাওয়া হলো। ভিন্ন ভিন্ন নামে ভোলা মহেশ্বরের নামে পরপর অনেকগুলো মন্দির।
সযত্ন রক্ষণাবেক্ষণের ফলে এই দেবভূমি ভক্তি পবিত্রতা ও সৌন্দর্যে আজও অনন্য হয়ে রয়েছে।
এরপর যাওয়া হলো, সর্বমঙ্গলা মন্দিরে। এখানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। ভিতরে অজস্র ভক্তমণ্ডলীর সমাবেশ।
সবশেষে, গনগনিতে আসা হলো। পশ্চিমবঙ্গের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলা হয়, এই অঞ্চলটিকে। এই ধরনের প্রেক্ষাপট একমাত্র ভারতবর্ষের চম্বল অঞ্চলে দেখা যায়। আমেরিকার কলোরাডো নদীর পাশে রয়েছে বিখ্যাত দ্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা অঞ্চলে এজাতীয় গিরিখাত রয়েছে। গনগনি নামে এই অঞ্চলে তার ব্যাপক প্রসিদ্ধি।
লোক শ্রুতি আছে যে, জননী কুন্তীর মধ্যম পুত্র ভীম এর সঙ্গে বক রাক্ষসের লড়াই এই অঞ্চলে ঘটেছিল।
এখানকার মাটির রঙ তাই লাল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। চম্বলের বেহড়ের মতো খানিকটা দুর্গম এখানকার চলার পথ। পাশেই শিলাবতী নদী প্রবহমান। এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাস। বাইরে থেকে এখানকার মাটিকে শক্ত মনে হলেও, আসলে অনেক জায়গায় মাটি একেবারে পলকা। কিছু কিছু জায়গায় যাওয়া দুষ্কর।
সঙ্গী-সাথীরা অনেকেই নিচে নেমে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মাথার ওপর তখন গনগনে সূর্য।
গনগনির গনগনে সূর্যের তেজ উপেক্ষা করে পর্যটকেরা বহুদূর পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ালেন, প্রাণভরে ছবি তুললেন, ঐতিহাসিক জায়গার স্মৃতির আলোটুকু বুকের মধ্যে ধরে রাখবার জন্য সচেষ্ট হলেন।
এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক পটভূমি, লৌকিক বিশ্বাস, প্রাচীন কাহিনী কিংবদন্তী সম্পর্কে অনেকেই সবিশেষ আগ্রহী। অনেকে বলেছিলেন, সকালে এখানে এলে, আরো ভালো হতো।
সবচেয়ে কম বয়সী তরুণ সহযাত্রী, আমাদের সন্তান তুল্য ময়ূখ গনগনির অসম্ভব সুন্দর ভিডিও তুলে সকলের জন্য উপহার পাঠিয়েছে। তাঁর জন্য অনেক শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা।
আসলে আমরা ইতিপূর্বে আরন্য ভূমি পেরিয়ে, দু-দুটো দেবভূমি দেখে এসেছি। সবটাই পথের সঞ্চয়।
স্মৃতির সংগ্রহশালায় সবটাই জরুরী।
দেখতে দেখতে যাবার সময় এসে গেলো। একটি মনোরম কুঠী বাড়িতে দুপুরের খাবার খাওয়া হলো। তারপর আরণ্যক এক্সপ্রেস ধরে সদলবলে আমাদের কলকাতায় ফেরার কথা।
শালিমার স্টেশনে নেমে, সকলের মন খারাপ। আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় প্রত্যেকেই ভারাক্রান্ত।
একজন বলছিল, মনে হচ্ছে আমরা অনেকদিন সবাই মিলে একসঙ্গে ছিলাম।
সমগ্র ভ্রমণের পরিকল্পনা এবং আয়োজক ছিলেন
তেনজিং ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস।
যার উদ্যোগে এই আয়োজন, তিনি আমার সহৃদয় বন্ধু। তাঁর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, সে কথা স্মরণে রেখে, আমি নিজের কৃতজ্ঞতার কথা তাকে জানাচ্ছি না ,আমার হৃদয়ের গভীর ভালোবাসাটুকু তাঁর উদ্দেশ্যে উজাড় করে দিচ্ছি।