প্রতিবেদন

প্রতিবেদন- জীবনপুরের পথিক

জীবনপুরের পথিক
-সুমিতা দাশগুপ্ত

 

 

জীবনপুরের পথিক বিশেষণটি যদি কারো জন্য সুপ্রযুক্ত হয়ে থেকে থাকে তবে তা হল সাতাশি বছরের তরুণ মানুষটির জন্যে, এই বয়সেও জীবন সম্পর্কে যাঁর আগ্রহ, কৌতূহল, সৃষ্টিশীলতা অবাক বিস্ময়ে অনুভব করে সমগ্র জগৎ।
জীবন তাঁকে দিয়েছে অনেক কিন্তু কেড়েও নিয়েছে প্রচুর।

জীবনের শুরুটা ছিল আরও পাঁচটি শিশুর মতোই। উনিশশো চৌত্রিশ সালের পরাধীন ভারতে তাঁর জন্ম। বৃটিশ বংশোদ্ভূত পিতা, মাতার সন্তান, শিশুটির ছেলেবেলা অতিবাহিত হয়েছে জামনগর এবং সিমলায়। আর পাঁচটা শিশুর মতোই দিব্যি হেসে খেলে বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় আনন্দে কাটছিলো ছেলেবেলার দিন, কিন্তু ভাগ্য যে তার জন্য লিখে রেখেছিল এক অন্য গল্প। টের‌ও পায়নি কখন যেন বাবা মায়ের সম্পর্কে ধরেছে চিড়। ক্রমশ বাড়তে থাকলো ফাটল। অবশেষে ঘটে গেল বিচ্ছেদ, উপরন্তু মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিল শিশুটির শৈশব।
অতঃপর বাবার হাত ধরে জীবনপথে যাত্রা শুরু। বাবা-ই তার একমাত্র বন্ধু পথপ্রদর্শক।
বাবার সঙ্গেই কাটে দিন। পড়াশোনার ফাঁকে বাবার হাত ধরেই প্রকৃতির পাঠ নেওয়া শুরু। জঙ্গলের পশুপাখি বৃক্ষলতা সব‌ই হয়ে ওঠে পরমাত্মীয়। এর‌ই মাঝে ধীরে ধীরে, গড়ে উঠছে অবসর সময়ে গল্পের ব‌ই পড়ার এক অদম্য নেশা, এ-ও বাবার কাছে থেকেই পাওয়া উত্তরাধিকার।
কিন্তু জীবন তো আর সবসময় এক‌ই খাতে বয় না ।
বাবার বদলির চাকরি। এবারে তাদের প্রকৃতির কোল ছেড়ে চলে যেতে হলো দিল্লীতে।
সপ্তাহের অন্যান্য দিন বাবার অফিস, তার স্কুল। ছুটির দিনে বেড়ানো, থিয়েটার দেখতে যাওয়া, গান শোনা। অজস্র রেকর্ড কিনে আনেন বাবা। তাই নিয়ে দিব্যি কাটে দিন। পরিকল্পনা হয়, ভবিষ্যতে বিলেতে পাড়ি দেবার।

