প্রীতিভোজ
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
এই ধরুন গিয়ে আপনারা যেসব মেনু চাইছেন তাতে প্লেট পিছু আটশো টাকা মিনিমাম পড়বে।
টাকার অঙ্কটা শুনে মোহিত সন্তোষ ক্যাটারের উদ্দেশ্যে বলে, না না প্লেটের রেটটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।
সন্তোষ ক্যাটারার বলে- খাসীর মাংস, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, ইলিশ ভাপা আর আলু পোস্ত এইগুলোর জন্য কাঁচামালটা কিনতেই বাজেটটা বেশি পড়ে যায়। তাহলে এক কাজ করুন আলু পোস্তটা বাদ দিয়ে দিন।
পাশেই ছিল মোহিতের ঠাকুমা বীনা দেবী। বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি করে হাত নেড়ে বলে, ভুলেও মুখে এনো না আলু পোস্ত বাদ দেওয়ার কথাটা। আমরা হলাম গিয়ে বর্ধমানের আগুড়ি। আমাদের বাড়ির যে কোনো অনুষ্ঠানে আলু পোস্ত হবেই।
মোহিত মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ঠিক আছে ঠাকুমা তাই হবে। তোমার নাতির বিয়েতে তুমি আলু পোস্ত খাবে না তাই হয় না কি!
এতক্ষণ একটা প্ল্যাস্টিক চেয়ারে বসে খাতা পেন নিয়ে নিমন্ত্রিত অতিথিদের একটা লিস্ট বানাচ্ছিলেন মোহিতের বাবা প্রবীর বাবু। উনি গম্ভীর স্বরে মোহিতের ঠাকুমার উদ্দেশ্যে বললেন, মা এবার মনোযোগ দিয়ে লিস্টটা শোনো। দেখো তো কোনো আত্মীয় স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশী বাদ পড়ে গেল নাকি।
বীনা দেবী মন দিয়ে শুনে চলেছেন ছেলের তৈরী নিমন্ত্রিত অতিথিদের নাম।লালু, ভোলা, দুলু, অয়ন, গোপাল, ভজু এইসব নাম শুনে চমকে উঠে বললেন, ওরে খোকা এরা কারা? এরা কি আমার দাদুভাই এর বন্ধুরা?
প্রবীর বাবু বললেন, তোমার নাতি যে দেড়শোটা নামের লিস্ট দিয়েছে তাদেরই নাম পড়ছি।
বীনা দেবী কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করে মোহিতকে, হ্যাঁ দাদু ভাই তোমার অফিস তো দিল্লিতে। সেখান থেকে কি দেড়শো বন্ধু বান্ধব আসছে? আমি যতদূর জানি পাড়াতে তোমার বন্ধুবান্ধব বেশি নেই।
মোহিত বলে, এই দেড়শো জন আমার ঠিক বন্ধু নয়। তবে এদেরকে খাওয়ানোর খুব ইচ্ছা আমার আছে।
প্রবীর বাবু বলে সে তো ভালো কথা। কিন্তু এদের পরিচয়গুলো আমাদেরকে একটু দাও।
মোহিত একটু আমতা আমতা করে বলে, এরা হচ্ছে সকলেই ‘আশ্রয়’ এর সদস্য।
বীনা দেবী নামটা শুনে চমকে উঠলেন। ওনার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা লম্বা বিল্ডিং এর ছবি। গত বছর পূজার সময় মোহিত আর তার মা সুনন্দা গিয়ে ছিল নতুন জামা কাপড় নিয়ে। পরেরদিন খবরের কাগজে বেরিয়েছিল খুব ছোট্ট করে এই খবরটা। বীনা দেবী কাঁচি দিয়ে কেটে রেখেছিল আশ্রয় অনাথ আশ্রমের ছবিটা।আর আঠা দিয়ে সযত্নে চিটিয়ে রেখেছে ওনার পুরানো পেপার কাটিং এর অ্যালবামে।
আজ নাতির কথা শুনে চোখের সামনে ভেসে উঠলো আশ্রয় নামক অনাথ আশ্রমের ছবিটা। বীনা দেবী তার ফোকলা দাঁতে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, এতো খুব ভালো সিদ্ধান্ত দাদু ভাই। তুমি অনাথ ছেলে মেয়েদেরকে খাওয়াতে চাও। কিন্তু আমাদের অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে ওদেরকে খাওয়ানো যাবে তো?
মোহিত বলে, এই জন্য আমি একটা প্ল্যান ভেবেছি। তোমরা যদি শুনতে চাও তাহলে খুলে বলতে পারি।
বীনা দেবী বলে, তুমি নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে বলতে পারো। তোমার বাবা কিচ্ছুটি বলবে না।
মোহিত প্রবীর বাবুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, আমি ভাবছিলাম আমাদের পারিবারিক আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য প্যাকেটের ব্যবস্থা করা হোক।
প্রবীর বাবু ভ্রু কুঁচকে বলে, সে আবার কি কথা। আমন্ত্রিত অতিথিদের পাত পেড়ে না খাইয়ে হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেবো। আশ্চর্য কথা!
