বিয়ের ফুল
-মানিক দাক্ষিত
খেয়েদেয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাবেন, অমনি মোহনবাবুর মুঠো ফোনটা বেজে ওঠে। গিন্নি ত্রস্ত হয়ে ওঠেন- এতো রাতে দেখো কে আবার ফোন করলো? ফোনটা ধরো। থতমত খেয়ে ফোনটা মোহনবাবু ধরেন- হ্যালো।
-সোনারপুর থেকে সোনাতন দাস বলছি।
– হ্যাঁ হ্যাঁ, বেয়াইমশাই বলুন।
– সম্পর্কটা ধরে রাখতে পারলাম না মোহনবাবু। ক্ষমা করবেন। ভয়ানক একটা খারাপ খবর।
লাউডস্পিকারে ছিল ফোনটা। গিন্নি সুনন্দা বেশ ভালোভাবেই শুনতে পাচ্ছিল। কর্তা গিন্নি উভয়ের মুখ দুটো ভয়ে বিবর্ণ হলো। মোহনবাবু শঙ্কিত গলায় বলেন- খারাপ খবর!
– হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যায় পোড়ারমুখী মেয়ে বাড়ীর মান-সম্মান ধূলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে পাড়ার একটা ছেলের সাথে পালিয়েছে।
– কি বলছেন!
-আমায় আপনারা ক্ষমা করে দেবেন। দুঃখ করবেন না। ভগবান মঙ্গলময়। বিবাহ পরবর্তী অশান্তি থেকে ভগবান আপনাদের বাঁচিয়ে দিলেন।
ফোনটা কেটে যায়। দুঃসংবাদটা বজ্রাঘাত হয়ে পড়লো কর্তা গিন্নির মাথার ওপর। পোড়া কপাল। বিয়েতে পাক লেগেছে ছেলেটার। ঠিক হয়েও শেষে মাঝ দরিয়ায় তরী ডুবলো। প্রায় ডজন খানেক সম্বন্ধ দেখা হয়ে গেলো। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছুটি হলো না।
কলকাতায় টালিগঞ্জের অভিজাত এলাকায়
মোহন বসুর নিজস্ব ছিমছাম দোতলা বাড়ী। পরিবারের সদস্য হাতে গোনা মাত্র তিনটি প্রাণী। গিন্নি সুনন্দা একমাত্র পুত্র পরমেশ্বর আর মোহনবাবু স্বয়ং। পরমেশ্বরের ডাক নাম পরম। পরম খ্যাতনামা একটা বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত। সুদর্শন। মোহনবাবু পেনশনভোগী একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মী। সংসারে অঢেল স্বাচ্ছন্দ্য। তবুও সংসারে সুখ-শান্তির একটা ভয়ানক ঘাটতি! মেঘে মেঘে বেলা হয়ে যাচ্ছে ছেলেটার। বত্রিশটা বসন্ত পার হয়ে গেলো। এখনও ছেলেটাকে পাত্রীস্থ করা গেলো না। এত সহজ সরল যে নিজে থেকে নিজের
পছন্দ মতো কাউকে জীবনসঙ্গিনী করতে
পারলো না। কর্তা গিন্নির সকাল-সন্ধ্যা একই
চিন্তা বয়স হয়েছে। কখন চোখ বুঁজবো, তার ঠিক-ঠিকানা নাই। মনের মতো একটা মেয়ের সাথে ছেলেটার বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে সংসারী দেখে যেতে না পারলে মরেও শান্তি পাবো না।
খবরটা চাউর হতে বেশী সময় লাগলো না। মুহুর্তের মধ্যেই রাতেই পাঁচ কান হয়ে গেল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে পদীখুড়ী বেতো পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ীতে এসে হাজির।
-রেতে খবরটা শুনে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেলো রে বউ। সারাটা রাত ঘুমুতে পারি নাই। তাই সাতসকালে চলে এলাম তোদের বাড়ী।
– ছেলেটার কপাল মন্দ খুড়ী। বিয়েটা হয়েও হচ্ছে না। দেখুন, সব ঠিকঠাক। দুদিন পর আশীর্ব্বাদ। এরই মধ্যে এই অঘটন।
-দুঃখ্যু করিসনে লো বউ। ভালোই হয়েছে। বিয়ে হলে ঐ মেয়ে তোর ঘর করতো মনে করছিস! সংসারে আগুন জ্বলতো। সংসার এক্কেবারে ছারখার হয়ে যেতো। অমন সোনার টুকরো ছেলেটা বেঘোরে মরতো।
-সোনার টুকরো হলে ছেলেটার বিয়ে হচ্ছে না কেন খুড়ী? কমসে কম বারো চোদ্দটা সম্বন্ধ দেখা হলো। আর কত সম্বন্ধ দেখবো!
