Site icon আলাপী মন

গল্প- সম্পর্ক

সম্পর্ক
-শচীদুলাল পাল

 

 

 

গঙ্গা তীরবর্তী ঘনবসতিপূর্ণ ভদ্রেশ্বর শহরের প্রধান সড়কের পাশে একটা সরণি। সেখানের বাড়িগুলি বেশ ছাড়া ছাড়া। অনেক জায়গা নিয়ে বাগানে ঘেরা। গাছপালায় ভর্তি।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঘর থেকে টি ভি-র আওয়াজ ভেসে আসছে। আকাশ ওই রাস্তাটা দিয়ে যাচ্ছিল। এই বাড়িটার ওপর টার্গেট অনেকদিন ধরেই। একা বৃদ্ধ বাড়িতে থাকেন সেটা আকাশের কাছে খবর আছে। দরজাটা খোলা দেখে আকাশ সুড়ুৎ করে ঢুকে সেঁধিয়ে যায় বাড়িটার মধ্যে। সন্ধ্যেবেলায় এমনি খোলা বাড়ি পাওয়া মানে হাতে স্বর্গ পাওয়া। খুব একটা খাটাখাটির দরকার নেই। জামা, জুতো, যা হাতের কাছে পায় তুলে নেয়। সঙ্গে মোবাইল, হাতঘড়িটাও পকেটে চালান করে দেয়। একটু এদিক ওদিক দেখছে আর কি নেওয়া যায়। ঠিক সেই সময় সামনের রুমটা থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ পায় আকাশ। প্রথমে ভেবেছিল ওকে দেখে হয়তো চিৎকার করার চেষ্টা করছে। পালাতে যাবে ঠিক তখন ভাবলো- এটা তো ঠিক চিৎকার নয়- গোঙানি। জামা, জুতোটা নামিয়ে রেখে একটু সাহস সঞ্চার করে রুমটায় উঁকি মারে আকাশ। দেখে এক একা বৃদ্ধ খাটে গোঙাচ্ছে। হাতটা বুকের ওপর। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ঘরে আর কেউ কোথাও নেই। ওকে দেখে কিছু যেন বলতে চাইলো। আকাশ বুঝতে পারে কেস সুবিধার নয়। কি করবে ভেবে উঠতে পারে না। সুবর্ণসুযোগ – ঘরটা খালি করে দেবে? কিন্তু চোখের সামনে একজনকে মরতে দেখে তার সামনে দিয়ে সব কিছু নিয়ে চম্পট দেবে এই আকাশ চোর? একটু দোটানায় পড়ে। রুম থেকে বেরিয়ে দুএকটা জিনিস আবার ব্যাগে ঢোকায়। কিন্তু গোঙানিটা যেন বেড়েই চলেছে। আবার ফিরে আসে রুমে। বৃদ্ধলোকটা যেন কিছু বলতে চায় আকাশকে।
আকাশ বলে- দাঁড়ান, আপনাকে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছি এখুনি। বলে বাইরে গিয়ে একটা ট্যাক্সি এনে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিয়ে বৃদ্ধকে নিয়ে সোজা হাসপাতাল।

হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় বৃদ্ধের বালিশের তলা থেকে আলমারির চাবিটা পায়। সেটা দিয়ে আলমারি খুলে এদিক ওদিক হাতড়ে লাখ খানেক টাকাও পায়। সেই টাকা দিয়ে বৃদ্ধকে হাসপাতালে ভর্তিও করে দেয় মিহির মুখার্জি নাম দিয়ে। বৃদ্ধকে তাড়াতাড়ি ICU তে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার দেখে বলে যে ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এরেস্ট। এখুনি অপারেশন করতে হবে। যাইহোক অপারেশন হয় এবং অপারেশন সাকসেসফুল।
ডাক্তার বললেন- ঠিক টাইমে রুগীকে নিয়ে আসা হয়েছে বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু এখনো কিছুদিন অন্তত হাসপাতালই থাকতে হবে।

