Site icon আলাপী মন

গল্প- যেমন লগ্নি তেমন ফল

যেমন লগ্নি তেমন ফল
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

‘দোল দোল দুলুনি, রাঙা মাথায় চিরুনি। বর আসবে এখুনি, নিয়ে যাবে তখুনি।’ দোল খাওয়ার সময় ছোট্ট সুর্তীণার মা বাবা এই কথাগুলো বললেই সে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে শুরু করতো। মা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলতো, আমি কোনদিন বরের সঙ্গে যাবো না। বর’রা তো পচা হয়।
মেয়ের এহেন কথাতে বেশ অবাক হতো রুমা। রুমা মেয়েকে আদর করে বলতো, কে বলেছে বর’রা পচা?
সুর্তীণা বেশ জোর গলায় বলতো, আমি জানি। ছোট পিসি মণি তো ঠাম্মাকে বলছিল, মা বর যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেয় তাহলে কি করে আমি দাদার পাশে দাঁড়াবো বলো তোো? আমার নিজের রোজগারের টাকা দাদাকে দেবো। তাতেও বরের আপত্তি। আরে বাবা আমার দাদা, বাবা’ও তো আমার জন্য অনেক করেছে। তাদের প্রতিও আমার কিছু দায়িত্ব, কর্তব্য আছে। লুকিয়ে-চুরিয়ে দাদার হাতে টাকা দিতে আমার খুব খারাপ লাগে মা। ওই আমার কপালটাই খারাপ। না হলে এমন গোঁয়ার গোবিন্দ বর জুটবে কেন? উচ্চ শিক্ষিত হয়েও অশিক্ষিত মানুষের মতো কথাবার্তা- ‘বিয়ের পরেও মেয়েদের বাপের বাড়িতে বেশি টান থাকলে নাকি সংসারে অশান্তি লেগে থাকে সবসময়।’

জানো মা আমি দেখেছি ছোট পিসিমণিকে লুকিয়ে চোখের জল মুছতে।
রুমা তার সাত বছরের মেয়েকে ঠিক কি করে বোঝাবে বুঝতে না পেরে তখনকার মতো বিষয়টা থেকে সরে গিয়েছিল। কিশোরী সুর্তীণার মনের সাদা পাতায় অতিরিক্ত কিছু না লিখে বরং সময়ের ওপরই ছেড়ে দিয়ে ছিল সব দায়িত্ব রুমা।
সময়ের থেকে বড় বন্ধু বা অভিভাবক কেউ হয় না। সময় আমাদেরকে শিখিয়ে দেয় নানা জটিল তত্ত্বের সহজ সমীকরণ। কিশোরী বয়সে কত কথা জমা পড়বে। কত কথা বাতিল হবে। সুতরাং কোনো কথাকে আঁকড়ে ধরে রাখা চলবে না।
গতকাল সেই ছোট্ট সুর্তীণার প্রীতি ভোজের অনুষ্ঠান থেকে ফিরতে রুমা ও অমরেশের যথেষ্ট রাত্রি হয়ে গিয়েছিল। যদিও রুমা যেতে চায়নি সুর্তীণার প্রীতি ভোজের অনুষ্ঠানে। কিন্তু সুর্তীণার জেদ ধরে যে তার মা বাবা প্রীতি ভোজের অনুষ্ঠানে না এলে সে কিচ্ছুটি দাঁতে কাটবে না।
সুর্তীণার এ হেন জেদ দেখে সুর্তীণার শাশুড়ি সুতপা একটা উপায় বের করেন। উনি রুমাকে বলেছিলেন, বেয়ান আপনারা মূল্য ধরে দেবেন কিছু। তাহলেই মেয়ের প্রীতি ভোজের খাবার খেতে পারবেন। জানেন তো যেখানে নিয়ম আছে সেইখানে নিয়ম ফাঁকি দেওয়ার ফাঁক ফোকরও আছে।
যদিও রুমা এইসব মূল্য ধরে দেওয়ার বিষয়টি সুর্তীণাকে কিচ্ছুটি জানায় নি। সুর্তীণা যেদিন রুমাকে বলেছিল সে পাশের পাড়ার অভিরূপকে বিয়ে করতে চায়। সেই দিন রুমা মনে মনে ভীষন খুশী হয়ে ছিল। কারণ একটাই যে মন কেমন করলেই মেয়ের কাছে ছুটে যেতে পারবে। দেখে আসতে পারবে তার জেদী, একগুঁয়ে মেয়েটাকে।

