বহমান
-সুমিতা দাশগুপ্ত
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই মধুসূদন বাবুর মনে পড়ে গেল , কাল রাতে তাঁর ইংল্যান্ড প্রবাসী নাতি অভি ,বিদেশিনী স্ত্রী এমিলিকে নিয়ে হঠাৎই চলে এসেছে এখানে মানে তাঁদের ফুলডুংরিতে। কয়েকদিন আগে মাসখানেকের ছুটিতে তারা কলকাতায় এসেছে,সে খবর জানাই ছিল , এখানেও দাদু ঠাম্মার সঙ্গে যে দেখা করতে আসবে তা-তো স্বাভাবিক , কিন্তু দিনক্ষণ জানা ছিলো না। কাল রাতে , ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে তড়িঘড়ি , ডিনারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল ,আজ একটু ভালো করে বাজার করতে হবে। তাঁর আদরের নাতিটি খেতে যে খুব ভালোবাসে সে কথা তিনি বিলক্ষণ অবগত আছেন।ভাগ্যিস আজ হাটবার ,নইলে এই মফস্বল শহরে চট্ করে সবকিছু সবসময় মেলে না।
প্রভাদেবী আগেই উঠে পড়েছিলেন। স্নান ,পুজো সেরে চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছেন তিনি।
চা খেতে খেতে বাজারের লিষ্টটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন মধুবাবু , বাড়ির পুরোনো লোক গোবিন্দ ,ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে রিক্সা ডাকতে যাচ্ছিলো।নাতবৌ এমিলি ,এসে দাঁড়িয়েছে। ঘুম ভাঙা মুখে একগাল হাসি।
“গুড মর্নিং দাদু -ঠাম্মা।” ভাঙা বাংলায় বললো সে।
বছর দুয়েক আগে ইংল্যান্ডেই অভির আর তার বিয়ের রেজিষ্ট্রেশনটা হয়েছিল, তার কিছুদিন পরে ওরা কলকাতায় এলে সামাজিক মতে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় । মধুসূদন বাবু আর প্রভাদেবী কলকাতায় গিয়ে সেই বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন। তখন এমিলি বাংলা বলা দূরে থাক, বুঝতেই পারতো না কিছু। এই দু বছরে সে যে শুধু বুঝতে পারে তাই নয় , কাজ চালানো গোছের বাংলা বলতেও শিখে নিয়েছে, এতে পরিবারের সবাই , বিশেষ করে প্রভাদেবী খুবই খুশি।
কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রান পড়ে গেছে , বাতাসে শিরশিরানি হাওয়া , কলকাতার তুলনায় এদিকে ঠান্ডাটা একটু বেশিই । এমিলিকে চায়ের পট আর কাপটা এগিয়ে দিয়ে, ঘর থেকে একখানা পাতলা শাল এনে প্রভাদেবী জড়িয়ে দিলেন তার গায়ে। আরাম পেয়ে এমিলি জড়িয়ে ধরলো ঠাম্মাকে।
রিক্সা এসে গেছে , মধুসূদন বাবু মানিব্যাগটা পকেটে পুরে এগোতে যাবেন এমিলি একচুমুকে চা শেষ করে চট করে এগিয়ে এলো ।
“আমিও যাবো ” আহ্লাদী সুরে বললো এমিলি।
“আরে না না , এইসব বাজার তোমার ভালো লাগবে না মোটেই। এখানে তো শহরের মতো মার্কেট প্লেস নেই , মাটিতে বসে কেনাবেচা চলে ,একে বলে হাট।”
“জানি । গুগলে ছবি দেখেছি ,আর তাই তো নিজের চোখে দেখে নিতে চাই।” বলল এমিলি।
মধুসূদন বাবু গাড়ি বের করতে যাচ্ছিলেন , এমিলি বাধা দিলো—
“আরে আমি তো মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছি , তোমরা এগোও , আমি ধীরেসুস্থে সব দেখতে দেখতে যাবো।”
অভিটা এখনও ঘুমোচ্ছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায় এমিলিকে একা ছেড়ে দিতে,মন ঠিক সায় দিচ্ছিল না মধুসূদন বাবুর তবে দূরত্ব খুব একটা বেশি নয় , বলে রাজি হয়ে গেলেন ।
এমিলি তৈরি হয়ে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লো। পেশায় সে একজন নামকরা ফোটো জার্নালিস্ট।এই দেশটাকে একটু কাছ থেকে জানার একটা প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
চারপাশটা দেখতে দেখতে পথ হাঁটছিলো এমিলি ।কুয়াশা কাটিয়ে রোদ উঠেছে , ঘাসে ঘাসে শিশিরের ফোঁটায় হীরের ঝলকানি , গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে লোকজন চলেছে হাটের পথে । খেজুর গাছে , রস সংগ্রহের জিরেন কাটের হাঁড়ি , তালগাছে বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে , অবাক বিস্ময়ে এইসব দেখতে দেখতে পথ হাঁটছিলো এমিলি। মাঝে মাঝে পথচলতি মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে কৌতুহল মিটিয়ে নিচ্ছিলো সে ।