মোবাইলে বৃদ্ধের প্রবাসী ছেলেকে ফোন করে আকাশ।
অপরপ্রান্ত থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে
-হ্যালো, কে বাবা?
-না, আমি আকাশ বলছি
-আপনি কে?
-আমি আকাশ। চোর।
-মানে?
-কাল সন্ধ্যেবেলায় আপনার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে দেখি আপনার বাবা হঠাৎ অসুস্থ। তাই আর চুরি করা হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছি। আপনি কে বলছেন ?
-আমি ওনার ছেলে। আমেরিকা থেকে বলছি। আপনি কি চ্যাংড়ামো মারছেন?
-চ্যাংড়ামো মারবো কেন? এই নিন হসপিটালের ফোন নাম্বার আর বেড নাম্বার। জিজ্ঞেস করে নিন। আর যত তাড়াতাড়ি পারেন আপনি চলে আসুন। একা বাবাকে ছেড়ে দিয়ে আমেরিকাতে দিব্ব্যি আছেন আর আমাকে সব কাজকম্মো ফেলে আপনার বাবাকে দেখতে হচ্ছে। আপনি আবার বিকেলে ফোন করবেন বাবার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো।

এদিকে নার্সরা বৃদ্ধকে মিহির বাবু বলে ডাকলে, বৃদ্ধ বললেন- আমাকে মিহির বাবু বলে কেন ডাকা হচ্ছে? আমার নাম তো সাগর। সেই কথা শুনে ওয়ার্ডের সিস্টাররা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন। আর মিহিরবাবুকে বলা হয়- কাকু আপনাকে যিনি ভর্তি করিয়েছেন তিনি তো এই নামেই ভর্তি করিয়েছেন।
পরেরদিন আকাশ যথারীতি সাগরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যায় ICU তে। সিস্টাররা আকাশকে জিজ্ঞেস করেন
-আপনি এনার কে হন?
-আমি কেউ না।
-এনার নাম কি?
-সাগর মজুমদার।
-তাহলে মিহির মুখার্জী নামে কেন ভর্তি করিয়েছিলেন?
-আমি তখন জানতাম না। তবে ওনার ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওনার থেকেই নামটা জেনেছি। তাতে হয়েছেটা কি?
-কিছু না।
যাই হোক আকাশ এবার সাগর বাবুর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।
-জ্যাঠা, কেমন আছেন?
-ভালো। তুই না থাকলে তো বোধহয় এ যাত্রায় একদম উপরে চলে যেতাম।
-আরে না না। আপনি পুণ্যবান লোক, তাই ভগবান আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। যাই হোক আপনার ছেলে তো আমেরিকায় থাকে। তার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি আসছেন খুব তাড়াতাড়ি। কাল থেকে আপনার মোবাইলটা নিজের কাছেই রেখেছি, যদি কেউ চেনাজানা ফোন করে তাকে খবরটা দেবো বলে।
-এই ফোনটা তোর কাছেই রাখ।
-এখুনি আপনাকে আপনার ছেলে ফোন করবে। বলতে বলতে আমেরিকাবাসী ছেলের ফোন আসে। আকাশ ফোনটা সাগর বাবুকে দেয়। কিছুক্ষন বাবা-ছেলের মধ্যে কথাবার্তা হয়।

-তুই কি বলেছিস আমার ছেলেকে?
-যা সত্যি তাই বলেছি। বলেছি যে চুরি করতে ঢুকে আপনার বাবাকে অসুস্থ দেখে হাসপাতালে ভর্তি করে দিই।
-তুই চুরির কথাটা বললি কেন? কিছু একটা বানিয়ে বলতে পারতিস।
-না, না জ্যাঠা ধরা আমি পড়ে যেতাম। তার চেয়ে ভাবলাম যে সত্যিটাই বলে দিই।

যাইহোক প্রত্যেকদিন আকাশ সাগরবাবুকে দেখতে আসে। দেখতে দেখতে কয়েকদিনের মধ্যে আমেরিকাবাসী ছেলে এসে পড়ে। পরনে হাফ-প্যান্ট, গায়ে চকরা-বকরা রংচঙে জামা, মাথায় একটা টেক্সাস কাউ-বয় মার্কা টুপি, চোখে রেব্যানের সানগ্লাস, পায়ে স্নিকার। হাসপাতালে যাবার আগে থানায় গিয়ে সেই রাতের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জ্ঞানগর্ভ ইংরেজীতে লিখে একটা FIR দায়ের করে। পুলিশ আদৌ সেই FIR এর বয়ান বুঝতে পেরেছিল কিনা সন্দেহ আছে, সে যাই হোক মুখের বয়ানের ভিত্তিতে পুলিশ এসে আকাশকে থানায় ধরে নিয়ে যায়।