-বিয়ে বললেই কি বিয়ে হয়রে মা! কথায় আছে– জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে। কেউ জানে না, ভাগ্যে কার সাথে কার বিয়ে লেখা আছে! বিয়ের ফুল যদ্দিন না ফুটবে, তদ্দিন অপেক্ষা করতেই হবে।
বিশাল একটা গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে গলাটা বাড়িয়ে পদিখুড়ী মুখটা সুনন্দার কানের কাছে এনে চাপা স্বরে বলে, গেরোর ফের! আমি বলি কি, তোরা একটা ভালো জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে ছেলেটার কুষ্টি বিচার কর। জ্যোতিষীর পরামর্শে মা দখিনা কালীর পুজো-হোম। যজ্ঞি কর। দেকবি হাতে নাতে ফল পাবি।
সুনন্দা খুড়ীর কথাগুলো বেশ মনোযোগ সহকারে শোনে। হয়তো মনে ধরে। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। নিরুত্তর রয়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।
রাতে খাবার টেবিলে স্বামীকে জ্যোতিষীর কথা তুলতেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন মোহন বাবু। তিরিক্ষি মেজাজে বলেন, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ঐ বেটারা কি করবে? ওদের মুরোদ কতো, তা আমার জানা আছে। এই জ্যোতিষী ভূতটাকে কে তোমার মাথার মধ্যে ঢোকালে বলো তো? যত্তসব বোগাস। সবটাই ভাওতাবাজী – বুজরুকি! লোক ঠকিয়ে টাকা কামানোর ব্যবসা ওদের। ওতে আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নাই।”
কথাগুলো শুনে সুনন্দার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। এতবছর বিবাহিত জীবনে স্বামীর মুখের ওপর কোনোদিন কোনো কথা বলেনি। বলার সাহস পায়নি। আজ তা বলে বসে।স্বামীর কথায় তীব্র প্রতিবাদ জানায় – “আমি বিশ্বাস করি না। মিথ্যা হলে হাজার হাজার মানুষ ওনাদের কাছে গিয়ে ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকতো না। আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তুমি আমাকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে চলো। খোকার ঠিকুজী, কুষ্ঠী বিচার করে ওনারা কি বিধান দেন, দেখো। ঠিক একটা প্রতিকার হবে। ছেলেটার বিয়ে দেয়া না পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।”
গিন্নির রণচণ্ডী মূর্তি দেখে মোহনবাবু ঘাবড়ে যায়। অশান্তির ভয়ে কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে গুটি গুটি পায়ে ওখান থেকে কেটে পড়েন ।
অবশেষে বিশেষ বন্ধুর সহায়তায় মোহনবাবু দক্ষিণ কলকাতার এক জাঁদরেল নামী দামী জ্যোতিষীর চেম্বারে নাম লেখান। ভিজিট সাতশো এক টাকা। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের পাতায় একসাথে প্রতিদিন ওনার অনেক ছবি বেরোয়।
লাখ টাকার বিজ্ঞাপন। প্রতি অমাবস্যায় উনি নাকি তারাপীঠের মহাশ্মশানে পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসে মায়ের সাধনা করেন। সুনন্দা খুশীতে ডগমগ।
তার খুব আশা–ঠাকুর এবার তার মনস্কামনা পূর্ণ করবেনই করবেন।
বহু প্রতিক্ষীত দিনে কর্তা গিন্নি দুজন ট্যাক্সি করে হাজির হয় জ্যোতিষীর চেম্বারে। দেখে ইতঃস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক লোক। সবাই কেমন যেন সব চুপচাপ- একটা থমথমে ভাব। মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসতেই সুনন্দা জিগ্যেস করে, “কি ব্যাপার। উনি এখনও চেম্বারে আসেননি ?