সামনের সপ্তাহে যাত্রা আসছে , ঘোষকের ছড়ানো লাল হলুদ কাগজ সংগ্রহ করতে ছুটে আসছে বাচ্চারা ,ঠিক যেন একঝাঁক উড়ন্ত প্রজাপতি।
সে যতক্ষণে হাটে পৌঁছলো , দাদুর বাজার করা শুরু হয়ে গেছে।রোদ ঝলমলে বাজারটা যেন উজ্জ্বল রঙে আঁকা চমৎকার একখানা ছবি। কোথাও বাঁশে দড়ি বেঁধে রঙ বেরঙের নকশা কাটা গরম চাদর ঝুলছে , কোথাও আবার গোছা গোছা কাঁচের চুড়ি । ওপাশে বাঁশিওয়ালা সুর তুলেছে । বাচ্চাদের খেলাধুলো ছোটাছুটি ,এ যেন চমৎকার একখানা কার্নিভাল। এমিলি চটপট বেশ কয়েকখানা ছবি তুলে নিলো। তারপর মনের আনন্দে কাঁচের চুড়ি, মাটির তৈরি খেলনা বাটি, গোটাকতক বাঁশের বাঁশি সহ আরও কিছু পছন্দসই জিনিসপত্র সংগ্রহ করে নিয়ে এগিয়ে গেল দাদুর কাছে। ওজন করার দাড়িপাল্লার অভিনবত্ব অবাক করছিল তাকে।
বাড়ি ফিরে এসে দেখলো অভি তখনও বিছানা ছাড়ে নি। ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে আদর খাচ্ছে। মুচকি হেসে এমিলি সরে যাচ্ছিলো , ঠাম্মা ডেকে বললেন–” দেখ তো পাগল ছেলের কান্ড , আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে, ছাড়তেই চাইছে না , সেই ছেলেবেলার মতো। পুরনো দিনের সব গল্প, ছেলে বেলার খেলার সাথীদের খোঁজ খবর, সব কিছুই বলতে হবে এখন। কবেকার কথা সে সব, কিচ্ছু ভোলে নি ।”
“ভুলবে কী করে ঠাম্মা !শিকড় ভুলে গেলে গাছের মতো মানুষও যে নীরস, নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রোদভাসি উঠোনে , খাটিয়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছিলো এমিলি।তার দেশের শীত, কঠোর ,রুক্ষ নিষ্প্রাণ , এমন আদুরে শীতের ঊষ্ণতা আগে কখনো উপভোগ করে নি সে। উঠোনে একটা কাঠবিড়ালি নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করছিলো, ওপাশে গোবিন্দর বাচ্চা মেয়ে ফুলি,গাছের পাতা আর নুড়িপাথর দিয়ে,সদ্য উপহার পাওয়া খেলনাবাটির সংসার পেতে বসেছে। এমিলি আবারও অনুভব করলো , প্রকৃত আনন্দ , নিজেই নিজেকে নিয়ে সম্পূর্ণ। উপকরণের মূল্য দিয়ে আনন্দের পরিমাপ করা যায় না।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে। ফুলি খেলা থামিয়ে তার হাত ধরে ছাদে নিয়ে যায় সূর্যাস্ত দেখাতে। চারপাশ অস্তরাগে রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যায়, নদীর জলে তার ছায়া।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। অজস্র মণিমুক্তো দিয়ে সাজানো নিটোল একটা দিন সে আজ উপহার পেলো।
হৈ হৈ করে কেটে যায় দিন। ঠাম্মার কাছে রান্না শেখা , ভোরবেলা গ্রামে গিয়ে খেজুর রস খাওয়া, সারা দুপুর মাঠে ঘাটে ধুলো মেখে টৈ টৈ,খেত থেকে কোঁচড় ভরে মটরশুঁটি তুলে নদীর ধারে বসে খাওয়া,অভি তাকে খেজুর পাতার বাঁশি বানিয়ে দিলো —অনন্য সব অভিজ্ঞতা, তারপর একদিন সন্ধ্যা নামলে নদীর ওপারে যখন রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে ,অভি কী যেন একটা কবিতা বলছিলো ‘আবার আসিবো ফিরে —‘গলা ধরে আসছিল তার ।এ কোন অভি , আবার নতুন করে তার প্রেমে পড়লো সে।
খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল ছুটির মেয়াদ।
যাবার দিন নিজের বিয়ের বেনারসীখানা এমিলির হাতে দিয়ে বললেন,” যদি আর দেখা না হয়!” ঠাম্মার চোখে জল। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে এমিলি বলে “কেঁদো না , আমি আবার আসবো ,আমাকে তো আসতেই হবে , ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে না! Yes I am carrying কাউকে বলিনি , তোমাকেই বলে গেলাম , শিকড়ের কাছেই অঙ্কুরের খবরটা সবার আগে দিতে হয় তো!”
গাড়িতে যেতে যেতে এমিলি মনে মনে ভাবছিলো একটা
কবিতার লাইন —“Thank you for giving me roots ,to stay grounded ,and the wings to fly .”