পরেরদিন বিকেলে ছেলে হাসপাতালে আসে। আকাশকে দেখতে না পেয়ে সাগরবাবু ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন,
-আজ আকাশটা এলো না কেন?
-আকাশটাকে ছেড়ে দাও বাবা। ওই চোরটার জন্য এত কিসের চিন্তা।
-কিন্তু সে তো চুরি করেনি। তাছাড়া তুই যে আমাকে এখন এখানে দেখছিস সেটা তো ওর জন্যে?
-তাতে কি হয়েছে। আসলে সে এক পাক্কা চোর। সে চুরির উদ্যেশেই এসেছিল। সেজন্য তাকে জেলে পুরে দেওয়া উচিৎ। এটা আমার এক নৈতিক কর্তব্য।
সাগরবাবু এই নিয়ে আর কথা বাড়ান নি ছেলের সঙ্গে। কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

বাড়ি এসেই থানায় আকাশের সাথে দেখা করতে যান সাগর বাবু। এদিকে কোর্টের ডেটও দেখতে দেখতে চলে এসেছে। ইতিমধ্যে আকাশের কান্ড প্রায় সমস্ত খবরের কাগজের শিরোনামে- “বৃদ্ধের প্রাণ বাঁচিয়ে চোরবাবাজীবনের হাজতবাস।” সেই মতো কোর্টে এই কেস কভার করতে মিডিয়ার হুড়োহুড়ি।

কোর্টে প্রথমে সাগরবাবুকে জিজ্ঞেস করা হয়।
সাগরবাবু বললেন– দরজাটা ঐদিন সন্ধ্যাবেলা খোলা ছিল। আমি যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিলাম। সেই সময় আকাশ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। গোঙানি শুনে ঘরে ঢুকে ও আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পুলিশ বললো– আমাদের খাতায় ওর নাম নেই, এই প্রথমবার ওকে FIR এর বয়ানের ভিত্তিতে আটক করা হয়েছে। ও নিজেই স্বীকার করেছে যে ওর চুরির মতলব ছিল।
এরপর ডাকা হয় সাগরবাবুর ছেলেকে।

সে বললো – আমাকেও ফোন করে ও চুরির কথা স্বীকার করেছে। সে একজন চোর। শেষে ডাকা হয় আকাশকে।
আকাশ বললো- হুজুর আমি গীতা ছুঁয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারবনা। আমি চোর। ঐদিন আমি চুরির উদ্দেশ্যেই ঘরে ঢুকেছিলাম। কিছু জিনিস ব্যাগে ঢুকিয়েও নিয়েছিলাম। কিন্তু পরে জ্যাঠাকে দেখে আমার মনে হয় এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাই আর চুরি করা হয়ে
ওঠেনি। একটা ট্যাক্সি ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
সাগর বাবু বললেন- ও মিথ্যা বলছে। ও চুরি করেনি। আমার সমস্ত জিনিস ঠিকই আছে। আমেরিকাবাসী বাবাকে বলে- তুমি চুপ করো বাবা।