-উনি বসবেন না। শুনলাম, ওনার একমাত্র ছেলের কার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। নার্সিং হোমে ভর্তি।
উনি সেখানেই। কবে বসবেন, অফিস থেকে পরে জানিয়ে দেবে।
ফোনে সংবাদটা পেয়ে পরবর্তী তারিখে একটু আগে ভাগেই সুনন্দা চলে আসে চেম্বারে একাই একটা ট্যাক্সি নিয়ে। প্রাইভেট কারটা নিয়ে আসা যেত, কিন্তু পরমের অফিস যেতে ভীষণ ঝামেলা হবে বলে নেয়নি। কাজের অজুহাত দেখিয়ে স্বামী আজ সঙ্গে আসেনি। চেম্বারটা আজও বন্ধ দেখে মনটা বেশ খারাপ হবে যায় সুনন্দার। চেম্বারের সামনের বেঞ্চে জনা তিনেক মানুষ বসে। ভালো করে লক্ষ করে সে দিনের সেই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলাও রয়েছেন । একটু স্বচ্ছন্দ হয়ে তার পাশ বসে সুনন্দা জিগ্যেস করে, “কখন এলেন? ”
-আমি অনেকক্ষণ এসেছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক।
-চেম্বারতো এখনও খোলেনি।
-দেখছি তো তাই। এমনটি তো হয় না। ঠিক সময়েই খুলে যায়।
মহিলাটির সাথে ভাব জমায় সুনন্দা। অনেক কথা হয়। জিগ্যেস করে- আপনি কি এখানে আগেও এসেছেন?
-না-না, এই প্রথম। একজনের কাছে ওনার কথা শুনেই এসেছি।
-জ্যোতিষী হিসাবে কেমন?
-খুব নাম ডাক। সবাই তো বলে ‘ধনন্তরী’। যা বলে, তাই ফলে। আমাদের পাড়ার কয়েকজন ওনার কাছ থেকে বেশ উপকার পেয়েছেন।
বিড়বিড় করে কি যেন বলে অদৃশ্য শক্তির উদ্দেশ্যে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকায় সুনন্দা। ফোনটা বেজে ওঠে। ত্রস্ত হয়ে সাইড ব্যাগে থাকা হ্যান্ড ব্যাগটা থেকে ফোনটা বার করে দেখে ছেলে পরম!
-বল।
-ওখানে পৌঁছাতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
-না না।
-বাবা তো যাবে না। আমি কি তোমায় নিয়ে আসবো?
-কোনো দরকার নেই। আমি ট্যাক্সি নিয়ে ঠিক চলো যাবো।
ফোনটা কেটে যায়। সময় গড়াতে গড়াতে একটা সময় সুনন্দা অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। ওদের দেওয়া নম্বরে ফোন করে ‘ব্যাপারটা কি’ জানবে কি না ভাবছে, এমন সময় লিকলিকে প্যাকাটির মতো চেহারার একটা লোক বন্ধ চেম্বারের দরজার সামনে মস্ত বড় একটা নোটিশ বোর্ড ঝোলায়। সুনন্দা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দেখে বড় বড় অক্ষরে লেখা– “অনিবার্য কারণবশতঃ অনিদিষ্ট কালের জন্য চেম্বার বন্ধ।” সব আশা এক নিমেষে চূর্ণবিচূর্ণ। মনটা খারাপ হয়ে গেল সুনন্দার। কেন, কি কারণে চেম্বার বন্ধ থাকবে কিছুই জানা গেল না। বাড়ীর দিকে পা বাড়াতেই দেখা গেলো গেটের কাছে একদল মানুষের জটলা। জানা গেল- গতকাল ভোর রাতে জ্যোতিষী মহারাজের স্ট্রোক হয়েছে। এখন কোমায় রয়েছেন। সুনন্দার বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় মনটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। বারবার একই প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। নিজেকে, নিজের পরিবারকে যারা সুরক্ষা দিতে পারে না, তারা অপরের সুরক্ষা কেমনভাবে দেবে। যাদের নিজের পরিবার অশান্তি, নানা সমস্যায় জর্জরিত, তারা অন্যের পরিবারে কেমনভাবে শান্তি আনবেন? সমস্যার কিভাবে সমাধান করবেন? সহজ বোধটা এতদিনে সে সহজভাবে নিতে পারলো না কেন! নাকি এই সহজ বোধটা হতাশাগ্রস্ত দুর্বল মানুষের পক্ষে কিছুতেই তা বোঝা সম্ভব নয়। হয়তো তাই হবে ।
সেদিনের রাতে খাবার টেবিলে বসে স্বামীর রুক্ষ কথাগুলো মনে আসতেই তার শরীরটা কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে।
সুনন্দা যখন বাড়ী ফেরে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাথাটা কেমন ভার- ঝিমঝিম করছে। চটজলদি দুকাপ চা তৈরী করে এনে স্বামীর কাছে একটা চেয়ার টেনে বসে বলে, “চা খাও।” মোহনবাবু আরাম কেদারায় শুয়ে কি যেন একটা বই পড়ছিলেন। মুখ না তুলে জিগ্যেস করেন, “কাজ হলো?” সুনন্দা হতাশা মাখা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে– ‘না-গো, কিছুই হলো না। পাক লেগেছে। ছেলেটা মনে হয় আমার শেষ পর্যন্ত আইবুড়োই থেকে যাবে।” বই থেকে মুখ তুলে মোহনবাবু সুনন্দার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে চান- “কেন, কি হলো? জ্যোতিষী কি বল্লেন?”