অভিরূপ ব্যাঙ্কিং সেক্টরে কাজ করে। মা বাবার একমাত্র সন্তান সে’ও। ওর মা বাবা দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষিকা। আপাত দৃষ্টিতে ছোট্ট পরিবার, সুখী পরিবার। সুতরাং মেয়ের জীবন সঙ্গী নির্বাচনের সিদ্ধান্তকে রুমা ও তার স্বামী অমরেশ মেনে নিয়েছিল মন থেকে।
রুমা মেয়ের কাছ থেকে অভিরূপের মায়ের ফোন নাম্বারটা নিয়ে সৌজন্যমূলক বার্তালাপ করে। অভিরূপের মা সুতপা যে সুর্তীণাকে বেশ পছন্দ করে তা ওর কথাবার্তাতেই বোঝা গিয়েছিল।
সুতরাং দুই পরিবারের সম্মতিতে মহাধূমধাম করে সুর্তীণা আর অভিরূপের চার হাত এক করে দেওয়া হয় ফাল্গুনের শুভ লগ্নে।
ফুলশয্যার পর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সুর্তীণা দেখে অভি ঘরে নেই। গতকাল রাতের অভির ভালোবাসার রেশ এখনো বেশ টাটকা মনে হচ্ছে সুর্তীণার। অভি সুর্তীণাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আর কিন্তু আমরা শুধু মাত্র প্রেমিক প্রেমিকা রইলাম না। এখন আমরা বর বউ। এখন চব্বিশটা ঘন্টা একসাথে কাটাবো আমরা। বুঝতে পারছো তো ব্যাপারটা খুব সহজ সাধ্য নয়। পার্কের সবুজ ঘাসে বসে দু’ চার ঘন্টা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা নয় কিন্তু। এখন থেকে প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের সজাগ থাকতে হবে যাতে একে অপরের মনের অনুভূতিকে ঠিকঠাক বুঝতে পারি। আমরা দুজনেই গার্হস্থ্য মন্ত্রে দীক্ষিত হলাম। জানো তো গৃহীরাই মানব সমাজটাকে টিকিয়ে রেখেছে। গৃহপালিত প্রাণী থেকে সাধু সন্ন্যাসী সবাই কিন্তু গৃহীদের ওপর নির্ভরশীল।
সুর্তীণা অভিরূপের বুকের কেশরাশির মধ্যে আলতো হাত বুলিয়ে বলেছিল, আমরা খুব ভালো দম্পতি হবো বুঝলে। সংসারের সব দায়িত্ব আমরা আন্তরিকভাবে পালন করবো। শুধু একটাই অনুরোধ যদি মনের কোণে কখনো কালো মেঘ জমে আমার কারণে- প্লিজ আমাকে নিঃসংকোচে জানিও।
অভিরূপ সুর্তীণাকে আরো খানিকটা বুকের কাছে চেপে ধরে বলে, গিন্নি এবার আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। সকাল সকাল উঠে বাজারে যেতে হবে। আমার নতুন সাংসারিক জীবন শুরু হবে বাজার করা দিয়ে। তোমাকে যেমন ভালো বউ হতে হবে আমাকেও তো ভালো বর হতে হবে।

সুর্তীণা অভিরূপের মাথার বালিশটা বুকের কাছে চেপে ধরে একটু চুমু খেয়ে উঠে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে লাল রঙের চুড়িদারটা পরে নীচে নেমে এলো। সুতপা জলখাবারের লুচি ভাজতে ব্যস্ত। সুর্তীণা ধীর পায়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, মা অভি কি বাইরে কোথাও গেছে? নীচে তো দেখতে পেলাম না।
অভিরূপের বাবা সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন। উনি বললেন, অভি তো বাজার গেছে অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
সুতপা লুচি ভাজতে ভাজতে বলে, দু’ দুটো সংসারের দায়িত্ব এখন আমাদের অভির ঘাড়ে।
সুর্তীণা ভ্রু কুঁচকে বলে, দু’ দুটো সংসার মানে?
কথাটা শেষ না হওয়ার আগেই সুর্তীণার মোবাইলখানা বেজে উঠলো। প্রচন্ড রকমের উচ্ছ্বসিত হয়ে তার মা বলে, সুর্তীণা অভিরূপের কান্ড দেখে তো আমি আর তোর বাবা অবাক। ওর মুখ দেখে মোটেই বোঝা যায় না ও এতো আবেগপ্রবণ।
কৌতুহলের তীব্রতা চেপে রাখতে না পেরে সুর্তীণা বলে, ও মা কি হয়েছে খুলে বলো না প্লিজ।
রুমা বলে, সাত সকালে অভিরূপ এসেছে তো আমাদের বাড়িতে। হাতে বাজারের থলি। তাতে আছে শাক সবজি, মাছ, দুধ।
সুর্তীণা বলে, ও তো আজ থেকে বাজারের দায়িত্বখানা পালন করবে বলেছিল আমাকে। এতে এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই মা। সংসার ধর্ম পালন করতে হলে বাজার হাট সবই করতে হবে। ওর মা বাবারও তো বয়স বাড়ছে ।
রুমা বলে, শুধু কি অভির মা বাবার বয়স বাড়ছে। তোর মা বাবারও বয়স বাড়ছে।