সাগরবাবু ছেলেকে ধমকে বললেন- তোর না এলেও চলতো। তুই বরং আজই আমেরিকা ফিরে যা। শুধু মুখে পুঁইপাঁই ইংরেজী ছাড়া আর কিছু কি শিখেছিস? কুলাঙ্গার কোথাকার! সবার সামনে বাবার দাবড়ানিতে আমেরিকাবাসী একটু দমে যায়।
জজসাহেব আকাশকে জিজ্ঞেস করেন- তোমার কাছে কোনো চুরির প্রমাণ আছে?
আকাশ বললো- আছে। এই বলে পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে সবাইকে দেখায়। এই ঘড়িটা আমি চুরি করেছি, পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।
সাগর বাবু বললেন- না, না ওটা আমার ঘড়ি নয়।
আমেরিকাবাসী বললো- বাবা।! এ তুমি কি বলছো! আমি তোমাকে এই মূল্যবান ঘড়িটা দিয়েছিলাম। এটার দাম জানো? এটার দাম ৩০০০ ডলার। এ এক পাক্কা চোর। জজসাহেব শেষবারের মতো আকাশকে জিজ্ঞেস করে- তুমি চিন্তা করে বলছো তো?
পুলিশ বললো- আকাশ ভেবে দেখ, ওটা ভুল করে তুই নিয়েছিস কি না? তোর কি সত্যি চুরি করা উদ্দেশ্য ছিল?
আকাশ বলে- হুজুর, সত্যি কথা আমি সহজ ভাবে বলেছি। আবারও বলছি, আমি চুরি করতেই ঢুকেছিলাম। আমি চোর।
সভাকক্ষ একদম চুপ। সাগর বাবু হতাশায় ঘাড় নাড়ছেন। পুলিশের দীর্ঘশ্বাস! জজসাহেব বললেন- আকাশ চুরি করতে গিয়েছিল এটা যেমন ঠিক, তার চেয়েও বেশী করে ঠিক যে সে এক মানবিক কাজও করেছে। মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে সত্যিটা প্রথম থেকেই স্বীকার করেছে। তাই আদালত সবদিক বিবেচনা করে আকাশকে তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলো। আমেরিকাবাসী ছেলে বললো- কি হাস্যকর। এত দামী একটা ঘড়ি চুরি করে মাত্র তিন মাসের জেল! আমি হাইকোর্টে যাব।
কোর্টের বাইরে পুলিশের ভ্যানে ওঠার আগে সাগরবাবু দেখা করেন আকাশের সাথে। আকাশ ঘড়িটা ফেরত দিয়ে বললো-
জ্যাঠা, এটা আমি ইচ্ছে করে এই দিনটার জন্যে রেখেছিলাম। আর লাগবে না।
আর এই নিন আপনার ঘড়ি ও মোবাইল।
-তুই স্বীকার করলি কেন আকাশ?
-জ্যাঠা, আপনি চিন্তা করবেন না। মাত্র তিনমাসের ব্যাপার তো।

আকাশ এখন সেলিব্রিটি চোর। এই ঘটনা বড় বড় করে সব পেপারে ছাপা হয়েছে। আকাশকে একটা ভদ্রস্থ সেলে রাখা হয় যেখানে অপেক্ষাকৃত ‘ভালো’ আসামীরা থাকে।
জেলে সবাই জিজ্ঞেস করে- আকাশ তুই এতটা বোকামি কি করে করলি? তুই তো না বলে দিলেই তো ছাড়া পেয়ে যেতিস। আকাশ চুপচাপ থাকে।
দেখতে দেখতে ছাড়া পাবার দিন এগিয়ে আসে। সই-সাবুদ করে বেরোতে যাবে দেখে সাগরবাবু দাঁড়িয়ে আছেন, বললেন- তোকে নিতে এলাম। চল আকাশ আমার বাড়ি চল।
এই বলে আকাশ সাগর বাবুর সাথে ওঁর বাড়ি আসে। দুজনেই একা। খাওয়া দাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষন গল্প হয়। আকাশ বলে- আমি এই লাইনে অনেকদিন ধরেই আছি। পাঁচ মিনিটেই আমি যে কোন তালা খুলে দিতে পারি। তবে আমি পুরো অহিংসায় বিশ্বাসী, আজ অবধি কাউকে একটা চড় পর্যন্ত মারিনি। গর্ব করে বলতে পারি এখনো পর্যন্ত একবারও ধরা পড়িনি।
– বাবা তুই তো একটা শিল্পী চোর রে! এতো সূক্ষ্ম হাতের কাজ। চল আমরা একটা খেলা খেলি। আমি কাল কিছু টাকা তুলে আনব ব্যাঙ্ক থেকে, তুই যদি রাস্তা থেকে টাকাটা চুরি করতে পারিস তাহলে টাকাটা তোর।
-জ্যাঠা, আমি আর চুরি করবো না ।
-তুই এটাকে চুরি ভাবছিস কেন? আমি দেখতে চাই তুই কত বড় শিল্পী!
-আমি আর চুরি করবো না।
-তাহলে তুই চ্যালেঞ্জটা নিতে ভয় পাচ্ছিস। বল না পারবি না। তুই যদি এটাকে চুরি ভাবিস, তাহলে বলি জীবনের শেষ চুরিটা এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক।
– ঠিক আছে। আপনি যখন চ্যালেঞ্জই দিলেন, তাহলে সেটা তো নিতেই হয়। যেখানে আমার সম্মানের প্রশ্নও জড়িত।

আসলে আকাশ সাগরবাবুর প্রাণ বাঁচিয়েছে তাই তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ আকাশের কাছে। কোথাও যেন মনে হয় সরাসরি টাকা দিলে হয়তো আকাশ নেবে না বা তাকে ছোট করা হবে। তাই একটু ঘুরিয়ে নাক দেখানোর চেষ্টা।