-সাক্ষাৎ হয়নি। চেম্বার বন্ধ ছিল। খুলবে খুলবে করে ঠায় বসে থেকে শেষে জানা গেল- ওনার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে।
-যাদের কাছে এতো নিরাপত্তা, রক্ষা কবজ মজুত, সেখানে এতো বড় বড় বিপদ তাদের আসে কিভাবে বুঝি না। তাহলে কি অন্য এক জ্যোতিষী মহারাজের সন্ধান নেবো?
সুনন্দা কঠিন স্বরে উত্তর দেয়, “না, কোনো দরকার নেই।”
মোহনবাবুর মুঠো ফোনটা বেজে ওঠে। বুক পকেট থেকে বার করে ধরেন- বল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, বাড়ী চলে এসেছে। এই তো তোর মা আমার সামনে বসে। কথা বল। ফোনটা গিন্নির হাতে ধরিয়ে দেয় মোহন বাবু।
-বল।
-ফোনটা বন্ধ করে রেখেছো কেন?
-বন্ধ করে রেখেছি! কই না তো!
-যতবার কল করছি। শুনছি সুইচ অফ।
-তাহলে চার্জ নেই। চার্জ না থাকায় মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেছে। তুই কখন ফিরবি?
-আজ ফিরতে একটু দেরী হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে আসিস। রাখ।
চার্জ দেওয়ার জন্য ফোনটা ব্যাগ থেকে বার করতে গিয়ে সুনন্দা হতবাক। তন্নতন্ন করে খোঁজে সাইড ব্যাগের ভেতরে থাকা হ্যাণ্ডব্যাগটা। এই হ্যান্ডব্যাগের মধ্যেই ছিলো পার্স আর স্মার্ট ফোনটা। সাইড ব্যাগটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। একেবারেই অক্ষত। কোনো কাটা-ছেঁড়া নাই। কোথায় গেলো। মাথায় হাত দিয়ে হয়ে বসে পড়ে সুনন্দা। মানিব্যাগে হাজার পাঁচেক টাকা ছিল। ওটার জন্যে দুঃখ হলেও অতটা কষ্ট নাই। কিন্তু তার সাধের স্মার্ট ফোনটা না পেলে যে সে বাঁচবে না। গ্যালারীতে তার কত শখের ও দুষ্প্রাপ্য ছবি ছিল। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে সুনন্দার। বিষাদের সুরে সে স্বামীকে বলে, “কি হবে গো!”
-কি আর হবে। চোট হয়েছে। সেটা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে! থানায় একটা ডাইরি করতে হবে। পেলেও পেতে পারো।
নিজের ফোনটা থেকে মোহনবাবু হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর ফোনটাতে কল করে। অধীর আগ্রহে সুনন্দা জিগ্যেস করে। “রিং হচ্ছে?” মোহনবাবুর গলায় হতাশার সুর-“সুইচ অফ।”
মনমরা হয়ে ভর সন্ধ্যেয় ঘরে লাইট অফ করে গা এলিয়ে শুয়ে সুনন্দা। একটা জিনিষ তার মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছে কোথায় ফোনটা মিসিং হতে পারে। কিছুতেই তো তার মাথায় আসছে না। এমন সময় চীৎকার করতে করতে ঘরে ঢোকে পরম- “দেখো, তোমার ফোনের নম্বর থেকে একটা ফোন এসেছে আমার ফোনে। ধরো।” সুনন্দা তড়িৎ গতিতে বিছানায় উঠে বসে ফোনটা রিসিভ করে-‘হ্যালো’
-যে ফোনটা থেকে ফোন করলাম, এটা কি আপনার ফোনের নম্বর?
-হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমার।
-ধরেছিলেন কে?
-আমার ছেলে।
মহিলার কন্ঠস্বর। উদ্বিগ্ন হয়ে সুনন্দা জিগ্যেস করে, “আপনি কে? কোথা থেকে বলছেন?”