সুর্তীণা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এটা তুমি একদম ঠিক বলেছো মা। যত দিন তোমাদের কাছে ছিলাম তেমন ভাবে অনুভব করতে পারিনি যে আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা কতখানি একা। কিন্ত এখন বেশ বুঝতে পারছি।
রুমা বলে, ওরে পাগলি তোকে এতো চিন্তা করতে হবে না আমাদের জন্য। এতকাল আমাদের একটি সন্তান ছিল। এখন দু’টো সন্তানের মা বাবা আমরা।
সুর্তীণা ভ্রু কুঁচকে বলে, দু’টো সন্তান?
-হ্যাঁ তো।
-মা হেঁয়ালি ছাড়ো। অনেক কাজ আছে।
রুমা বলে, আমার একটা মেয়ে ছিল। এখন একটা ছেলে পেলাম। তুই যেমন আমাদের মেয়ে। অভিরূপও আমাদের ছেলে। শুধু কি ছেলে, বলতে পারিস দায়িত্ববান ছেলে।
অভিরূপ আজ দু’ থলি বাজার করেছে। একটা ব্যাগ আমাদের জন্য আরেকটা তোর শ্বশুরবাড়ির জন্য। আমি জিনিসগুলোর দাম দিতে চাইলে ও বলে, মা আমি কি আপনাদের ছেলে হতে পারি না। জামাই বলে আদর আপ্যায়ন না করে ছেলে হিসাবে আদর করুন। এতে আমিও খুব তাড়াতাড়ি আপনাদের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারবো।
-বলো কি মা! আমি তো ভাবতেই পারছি না। যাক গে ভালোই হলো। বাবাকে আর ভীড় ঠেলে বাজারে ছুটতে হবে না। তবে তুমি তোমার জামাই থুড়ি থুড়ি ছেলেকে তাড়াতাড়ি এই বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। জলখাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

মিনিট দশেক পর অভিরূপ বাজারের থলি হাতে বাড়ি ফিরলো। হাত পা ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলে সুর্তীণা জলখাবারের থালাটা ধরে দিয়ে বলে, তুমি এত তাড়াতাড়ি আমার মা বাবাকে এতখানি আপন করে নেবে ভাবতে পারিনি।
অভিরূপ মুচকি হেসে বলে, সব কৃতিত্ব আমার ঠিক নয়। বাজারে যাওয়ার জন্য যখন বাইকটা বের করছি তখন মা এসে বলল, অভি আরো একটা ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে যাস। আজ থেকে শুধু আমাদের বাড়ির জন্য বাজার করবি তা হবে না। তোর শ্বশুরবাড়ির জন্যও বাজার করবি। কপাল গুণে তোর শ্বশুরবাড়ি যখন পাশের পাড়াতেই তখন তো বাজার পৌঁছে দিতে অসুবিধা নেই। তুই যদি সুর্তীণার মা বাবার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করিস তাহলে সুর্তীণাও তোর বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে কার্পণ্য করবে না।
ব্যাস আমার মাথাতে সোজা অঙ্কের ফর্মুলা ঢুকে গেল। যেমন লগ্নি তেমন ফল।
সুর্তীণা প্রথমে হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, জীবনের অঙ্ক কিন্তু বড় কঠিন। মাঝে মধ্যে জীবন এমন কঠিন অঙ্ক আমাদেরকে কষতে দেয় যা কোনো ভাবেই ফর্মুলাতে ফেলা যায় না। সেই অঙ্ক মেলাতে হয় শুধু মাত্র ধৈর্য্য আর সহনশীলতা দিয়ে। মা বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমার মনে ওদেরকে নিয়ে যে চিন্তা, উদ্বেগ ছিল তা আজ অনেক খানি কম হয়ে গেল। জীবনে একজন উদার হৃদয়ের বর পেলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায় তা আজকে বুঝতে পারলাম।

Exit mobile version