রক্তের রঙ নীল
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
– মদন, নলেন গুড় পেলি?
-মাথাটা গেছে দেখছি। বোশেখ মাসে নলেন গুড়?
-ও হ্যাঁ, তাও তো বটে। যাক গে কী আনলি আখের গুড়?
-হ্যাঁ
-ধুস, কী কাজে আসবে ওটা;
-রুটি দিয়ে খাবে। শোনোনি, “মার গুড় দিয়ে রুটি”
-থাম হতভাগা। সেটা আখের গুড় নয়।
-কোথাও লেখা নেই।
-সবকিছু লেখা থাকে না। বুঝে নিতে হয়।
-পরোটা চলবে?
-হ্যাঁ, সেটা মন্দ নয়।
-অম্বল হলে আমাকে দুষবে না। আগে থাকতে বলে রাখলুম। মনে থাকে যেন।
-কতটা এনেছিস?
-এক পোয়া।
-এইটুকু, কী হবে ওতে?
-খাবো তো দুজন, এক ক্যানেস্তারা আনবো?
-কাল বাজার থেকে একটা তাল আনবি।আখের গুড় দিয়ে তাল খাবো।
-আবার সেই বেতালা কথা। বোশেখ মাসে তাল হয়? আমের আচার চলবে? ঘরে দুটো কাঁচা আম আছে ।
-চলবে মানে, হৈ হৈ করে চলবে। সঙ্গে পরোটা। খাবার পরে দুটো এন্টাসিড দিতে ভুলবি না। তাহলে কিন্তু অম্বল হলে তোর দোষ, মনে থাকে যেন। হ্যাঁ রে, অনেকদিন অরবিন্দ আসে না। দেখা হয় ওর সঙ্গে?
-সত্যি বাপু, তোমাকে নিয়ে তো আর পারি না।
-কেন, কী করলাম, আমার ছোটবেলার বন্ধু, তার খোঁজ খবর নেবো না; সেটাও দোষের! এতো আচ্ছা মুশকিল। এরপর মনে হচ্ছে তোকে কিছুই আর জিজ্ঞেস করা যাবে না। -সত্যি করে বলো তো, তোমার মাথার ঠিক আছে তো?
-কেন, কেন থাকবে না? যথেষ্ট ভালো আছে। অন্তত তোর চাইতে ভালো আছে।
-ছাই আছে আর পিন্ডি আছে। সব ভুলে মেরে বসে আছে, ওনার নাকি মাথার ঠিক আছে? এই সেদিন বললুম, তোমার বন্ধু অরবিন্দ বাবু মারা গেছে। কাঁচ ঢাকা গাড়ি করে শ্মশানে নিয়ে গেল। বাজার থেকে ফেরার সময় দেখলুম। মনে নেই ?
-ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ, তা-ই তো। মরে গেছে বেচারি। আসলে কী জানিস অনেক দিনের বন্ধু কি না, তাই ওর অমন চলে যাওয়াটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। অবিশ্যি ক্যান্সারের পেশেন্ট ছিল কি না। বড্ড ভুগলো বেচারা। তবে ওর অন্যদিকে কপাল ভালো। ছেলে মেয়ে জামাই সব্বাই খুব চেষ্টা করেছে। কী বল, কি রে ভুল বলছি ?
-সব্বাই আছে তাই করেছে। করেছে মানে তদবির তদারক করেছে। গাঁটের পয়সা তো কাউকে খরচ করতে হয়নি। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো। অরবিন্দ বাবু অঢেল রেখে গেছে। সবই তো ওরাই ভোগ করবে, সেটা বলো।
-তোর মন খুব নিচু। ওরা অঢেল পাবে সেইটা চোখে পড়লো। ওদের সেবা যত্ন চোখে পড়লো না।
-চা খাবে, সন্ধ্যে ছ’টা বেজে গেছে।
-খাবো,
-বিস্কুট না-কি মুড়ি?
-অমন মুখ গমড়া ক`রে বলছিস কেন, রাগ করলি?
– নাহ, ভাবছি,
-কী?
-আমি না থাকলে তোমার কী হতো, কে দেখাশোনা করতো তোমার?
-এখন কে করছে? এখন যে করছে সেইই করতো। আরে বাবা এটাই ভবিতব্য। ললাট লিখন। এসব আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। কেউ খণ্ডাতে পারবে না। বিধিলিপি।
-বিয়ে করোনি কেন? তোমারও ভরা সংসার হতে পারতো। বউ, ছেলেমেয়ে, বৌমা, নাতি নাতনি। কোলকাতার বুকে এতবড় বাড়ি, টাকা। নবাব পুত্তুর পাত্র। কিসের অভাব তোমার?
-হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। এই সত্তর বছর বয়সে, যা যা, চা নিয়ে আয়।
-আবার বাজে বকে, এখনের কথা হচ্ছে না। সময় কালের কথা বলছি।
-সত্যি কথা শুনবি, ভয়ে করিনি।
-কিসের ভয়?
-মেয়েদের আমার খুব ভয়। সেই ছোটবেলা থেকেই।
-কেন?
-তখন আমি খুব ছোট বুঝলি। বিশাল বাড়ি। অনেক লোকজন। যৌথ পরিবার। হঠাৎ শুনলাম, ঠাকুর্দা মারা গিয়েছেন। যেতেই পারেন, বয়স হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরে কানাঘুষো শুনতে পেলাম, আমার ঠাকুমাই নাকি বাড়ির চাকরানিকে গয়না দেবার লোভ দেখিয়ে সরবৎ এ বিষ মিশিয়ে দিয়ে ছিলেন।
বোঝ একবার! নিজের স্বামীকে লোক দিয়ে খুন করে দিলো।
-সর্বনাশ, তারপর!
-বড়ো বাড়ির ব্যাপার। লোক জানাজানি হলে পরিবারের মুখ পুড়বে। তাই সব ধামাচাপা।
-ওরে বাপরে, বলো কী। এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার। কিন্তু কেন?
-সেটা আজও সঠিক জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি, ব্যাপারটা মহিলা ঘটিত।মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে, কিন্তু নিজের স্বামীকে অন্য স্ত্রী লোকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবার অসম্মান সহ্য করতে পারে না।
-পরকীয়া কেস?
-অনেকটা তেমনই। যতদূর শুনেছি, ঠাকুর্দার স্বভাব চরিত্রে বেশ গোলমাল ছিল। নিজের শালী অল্প বয়সেই বৈধব্য পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। ওনার স্বামীকে না কি কে বা কারা যেন একটা বাগানবাড়িতে বাঈজী নাচের আসরের টোপ দিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করে ছিল। অনেকেরই সন্দেহ ছিল এ কাজ আমার ঠাকুর্দার। ঠাকুমা শুধু খুবই দজ্জাল প্রকৃতির ছিলেন এমন নয়, যথেষ্ট বুদ্ধিমতী একরোখা সাহসীও ছিলেন। এখানেই শেষ নয়। আরও আছে সব বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। আবার ওদিকে আমার বাবা মা’য়ের ব্যাপারটাও বেশ রহস্যময়।
-কী রকম?
-সেবার মহালয়ার দিন আমাদের দুই ভাইকে মামার বাড়ি বর্ধমানে পাঠিয়ে দিলো মা।
তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি আর ভাই এইটে। ভাবলাম ভালই হলো। পুজো মামার বাড়িতে কাটাবো। পুজো হয়ে গেল। সেদিন বিজয়া দশমী। প্রতিমা বিসর্জ্জনের আয়োজন চলছে। এমন সময় রামলাল দাদা, আমাদের বাড়ির পুরনো কাজের লোক এসে, আমাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো।
-কেন, হঠাৎ?
-আমাদের দুটো বাড়ি, জানিস তো। একটা এইটা। এই বাগবাজারে,
-আর একটা ভবানীপুরে। যেটাতে তোমার ভাই থাকে।
-ঠিক । আশ্চর্যের ব্যাপার দ্যাখ, মা আর বাবা দীর্ঘদিন যাবৎ আলাদা থাকতেন।
বাবা এই বাড়িতে, মা ভবানীপুরের বাড়িতে। মানে উত্তর আর দক্ষিণ। বোঝাই যাচ্ছে দুজনের মধ্যে মিলমিশ মোটেই ছিল না।
-কেন দোষ কার?
-দোষ নীল রক্তের।
-বুঝলুম না।
-বাবা হঠাৎ করেই খুব ঘনঘন বেনারস যাওয়া শুরু করেছিলেন। নানান অছিলায়। আসলে, পরে জানতে পেরেছিলাম, ওখানের এক নামজাদা সুন্দরী বাঈজির প্রেমে পড়েছিলেন। মানে, হাবুডুবু বলতে যা বোঝায়। সেখানেই দেদার টাকা ওড়াচ্ছিলেন।
মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে বাবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন।
তাতে ফল হলো উল্টো।
বাবা আরও বেপরোয়া লাগামছাড়া হয়ে গেলেন। দু’হাতে টাকা ওড়াতে শুরু করলেন সেখানে।
মা বুঝলেন এইভাবে চললে পথে বসতে হবে। ছেলে দুটোর কী হবে ?