-ব্যস্ত হবেন না। ধৈর্য্য ধরুন। ফোনটির ব্র্যাণ্ড, মডেল বলতে পারবেন?
-সামসাং গ্যালাক্সি এ নাইন প্রো।
-শুধু ফোনটাই হরিয়েছে, না আরও কিছু…
-ফোনের সাথে পার্স। একটা ছোট্ট হ্যান্ড ব্যাগের মধ্যে ছিল।
-পার্সে কত টাকা ছিল?
-দশটা পাঁচশো টাকার নোট, তিনটে একশো টাকার নোট। খুচরো কত টাকা ছিল বলতে
পারবো না।
-আর কিছু ছিল না?
-না।
–কিন্তু আমি যে দেখছি ওর মধ্যে মেট্রো রেলের একটা স্মার্ট কার্ড রয়েছে।
–ঠিক ঠিক। ওটা আমার মনে ছিলো না। -আপনি থাকেন কোথায়?
-টালিগঞ্জের রিজেন্ট পার্কে।
ব্যাগটা আমার মা পেয়েছেন। ব্যাগটা থানা থেকে নেবেন, না আমাদের বাড়ী এসে নিয়ে যাবেন?
-প্লীজ, থানায় জমা দেবেন না। আপনাদের বাড়ি থেকে আমরা নিয়ে আসবো। আপনাদের বাড়ীর ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা যদি অনুগ্রহ করে বলেন।
-এভাবে আপনি কথা বলবেন না। আমি আপনার মেয়ের বয়সী। এখানে দয়া, অনুগ্রহের কোনো প্রশ্নই আসে না। আপনার হারানো জিনিষগুলো সঠিক ভাবে আপনাদের হাতে তুলে দেওয়াটাই আমরা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি।
-তোমার সাথে কথা বলে ভীষণ ভালো লাগলো মা। আমার ছেলে তোমার সথে একটু কথা বলবে।
ভীষণ নার্ভাস লাগে পরমের। কাঁপা হাতে ফোনটা ধরে কম্পিত স্বরে বলে, “হ্যালো।”
-বলুন।
-যদি আপনার ফোন নম্বর, আর বাড়ীর ঠিকানাটা দেন..
তেজোদীপ্ত কন্ঠে ফোনের ওপার থেকে উত্তর আসে- ফোন নম্বরের দরকার নাই। বাড়ীর ঠিকানা, লোকেশান সহ ডিটেলস্ মেসেজ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আসতে অসুবিধা হবে না।
-বলছিলাম কি, এখনই যদি আপনাদের ওখানে যাই, অসুবিধা হবে?
একরাশ বিরক্তি নিয়ে মেয়েটি উত্তর দেয়, “এত তাড়া কিসের! আগামীকাল বেলা দশটার পরে আসুন। রাখছি।
ফোনটা কেটে যায়। পরমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালটা মুছতে মুছতে আপনমনে বিড় বিড় করে বলে, ‘মেয়ে তো নয়, যেন ধানী লঙ্কা!”
পরের দিন রবিবার। ছুটির দিন। রাতে ভালো ঘুম হয় নাই, সুনন্দার। কতক্ষণে হারানো জিনিষগুলো নিজের কাছে ফিরে পাবে- তাই নিয়েই তার দুশ্চিন্তা। নিজেদের সান্ট্রো গাড়ী করে তিনজনই রওনা দেয় ঢাকুরিয়ার শরৎ ঘোষ গার্ডেন রোডের উদ্দেশ্যে। ওখানেই ভদ্রমহিলার বাড়ী। গাড়ী ড্রাইভ করে পরম। ওখানে গিয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখে সুনন্দা থ। জ্যোতিষীর চেম্বারের বাইরে এই ভদ্রমহিলার সাথেই তো তার আলাপ হয়েছিল। জিনিষগুলো বাইরে থেকে নিয়ে ফেরার মনস্থ করেছিলো ওরা। কিন্তু তা হলো না। ভদ্রমহিলা অতি বিনয়ের সুরে বলেন, “বাইরে থেকে চলে যাবেন, এটা একেবারেই ভালো দেখায় না। গরীবের ছোট্ট চালাঘরে দুদণ্ড বসলে ভীষণ ভালো লাগবে। আসুন। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ওরা তিনজনই মহিলার টালির চালাঘরে বসলেন। ঘরের আসবাবপত্র অতি সাধারণ। বিলাসিতার চিহ্নমাত্র নাই। ঘরটি কিন্তু বেশ পরিপাটি করে সাজানো। ভদ্রমহিলার সাথে অনেক কথা হলো। কিভাবে ওখানে বেঞ্চের নীচে হাতব্যাগটা পেলেন, তা-ও সবিস্তারে জানালেন। সুনন্দা মহিলার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে নিজের কপালে ঠেকিয়ে পরম আবেগে বলে, আপনার মতো সৎ, ভালো মানুষের হাতে পড়েছিলো, তাই পেলাম। নইলে মাথা খুঁড়লেও পেতাম না।” ভদ্রমহিলার মেয়ে পাশের ঘর থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায়। হাতে ওদের হারিয়ে যাওয়া ব্যাগটা। “এই নিন ব্যাগ। একবার দেখে নিন– সব ঠিক আছে কি-না।” মেয়েটিকে দেখে ওদের চক্ষু স্থির। মেয়েটির পরনে সাদা-মাটা একটা আটপৌরে শাড়ী। বুদ্ধিদীপ্ত টানা টানা চোখ। একঢাল চুল। একেবারে লক্ষ্মীপ্রতিমার মত চেহারা! মোহন বাবু মুগ্ধ নয়নে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন মেয়েটির দিকে। সুনন্দা জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। বলে, “কি সুন্দর মিষ্টি মেয়ে। কালকে তুমিই আমাকে উকিলের মতো জেরা করছিলে, না?” মেয়েটি সলজ্জভঙ্গীতে নতমস্তকে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। সুনন্দা জিগ্যেস করে, “তোমার নাম কি মা?”
– খুশী। খুশী সরকার।
-বাঃ, খুব সুন্দর নাম। পড়াশুনা?
-বি.এসসি কেমিস্ট্রীতে অনার্স, বি.এড।
মোহনবাবুর গলায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা –বাঃ, তোমাকে দেখে বোঝাই যায় না। প্রকৃত শিক্ষিতা তুমি। কিছু করছো এখন?”
– আপাততঃ সেরকম কিছু নয়। বাড়ীতে নাইন-টেনের কয়েকটা ছেলে মেয়েকে পড়াই।
উঠে দাঁড়ায় খুশী । বলে, “একটু বসুন। আপনাদের জন্যে একটু চা করে নিয়ে আসি।” মোহন বাবু, সুনন্দা না করলেও সে শোনে না। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে শান্ত গলায় বলেন, “তাই বললে হয়। গরীবের ঘরে এসেছেন। একটু চা না খেয়ে শুধু শুধু চলে গেলে বড্ড খারাপ লাগে। এই ফাঁকে সুনন্দা মোহনবাবুর সাথে চোখে চোখে একটু ইশারায় কথা বলে। সুনন্দা ভদ্র মহিলাকে জিগ্যেস করে, “এই মেয়ের বিয়ের ব্যাপারেই জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলেন, তাই না দিদি?”
-হ্যাঁ হ্যাঁ, কত দেখাশুনা চলছে। কিন্তু কোথাও মেয়ের পছন্দ মতো শর্তানুযায়ী পাত্র মিলছে না।
-আমিও জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম আমার এই ছেলের জন্য। আমাদের একমাত্র ছেলে। চাকরি করে।
-খুব সুন্দর! একেবারে রাজপুত্তুর। এসে থেকেই দেখছি আপনার ছেলেকে।
পরম লজ্জা পায়। সঙ্কোচে উদাস নয়নে একটু উপরের দিকে তাকায়। সুনন্দা মোহনবাবুর দিকে তাকালে মোহনবাবু একটু নড়েচড়ে বসেন। অতি বিনয়ের সুরে ভদ্রমহিলাকে বলেন, “আপনার মেয়েকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। যদি আমাদের ছেলেকে আপনাদের পছন্দ হয়, তাহলে এই ব্যাপারে একটা পাকাপাকি কথা বলা যেতে পারে। আপনার কি মত?”