পরের দিন সাগরবাবু ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে যান। ফেরার পথে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চায়ের অর্ডার দেন আর ভাবতে থাকেন কখন আকাশ আসবে। হয়তো একটু অমনোযোগীও হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক সেই সময় সাগরবাবুকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে টাকার ব্যাগটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে কেউ একজন ছুটে পালায়। আরে এতো আকাশ নয়! সাগরবাবু “চোর চোর” বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। কিন্তু তার আগেই চোরবাবাজী পগার পার। সাগরবাবু ভাবেন- ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার কথা আকাশই একমাত্র জানতো। তাহলে কি এটা আকাশেরই কাজ? নিজে না করে কোন শাগরেদকে দিয়ে করিয়েছে। তাই বলে এমনি করে ধাক্কা দিয়ে, ছি ছি!সাগরবাবুর মনটা বেশ খারাপ। সন্ধ্যেবেলা একা বাড়িতে বসে। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ। এই সময় আবার কে এল? দরজা খুলে দেখেন, আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। আকাশকে দেখে হঠাৎ খুব রেগে যান সাগরবাবু। বললেন- তুই অন্যকে দিয়ে টাকাটা চুরি করালি? যে নাকি আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল।
আকাশ বললো- জ্যাঠা আমি পুরো ঘটনাটাই দেখেছি। আমি সামনের একটা গলিতে লুকিয়ে ছিলাম। তুমি এলেই পেছন থেকে ব্যাগটা কেটে ঠিক টাকাটা বের করে নিতাম। কিন্তু দেখলাম ব্যাটা অন্য একটা চোর টাকাটা নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। আমি ছুটি পেছন পেছন। চোরটা যে বাসে উঠল, আমিও সেই বাসে। আর ভিড়ের মধ্যে আমার হাত আবার কথা বলা শুরু করলো। পরের স্টপেজে আমি ব্যাগটা কেটে টাকাগুলো বের করে নেমে পড়ি। এই নিন আপনার টাকা। গুনে নিন ঠিক আছে কিনা?
বলে টাকার বান্ডিলটা সাগরবাবুর হাতে তুলে দিতে যায়।
সাগরবাবু বলেন- তুই যখন পেয়েছিস ওটা তো তোর টাকা। তুই রেখে দে।
-না না সেরকম তো কথা ছিল না। আপনার টাকা তো আমি চুরি করতে পারি নি। তাই আপনাকেই দিয়ে গেলাম।

এই বলে সাগরবাবুর হাতটা টেনে টাকার বান্ডিলটা গুঁজে দেয় আকাশ। যাবার সময় বললো- জীবনের শেষ চুরিটাই আমার জীবনে সেরা চুরি। কখনো চোরের ওপর বাটপারি করিনি। আজ সেটাও করলাম আপনার জন্যে।
দিয়ে গেলাম আমার মোবাইল নম্বর। অসুখে বিসুখে দুঃখে কষ্টে বিপদে আপদে আমাকে ফোন করবেন। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো আপনার সেবা করতে।

এই বলে হাঁটা দেয় আকাশ। সাগর বাবু তাকিয়ে থাকেন যতক্ষন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের চলে যাবার দিকে।

এই ঘটনার পর কয়েক বছর কেটে গেছে।
সময়ে অসময়ে আকাশ এসে সাগরবাবুর ঘরে এসে দেখাশোনা করে। কেনাকাটা ওসুখে বিসুখে চেক আপে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে দেওয়া যাবতীয় সব কাজ করে দেয়। বিনিময়ে কিছু দিতে গেলে নেয় না। তবে সে আর চুরিও করে না। কখনো সবজি বেচে। হকারি করে।
এদিকে আমেরিকাবাসী ছেলে কোনো খোঁজ খবর নেয় না।
একবার ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল সে এক বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করেছে। আর অন্য অন্য শহরে অন্য চাকরি নিয়ে চলে গেছে। তারপর ছেলে ফোন করেনি।
তবে সাগর বাবু ফোন করেন। সাধারণ দু এক কথা বলেই লাইন কেটে দেয়।

