অমূল্য স্মৃতি
-অঞ্জনা গোড়িয়া
সত্যিই কিছু বলার ভাষা নেই। কিছু করার ছিল না। সারাজীবন একটা আফসোস থেকে গেল। আর দেখা হলো না।
একবার আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন অথবা আমারও দেখার ইচ্ছে ছিল খুব। কিন্তু দেখা হয় নি। দেখা করতে পারি নি। বড়ো আফশোস থেকে গেল জীবনে। কেন দেখা করলাম না! কেন একবার দেখতে গেলাম না। সেই সোনা মাটির দেশে। যেখানে সুন্দর একটা স্কুল গড়েছেন। পথের মাঝে সারি সারি গাছ বসিয়েছেন। সবুজে সবুজে ভরিয়ে রেখেছেন।
সেই সুন্দর এলাকাটা আর আমার সেই প্রিয় দাদাকে আর দেখা হলো না।
শেষ বার কথা হয়েছিল যখন উনি কলকাতার টাটা হসপিটালে ভর্তি। নানান পরীক্ষা আর কেমো চলছে।
অনেক দিন থেকেই দাদার সাথে ফোনে কথা হতো। ওনার কাজকর্ম শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। আমাকে একবার যেতে বলেছিলেন ওনার সুন্দর সাজানো সেই কাজরীতে। কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বড়ো আফশোস থেকে গেল।
অনেক দিন ফেসবুকে দেখতে না পেয়ে মনটা খচখচ করছিল। একদিন সকালে ফোন করেই ফেললাম। আমার সেই ফেসবুক দাদাকে। ফোনের ওপার থেকে বলে উঠলেন, আমি ওনার ছেলে বলছি। বাবা আর বেঁচে নেই। আপনি অঞ্জনাদি?
আমি বললাম, হ্যাঁ। ছেলে বললো, আপনার কথা খুব বলছিলেন বাবা। একদিন নাকি দেখতে আসবেন। বাবা আর নেই। গত সপ্তাহে মারা গেছেন।
ফোনটা রেখেদিলাম। কিছু বলার ভাষা নেই। চোখদুটো আবছা হয়ে আসছে। আর দেখতে পাচ্ছি না। ভেসে উঠছে সেই হাসি হাসি মুখটা।
কেন এমন হয়? চেনা মানুষগুলো এভাবে কেন হারিয়ে যায়?
ফেসবুক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তার মধ্যে এই ভালো দাদাকে পেয়েছিলাম। আমাকে প্রথম সম্ভাষণ করেছিলেন “বোন” বলে। কী যে ভালো লেগেছিল। নম্র ভদ্র রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার মশাই।
নামটা আর নাই বা বললাম। জানি না কেন আমাকে খুব পছন্দ করেছিলেন। আমার লেখা, আমার কাজ, আমার কথা নাকি দাদার খুব ভালো লাগে। একদিন পরিচয় করে আসতে চেয়েছিলেন আমার বাড়ি কিংবা আমার স্কুল।
কিন্তু আনতে পারিনি সেই দাদাকে। লোকে ‘গাছদাদু” বলে ডাকে।
গাছ পাগল এক দাদা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জীবনের সমস্ত টাকা ব্যয় করেছেন বীরভূমের সিউড়িতে। গাছ বাঁচাও গাছ লাগাও। সিউড়ির কাজরীতে পথে পথে গাছের সারি। আর এখানকার ছোটোদের নিয়ে মেয়েদের নিয়ে গড়ে গেছেন একটা স্কুল।
নাচ গান ক্যারাটে লেখাপড়া আরও অনেক কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এখানকার মানুষের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। প্রতিদিনই একবার করে কথা হতো। মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলাম একদিন নিশ্চয় যাবো দেখতে। কিন্তু আর যাওয়া হয় নি।
যেখানেই থাকো দাদা, ভালো থেকো। আর এই বোনটাকে ক্ষমা করো। নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কে সেই দাদা? কী তাঁর নাম?
আমার সেই “গাছদাদু” আমার ভালো দাদার নাম উজ্জ্বল রায়। একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ওখানকার আনন্দবাজার পত্রিকায় ওনার নাম বারেবারেই প্রকাশিত হয়েছে।
প্রণাম দাদা। এভাবেই ফেসবুক অনেককেই আপন করে দেয়, আবার অনেককেই নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলি। তখন কেন এত কষ্ট হয়? কেন?