ভদ্রমহিলার মুখ নিমেষে খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলেন, “আমার কোনো অমত নাই। আপনাদের মতো পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে আমি ধন্য হয়ে যাবো । আপনারা সবাই আছেন। একসাথে সবার দেখা সাক্ষাৎ হলো। ছেলে মেয়ে দেখলো, মেয়ে ছেলে দেখলো। মেয়ের সাথে আপনারা খোলাখুলি কথা বলুন। মেয়ে যদি রাজী থাকে। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
চায়ের আসরে বেশ জমিয়ে গল্প করতে করতে বিয়ের প্রস্তাবটা রাখেন মোহন বাবু। সরাসরি খুশীকে বলেন, “তোমাকে আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে মা। এবার বলো তোমার কি মতামত? ছেলেকে যদি তোমার কোনো প্রশ্ন করার থাকে। করতে পারো। আমার ছেলে বলে বলছি না। ও ভীষণ সৎ ও কর্মঠ। কোনো নেশা নেই। নিজের গুণগানে একটু অস্বস্তি বোধ করে পরম। সলজ্জ ভঙ্গিতে সে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। মোহনবাবু বলতে থাকেন – নামী বেসরকারী সংস্থায় কাজ করে। মাইনে হাজার পঞ্চাশেক। আমাদের নিজেদের দোতলা বাড়ী। পরিবারের সদস্য বলতে আমরা তিনজন। আমি পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। যাতায়াতের সুবিধার জন্য আমাদের একটা গাড়ী আছে। এই গাড়ীতেই ছেলে অফিস যায় আসে। বাড়ীতে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য দুটোই আছে। কিন্তু অভাব আছে শান্তির। ছেলের বিয়ে দিয়ে সংসারে লক্ষ্মী প্রতিষ্ঠা করতে চাই মা। তোমাকে আমাদের ভীষণ পছন্দ। এখন বলো তোমার মতামত।”
খুশীর চেহারায় আড়ষ্টতার ভাব নাই কোনো। চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে একটা গভীর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। সে অকপটে বলে,”আপনাদের গাড়ী বাড়ী, টাকা কড়ির প্রতি আমার বিন্দুমাত্র লোভ, মোহ বা আসক্তি কোনোটাই নাই। এখন সামাজিক জীবনে মানবিক মূল্যবোধের বড়ই অভাব। আপনাদের কাছে আমার একটা মানবিক এবং একটা ব্যক্তিগত মোট দুটি আবেদন আছে। এই আবেদন দুটি যদি আপনারা স্বচ্ছন্দে মেনে নিতে পারেন, তাহলে আপনাদের প্রস্তাব আমি ভেবে দেখতে পারি। মোহনবাবু ও সুনন্দা সমন্বরে সোৎসাহে বলে ওঠে, “বলো, তোমার কি সেই আবেদন।” মায়াময় সাহসী দৃষ্টিতে খুশী একবার সুনন্দা, আর একবার মোহনবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে সামনে খোলা জানালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলতে থাকে – “আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। বিধবা মায়ের আমি ছাড়া এ-সংসারে আর কেউ নেই। আমি চলে গেলে মা আমার বড্ড একা অসহায় হয়ে যাবে। মৃত্যুশয্যায় বাবার করুণ আর্তি ‘মাকে দেখিস খুকী’ সে কথা আমি আজও কিছুতেই ভুলতে পারিনি। বাবার সরকারী চাকরীর সুবাদে মা অল্প কিছু পেনশান পায়। ঘরভাড়ার টাকা গুনতেই অনেকটা চলে যায়। আমার একান্ত ইচ্ছা, বিয়ে হলে আমি শ্বশুর বাড়ীর কাছাকাছি মা’কে একটা ভাড়া বাড়ীতে রাখবো, যাতে মায়ের দেখাশুনা দুবেলা করতে পারি। মায়ের কষ্ট আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না।”
পাশে বসে থাকা মা আবেগতাড়িত হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলে, এমন কঠিন শর্ত দিলে কেউ তোকে বিয়ে করতে চাইবে না মা। আগের সমস্ত সম্বন্ধগুলো এমনি করেই ভেঙেছে। আমার জন্যে অযথা চিন্তা করিস না। ঠাকুরের দয়ায় আমি ভালো থাকবো। তোর বিয়েটা হয়ে গেলে আমি খুব শান্তি পাবো রে।”