একদিন সাগরবাবু আকাশের কাছে অনেক দুঃখে বললেন- দেখ আকাশ। তুই আমার ছেলের মতো। আমার জন্য তুই যা করিস তা নিজের ছেলেও করতোনা। আমি কিছু টাকা দিচ্ছি এগুলি দিয়ে একটা দোকান কিনে ব্যাবসা কর। যত টাকা লাগে আমি দেব।
– না জ্যেঠু। আমি কোনো সাহায্য নেবো না।
– তাহলে এক কাজ কর। তোর জন্য একটা ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবস্থা করে দি।
– আমাকে ব্যাঙ্ক লোন কেন দেবে?
– সে তোকে ভাবতে হবে না। ব্যাঙ্কের সার্কেল ম্যানেজার আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তুই কিস্তির টাকা সময়ে সময়ে শোধ করে দিবি তাতেই হবে।
আকাশ উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থাকলো।
এই ঘরের সামনে যে গ্যারেজটা ও অন্যান্য আরও দুটো ঘর আছে সেখানে তুই একটা দোকান দিবি। আর সেটা হবে তোর ইচ্ছে মতো।

এভাবে আকাশ একটা কাপড়ের বড়ো দোকান, আর একটাতে রেস্টুরেন্ট করলো।
সে ধীরে ধীরে পাক্কা ব্যাবসাদার হয়ে গেলো।
একদিন আকাশ তার প্রেমিকাকে বিয়ে করে ঘরে আনলো। তারও কাজ সাগর জ্যেঠুর দেখভাল করা। নার্স ও আয়ার কাজ দুজনেই করতে লাগলো।
নিয়মিত সময়মত দুজনে মিলে জ্যেঠুর সেবা যত্ন করে আনন্দেই কাটতে লাগলো।
পাশের একটা রুমে সে তার বউকে নিয়ে থাকে। আজ থেকে বারো বছর আগেই সাগর বা’বুর জীবনাবসান ঘটতো তা আকাশের শ্রদ্ধা ভক্তি সেবা যত্নে আরও বারো বছর বেড়ে গেলো। সাগর বাবু আকাশকে পুত্র স্নেহে তার হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন। এখন তার বয়স ৮৬। বুঝতে পারছিলেন পরমায়ু বেশিদিন নেই। বার্ধক্যজনিত নানান উপসর্গ।
প্রবাসী ছেলেকে সব কথা লিখে জানালেন। ছেলে উত্তরে লিখলো- তুমি যা ভালো বোঝ করো। আমার আর তোমার প্রতি, তোমার প্রপার্টির ও ইন্ডিয়ার প্রতি কোনো মোহ নাই।
এখানে আমি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছি। আর কখনো আমার দেশে ফেরা হবে না।

সাগরবাবু একদিন আকাশ ও ওর বউকে ডেকে বললেন- আমি আর বেশিদিন বাঁঁচবো না। আমার একটাই কামনা আছে তোর কাছে।
– বলুন জ্যেঠু। কি ইচ্ছে?
-আমার মৃত্যুর পর তুই আমার মুখাগ্নি করবি। প্রবাসী ছেলে কখনো আসবে না। আমার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি আমি তোর নামে উইল করে গেলাম। এই নে আলমারির চাবি। ব্যাঙ্কের লকারের চাবি।
সর্বত্র তোর নামে নমিনি করেছি। এখানে এক দলিল আছে সেখানে আমার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি তোর নামে দানপত্র করেছি।
আর তোর নামে কোনো ব্যাঙ্ক লোন নেই। সব শোধ হয়ে গেছে।
বলতে বলতে শ্বাসকষ্ট শুরু হলো।হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।
ICU তে রেখে চিকিৎসা করা হলো।
দিন সাতেক পর আকাশের উপস্থিতিতে এই ভবসংসারের সব মায়া ত্যাগ করে সাগরবাবু পরলোকে পাড়ি দিলেন।
আকাশ মৃতদেহ সাথে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়দের নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় গঙ্গাতীরে শ্মশানে উপস্থিত হলো। সাগরবাবুর ইচ্ছানুসারে আকাশ মুখাগ্নি করলো-
পুরোহিতের সাথে আকাশ মন্ত্র পাঠ করলো,

“ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্মং জানতা বাপ্য জানতা। মৃত্যুকাল বশং প্রাপ্যনরং পঞ্চত্বমাগতম্ ধর্মাধর্ম সমাযুক্তং লোভ মোহ সমাবৃতম্ দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু।”

Exit mobile version