বাবার বদলির চাকরি। হঠাৎ কলকাতায় বদলি হতে হলো। আপাতত সিমলায় বিশপ কটন স্কুলে বোর্ডিং স্কুলেই ভর্তি করে দিলেন বাবা। প্রতি সপ্তাহে বাবার চিঠি আসে। পরম সম্পদের মতো সেগুলো আঁকড়ে ধরে রাখে বালক। এতেই মেলে বাবার সাহচর্য।
কিন্তু আবার‌ও ঘটলো ভাগ্যবিপর্যয়। আচমকাই তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাবা। স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় হারিয়ে গেল তার জীবনের একমাত্র মহার্ঘ্য সম্পদ, বাবার লেখা চিঠির তাড়া। পরিপূর্ণ হয়ে গেল নিঃস্বতার মাত্রা।
এবার তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গিয়ে পড়লো কখনও ঠাকুমা কখনও বা তার মা আর সৎ বাবার উপর। না, তাঁরা এড়িয়ে যান নি, তার খাওয়া পরা, পড়াশুনার সব দায়িত্ব নিয়েছেন কিন্তু, মনের দায় নেয় কে? নিঃসঙ্গ শিশুটির সঙ্গী হলো প্রকৃতি আর কিছু গল্পের বই। ঈশ্বর বুঝি পারিবারিক গন্ডীর আওতা ছাড়িয়ে, তাকে দিয়ে দিলেন বিশ্ব নিখিলের অধিকার।
নিঃসঙ্গ বালক একা একা পথ পথ হাঁটে বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে। চেনা হয়, পশু পাখি, জানা হয় মানুষকে। অচিরেই বন্ধু জুটে যায়। ভবঘুরে কিশোর, ফল‌ওয়ালা, ভিক্ষুক, জীবনযুদ্ধের সৈনিক একা ফেরিওয়ালা। ক্রমাগত সমৃদ্ধ হতে থাকে অভিজ্ঞতার ঝুলি। বই পড়ার নেশা তো ছিলই। এই দুইয়ে মিলে কিশোর মনে জন্ম নেয় লেখালেখির নেশা। পড়াশুনার ফাঁকে শুরু হলো লেখালেখি। মাত্র ষোল বছর বয়সে লেখা হয়ে গেল, সাড়া জাগানো গল্প- untouchable কিছুদিন পর আত্মজীবনীমুলক উপন্যাস- The room on the roof জিতে নিল বৃটিশ সরকারের মর্যাদাপূর্ণ J.L.R. পুরস্কার।
বিশপ কটন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনায় সে পাড়ি দিয়েছিল ইংল্যান্ডে। কিন্তু তার যে মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে ভারতবর্ষের সেই ছেলেবেলার শহর। মনে অনুক্ষণ ভাবনা কী করে ফেরা যায়!
ইংল্যান্ডে বসবাস কালে চাকরির পাশাপাশি লেখালেখিও চলছিলো সমানতালে । সঙ্গে জুটলো ফটো স্টুডিওর কাজ। এতেও কিছু কিছু রোজগার হতে থাকলো। সব জমা হতে থাকে দেশে ফেরার প্যাসেজ মানি জোগাড় করতে। সেই টাকা জমতেই দেশে ফেরার জাহাজ ধরলো সে। মানুষের সংসর্গ যে বড্ডো প্রিয় তার। ততদিনে স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, লেখালেখিই তার ভবিতব্য, এ ছাড়া অন্য কিছুই তার পেশা হতে পারে না। মনের আনন্দে চলতে থাকে তার লেখনী। লেখা হতে থাকলো অজস্র গল্প, উপন্যাস। পাঠক মহলে সাড়া ফেললো সেই সব। Penguin Publishers বরাত দিলো, তাদের জন্য ছোট গল্প লিখতে, ক্রমশঃ জুটতে লাগলো পুরস্কার। বিখ্যাত গল্প THE BLUE UMBRELLA নিয়ে তৈরী হওয়া সিনেমা, রাতারাতি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেল তাঁকে। সাহিত্য একাডেমী, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ কী নেই তাঁর ঝুলিতে! সম্প্রতি সাহিত্য একাডেমী তাঁকে ফেলোশিপ দিতে পেরে নিজেরাই নিজেদের ধন্য মনে করেছেন।
বৃটিশ বংশোদ্ভূত, সাতাশি বছরের এই ভারতীয় লেখকটি আজ‌ও সমান দাপটে বিচরণ করছেন সাহিত্যের সাম্রাজ্যে।
অকৃতদার এই মানুষটির বর্তমান ঠিকানা মুসৌরির আইভি কটেজ। সেখানে তিনি বসবাস করছেন তাঁর ‘এক্সটেন্ডেড ‘ পরিবারের সঙ্গে।
এককালের স্নেহকাঙাল নিঃসঙ্গ বালকটি আজ দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষের নয়নমণি, বিখ্যাত লেখক রাসকিন বন্ড। ভাবলে অবাক লাগে এভাবেও ফিরে আসা যায়! নাকি এভাবেই ফিরে আসতে হয়!

Loading

One Comment

  • Anonymous

    কত প্রতি বন্ধকতা, কত পথ পেরিয়ে আজ প্রতি ষ্ঠিত লেখক রাস্কিন বন্ড। তাঁর জীবনের অনেক চড়াই উতরাই এর সত্যি গল্প জেনে খুব ভালো লাগলো।

Leave A Comment

You cannot copy content of this page