চোখের জলে ভেজা মায়ের চোখ দুটিকে খুশী অতি সযত্নে কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, “ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমার ওপর ছেড়ে দাও।” খুশী ওদের দিকে তাকায়। দেখে ওরা ওদের দিকে সপ্রতিভ দৃষ্টিতে চেয়ে। খুশী পুনরায় বলতে শুরু করে-দ্বিতীয় আবেদন, আমার ছোটোবেলা থেকে আমার জীবনের লক্ষ্য একজন সার্থক স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার। বলতে পারেন-ধ্যান-জ্ঞান। আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল এস এসসির রিটেন পরীক্ষায় পাশ করেছি। ভাইবার এখনও ডাক পাইনি। যদি শিক্ষিকার চাকরীটা পাই, তাহলে আপনাদের কথা দিতে হবে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়ে আমায় চাকুরীটা করার সুযোগ দেবেন। ব্যস, আর আমার কোনো কথা নেই।
মোহনবাবু চোখ বন্ধ করে এতক্ষণ মন দিয়ে কথাগুলি শুনছিলেন। এবার চোখ মেলে তাকান। খুব শান্তভাবে মৃদু স্বরে বলেন, এবার আমাদের পক্ষ থেকে আমি কিছু বলি। সুনন্দা প্রমাদ গোনে। শর্তগুলি স্বামী সহজে মেনে নেবে বলে মনে হয় না। মনের মধ্যে জমে ওঠে একরাশ হতাশা। টানটান উত্তেজনায় মোহনবাবু শুরু করেন– “তোমার মনের কথাগুলো তুমি এত সুন্দর অকপট ভাবে বলায়, আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি মা। তোমাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। তুমি অতিশয় বুদ্ধিমতী, কর্তব্যবোধপরায়ণা, দায়িত্ববোধ সম্পন্না। তোমার বিবেক জাগ্রত। মানবিক বোধ তীব্র। তোমার দুটি আবেদনই আমি মঞ্জুর করলাম। তবে তোমার আবেদনে পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটি আছে, সেটা আমি সংশোধন করতে চাই। কি সংশোধন সেটা আমি বলি?”
খুশীর চোখে মুখে একটু সলজ্জ হাসি। বলে, “বলুন।”
– তুমি যে বলেছো, মাকে তুমি ভাড়া বাড়ীতে রাখবে, সেটি কিন্ত হবে না। আমার বাড়ীতে জায়গার অভাব নেই। উপরে নীচে ছয় ছয়খানি ঘর। বিয়ের পরে ওটা তোমারও বাড়ী। তোমার বাড়ীতে তোমার মা তোমার কাছে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কোনো স্থান নেই। পূর্ণ আত্মমর্যাদা নিয়ে উনি থাকবেন। সকলেই আমরা একই পরিবারের সদস্য।
একটু থেমে মোহন বাবু বলতে শুরু করেন-“আর একটা কথা, তুমি বলেছো, তোমার জীবনের স্বপ্ন, ধ্যানজ্ঞান স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার। তোমার সেই স্বপ্নও আমি পূরণ করবো। যদি তোমার স্কুল শিক্ষিকার চাকুরী হয়, ভালো। করবে। যদি না হয়, তাতেও দুঃখ করার কিছু নাই। আমার বসত বাড়ীর অদূরে একেবারে মেন রাস্তার ধারে দশ কাঠা বাস্তু জমি আছে। আমি কথা দিচ্ছি, সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে আমি ওখানেই একটা জুনিয়র হাইস্কুল গড়ে তুলবো । আর ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হবে তুমি। পরিচালনের ক্ষমতাও থাকবে তোমার হাতে। আমরা পাশে থেকে তোমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবো।”
সকলের চোখে-মুখে খুশীর বন্যা। খুশীতে খুশীর মুখ দুহাতে চাপা। তার দু-চোখ হতে বয় অবিরল আনন্দের অশ্রুধারা। সে একে একে মা, মোহনবাবু সুনন্দাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। সুনন্দা অনির্বচনীয় আনন্দে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে খুশীকে। বাঁধভাঙা আনন্দের প্রবল উচ্ছ্বাসে মধুর চাপাস্বরে বলে ওঠে, “তুমি আমার মা লক্ষ্মী।”
সুনন্দা এখনও বিশ্বাস করতে পারে না- এটা বাস্তব, না কল্পনা ! তার মনে এখনও গভীর সংশয় আর অবিশ্বাস ঘুরন চরকির মতো পাক খাচ্ছে! কেবলই মনে হচ্ছে– বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হবে তো! সত্যি সত্যিই কি এবার ওদের বিয়ের ফুল ফুটলো!
অবাক কাণ্ড! এরই মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে রঙ-বেরঙের একটা বাহারী দুষ্টু প্রজাপতি বিদ্যুৎ গতিতে ঘরের মধ্যে ঢুকে দুটো পাক দিয়ে পরমের মাথার উপর একবার বসেই পরক্ষণে খুশীর নাকের ডগায় বসে দোল খায়। তারপর রঙিন পাখনা মেলে সটান বেরিয়ে যায় খোলা জানালা দিয়ে।