তখনই নিয়েছিলেন সেই সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত।
বাবাকে ভবানীপুরের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। সেদিন দুর্গা নবমী। নিজের হাতে মাংস লুচি খাওয়াবেন বলে। সে এক ভয়ংকর দিন। বাবা নতুন পোশাকে সাজগোছ করে উপস্থিত হলেন সেখানে। মা পরিপাটি করে নিজের হাতে পরিবেশন করে বাবাকে খাওয়ালেন। বাবার তখন খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখনই ঘটলো সেই বীভৎস ঘটনা। খাবার ঘরের মধ্যেই মা নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে বাবাকে সজোরে জড়িয়ে ধরলেন। আর ছাড়লেন না। আলিঙ্গন বদ্ধ দুটো ভালোবাসাহীন সম্পর্কের দেহ দাউদাউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
-ইসস, কী ভয়ানক,
-এই, পরোটা করবি কখন, কটা বাজে হুঁশ আছে?
-চারটি তো মোটে পরোটা। ও আর কতক্ষণ। আরম্ভ করলেই শেষ। তাছাড়া একটু দেরী করেই করবো। গুড় দিয়ে খাওয়া কি না, গরম গরম না হলে ভালো লাগবে না।
আচ্ছা একটা কথা বলছি, রাগ করো না।
-রেগে যাবার মতো হলে রাগ হবে, বল।
-রাগ ছাড়া আর কী করতে পারো বলো তো!
-আসল কথা বলে ফ্যাল,
-ময়ূরাক্ষীর কথা তোমার মনে আছে?
-হঠাৎ একথা কেন?
-ও তোমাকে সত্যিই ভালবাসতো গো।
-আমি এখনো বাসি। তাতে কী!
-ও কে কি তোমার বিয়ে করা উচিৎ ছিল না? দুজনেই দুজনকে ভালোবাসলে অথচ কোনও পরিনতি পেল না।
-পরিনতি মানে? বিয়ে? ঘরসংসার ছেলেপুলে অসুখবিসুখ এইটা-সেইটা মনকষাকষি, ঝগড়াঝাটি, ন্যাটাঝামটা।
প্রেম ভালবাসা সব ফুরুৎ , হা হা হা হা,
শুনে রাখ, প্রেম ততক্ষণই মায়াময় যতক্ষণ সে থাকে আলগোছে।
দিগন্তের সূর্যোদয়ের মতো আশ্চর্য সুন্দর। রঙিন। ঈশ্বরময়। পবিত্র। তাকে দেখেই সুখ। চোখে, অন্তরে নির্দ্বিধায় স্বপনদুয়ার খুলে তাতে আত্মস্থ হওয়ার নাম প্রেম।
গৃহলক্ষ্মীর নামে গৃহবন্দী হলেই যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার অবসান একমাত্র বিচ্ছেদে। আমি এই পরিনতি চাই নি। তাই, পুরাতন প্রেম আজও ঢাকা পরেনি। সে রাতজাগা চাঁপা ফুলের মতোই তরতাজা সৌরভে আবিষ্ট।
-শোনো, তোমার এইসব কাব্যকথায় আমি ভুলছিনা। তোমার বাপ ঠাকুর্দার যেসব ব্যাপারস্যাপার শোনালে তাতে আমি যা বুঝলুম, ওগুলো সব লম্পট, স্বৈরাচারী, কামুক পুরুষের অনিবার্য পরিণতি।
মা ঠাকুমা যা করেছেন একদম ঠিক কাজ। আমি বলবো, বীরাঙ্গনা ছিলেন তারা।
তাদের চরণে সহস্র প্রণাম।
তুমি এইসব যথার্থ শাস্তিগুলো সামনে রেখে মেয়েরা ভয়ের কারণ প্রতিপন্ন করতে চাও।
শোনো হে বড়ো বাড়ির দাম্ভিক নীল রক্তের বংশধর। তুমি আসলে মেয়েদের ভয় পাও না। ভয় পাও নিজেকে। ভয় পাও তোমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত তোমারই বংশধারা
নীল রক্তকে। কি, ঠিক কি-না? কী হল কথা কইছো না যে? ওহ্ ঘুমিয়ে পড়েছো, ভালোই করেছো। আমিও যাই। পরোটা কটা ভেজে ফেলি গিয়ে, গপ্পো শুনে পেট ভরবে না।