মোহিত তার বাবার কথার উত্তর না দিয়ে উঠে যায়। এই দেখে প্রবীর বাবু আরো রেগে যান। বীনা দেবীর উদ্দেশ্যে বলে, তোমার প্রশয়ে কিন্তু ছেলেটা এমন মেজাজী হচ্ছে দিনদিন। দেখলে কেমন করে উঠে চলে গেল।
প্রবীর বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই মোহিত ফিরে আসে। হাতে একটা পুরানো অ্যালবাম। প্রবীর বাবুর পাশে এসে বসে। তারপর বেশ কতগুলো পাতা উল্টে একটা ছবি বের করে। ছবিটাতে দেখা যায় প্রবীর বাবুর বোন, ভগ্নিপতি ও তাদের ছেলে মেয়েকে। খুব সম্ভবত ছবিটা প্রবীর বাবুর ভাইয়ের বিয়ের। ওরা চারজনে একটা টেবিলে খাচ্ছে। মাঝখানে যে নোংরা ফেলার বাটিটা আছে তা পুরোপুরি ভরে আছে খাবারে।
মোহিত ওর বাবাকে বলে, দেখছো বাবা পিসিমনিরা কিভাবে খাবার নষ্ট করছে। এই ছবিটাতে শুধু পিসিমনিদের দেখতে পাচ্ছি। এইরকম খাবার নষ্ট কিন্তু আমরা প্রতিটা টেবিলেই কম বেশি দেখতে পাই।
প্রবীর বাবু বলে, সে আর কি করা যাবে। অনুষ্ঠান বাড়িতে তো খাবার দাবার একটু নষ্ট হবেই।
মোহিত খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, এতো খাবার কেন নষ্ট হয় জানো? আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত মেনুর ব্যবস্থা করি। একবারে বসে খুব কম মানুষ আজকাল দশ রকমের পদ খেতে পারে। কিন্তু নানা রকম পদের ব্যবস্থা থাকার কারণে সব পদগুলোর স্বাদ আস্বাদন করতে গিয়ে আমরা একটু একটু করে টেস্ট করে বাকি খাবারগুলো ফেলে দিই। একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো বাবা আমরা অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে কত খাবার নষ্ট করি এই দুর্মূল্যের বাজারে। কিন্তু তুমি যদি আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সামান্য স্টার্টাড এর আয়োজন করো। তাহলে তারা গল্প করতে করতে সামান্য খাবারটুকু খেয়ে নিতে পারবে। আর তারা যখন বাড়ি ফিরে যাবে তাদের হাতে তুলে দেবো খাবারের প্যাকেট খানা। তারা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাদের পেটের চাহিদা মতো আরাম করে বসে খাবে। এতে খাবার নষ্ট অনেকখানি কম হবে। আর অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের আমরা প্যান্ডেলে চেয়ার টেবিলে বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়াতে পারবো যথেষ্ট সময় ধরে।
প্রবীর বাবুর খুব একটা মন্দ লাগে না মোহিতের প্রস্তাবটা। বীনা দেবী এবং মোহিতের মা’ও বিষয়টাকে সমর্থন করে।প্রবীর বাবু সন্তোষ ক্যাটারারকে বলে, শুনলেন তো ছেলের প্রস্তাবটা।
তাহলে আপনি অতিথিদের জন্য দু’ তিন রকমের স্টার্টাড রাখুন। সঙ্গে চা, কফি, ককটেল মকটেল যা যা আছে তার ব্যবস্থা করুন। আর দুশো প্যাকেট মেন কোর্স থালির আয়োজন করুন। আর দেড়শো প্লেটের খাবার এখানে বসে খাবে তার ব্যবস্থা করুন।
সন্তোষ ক্যাটারার সব শুনে বলে, এই রকম ধরনের বিয়ে বাড়ির আয়োজন আমি প্রথম পেলাম। তবে চিন্তা ভাবনাটা কিন্তু ভীষণ যুগোপযোগী। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যেকের খেয়াল রাখা দরকার যেন খাবার দাবার নষ্ট না হয়। আমাদের আনন্দ ফুর্তির মাঝে খানে অবশ্যই মনে করা দরকার সেই সব নিরন্ন মানুষের কথা। যারা দুবেলা পেটপুরে খেতে পায় না আজও। অনাথ শিশুদের পাশে বিভিন্ন সমাজ সেবী সংগঠনগুলো এগিয়ে এসেছে বলেই তারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়। তবে মাটন, বিরিয়ানি, ইলিশ এইসব দৈবাৎ জোটে তাদের কপালে।
প্রবীর বাবুকে অনুনয়ের সুরে সন্তোষ ক্যাটারার বলে, আমারও বড় শখ হচ্ছে আপনার ছেলের মতো অনাথ শিশুদের খাওয়াতে। আসলে সৎ সঙ্গ, সৎ কর্ম এইসবও কিন্তু বেশ ছোঁয়াচে বুঝতে পারছি। আপনার ছেলের বিয়ের প্রীতিভোজের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা অনেক দিন আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা মনে রাখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।