একটি স্বপ্নাদ্য উপাখ্যান
-সুমিতা দাশগুপ্ত
শীতকালের মধ্যাহ্ণ। নরম মিঠে রৌদ্রে, অযোধ্যায় রাজপ্রাসাদের ছাদে উপবিষ্ট মহাদেবী সীতা, আপন পৃষ্ঠদেশে ঘন কুন্তলরাশি বিছাইয়া, পশম ও লম্বা শলাকা দ্বারা বুননকার্যে রত। তাঁহার চম্পককলিসদৃশ অঙ্গুলি ক’টি ছন্দে ছন্দে ওঠানামা করিতেছে। অদূরে পুষ্পকানন পাখির কলকাকলিতে মুখর।
মহাকাব্য রামায়ণ যেখানে সমাপ্ত হইয়াছিল, অর্থাৎ সীতার পাতালপ্রবেশ, তথা হইতে ঘটনাক্রম অনেক দূর আগাইয়া আসিয়াছে।
সুড়ঙ্গ খনন করাইয়া, রামচন্দ্র স্বয়ং ধরণীগর্ভস্থ শ্বশুরবাড়িতে গিয়া, অনুনয় বিনয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া সীতা দেবীকে সসম্মানে ফিরাইয়া আনিয়াছেন।
এখন আবার রামরাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।
কালের নিয়মে লব ও কুশ উচ্চশিক্ষা লাভ করিয়া প্রতিষ্ঠিত হইলে, যথাকালে উপযুক্ত পাত্রীদ্বয়ের সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ।এক্ষনে দুই ভ্রাতার আবার দুই জোড়া পুত্র লাভ হইয়াছে। পরমাহ্লাদিত সীতা দেবী, তাঁহার চারটি পৌত্রের জন্য সোয়েটার বুনিতেছেন।
তাঁহার চক্ষু হইতে স্নেহধারা ঝরিয়া পড়িতেছে।
এমন সময়ে দাসী আসিয়া খবর দিল পাশের রাজ্য হইতে তাঁহার ভগিনীতুল্য সখী দ্রৌপদী আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। সীতাদেবী তাঁহাকে সত্বর তথায় আনয়ন করিতে আদেশ দিতে যাইবেন, এমন সময়ে দ্রৌপদী নিজেই তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, অতশত প্রোটোকলের ধার তিনি ধারেন না।
তাঁহাকে দেখিয়া সীতাদেবী শশব্যস্তে মখমলের আসনখানা আগাইয়া দিয়া বলিলেন ,
“আইস ভগিনী, এতক্ষণ ধরিয়া তোমারই প্রতীক্ষায় আছি, এত বিলম্বের কারণ?”
“আর বলো কেন, এই ছাতার মাথার সংসারের জোয়াল টানতে টানতে ঘেন্না ধরে গেল।”
দ্রৌপদী সীতাদেবীর ন্যায় দেবভাষা ব্যবহারের ধার ধারেন না।
“ভগিনী তোমার কী হইয়াছে! ইতিপূর্বে তোমাকে এতো রুষ্ট হইতে তো দেখি নাই! এতো দাসদাসীপূর্ণ সংসার তোমার, উপরন্তু তোমার পঞ্চপতি তোমার তুষ্টি সাধনার্থে সদা তৎপর, তবুও এত খেদ কিসের!”
“থামো তো!! সবক’টাই ঢেঁড়স।”
“ছিঃ, প্রাকৃত ভাষায় এইরূপ অশিষ্ট বাক্য প্রয়োগ কদাপি সমীচীন নহে।”
“তা ঢেঁড়শদের, ঢেঁড়শ বলবো না তো কী?”
“আহা নিদেনপক্ষে লেডিশ ফিঙ্গারও তো কহিতে পারো”।
“তা সে তো একই হলো ,নাকি! হুঃ, যার নাম চালভাজা, তার নাম মুড়ি।”
“আচ্ছা বেশ, তোমার এতো রোষের কারণ কী, যদি একটু খুলিয়া বলিতে!”
“কী আর বলি! রাঁধতে রাঁধতে হাড়মাস কালি হয়ে গেল। রাজপ্রাসাদের পাচকগুলো বসে বসে মাইনে নেয়, আর তাস পাশা খেলে।
আমার পঞ্চপতির আবার অন্য লোকের রান্না মুখে রোচে না।
কী-ই না, দ্রোপদীর মতো রান্না নাকি এই ভূ ভারতে কেউ পারে না।”
“আচ্ছা মধ্যম পান্ডবও তো নাকি দক্ষ পাচক! অজ্ঞাতবাসকালে তিনি তো বিরাট রাজার পাচক হইয়াই আত্মগোপন করিয়া ছিলেন।”
“ঘোড়ার ডিম! বাইরে ঐ কথাই চালু ছিল বটে, আড়ালে এই আমিই তো কলকাঠি মানে হাতাখুন্তি নাড়তাম।”
“কী বলিতেছ! জগৎ সংসারে অপর কেহই তো এই সংবাদ অবগত নহে!”
“তাহলে আর বলছি কী। তুমি কিন্তু দিব্য আছো। হাতা খুন্তি দূরে থাক, সংসারে কুটোটি ভেঙে দু- টুকরোও করতে হয় না।”
“ইহা অবশ্য সত্য কথা। বনবাসকালে যতোই বল্কল পরিধান করি না কেন, পাকশালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এবং রন্ধনের ভার দেবর লক্ষ্মণের উপরেই ন্যস্ত ছিল। আহা কী চমৎকার সব দিন কাটাইতাম।
বন হইতে বনান্তরে ভ্রমণকালে অজস্র ফল ও ফুল সংগ্রহ করিয়া লইতাম। প্রতিদিন সকালে লোধ্র ফুলের শুভ্র রেণু দ্বারা অঙ্গরাগ শেষে, ফলমূল সহকারে প্রাতঃরাশ সম্পন্ন হইতো। ইহার পর পদচারণায় বাহির হইয়া আমরা গিরি, নির্ঝরিণী পুষ্পিতকানন শোভা দর্শন করিতাম, দেবর লক্ষ্মণ ইত্যবসরে আহার্য সংগ্রহ করিয়া লইতো।”
“সত্যিই!”
“বিশ্বাস না হয় কৃত্তিবাসী রামায়ণের পৃষ্ঠা উল্টাইয়া দেখ”
“ওঃ, তাই এখনও তোমার স্কিনটা এতো গ্লো করে! তোমার মতো আমিও তো কতবছর বনে বনে ঘুরে বেড়ালাম, কিন্তু কোথায় ফুলরেণু কোথায় প্রসাধনী! আমার যেমন কপাল! আর্যপুত্ররা কেবল শিকার করে গাদা গাদা আহার্য জোগাড় করতো, আর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের ফন্দিফিকির আঁটতো, নাও রেঁধে মরো!”
“শোনো ভগিনী, তোমাকে একখানা মূল্যবান উপদেশ দিই। সর্বদা শাদির প্রথম রজনীতেই মার্জার বধ করিতে হয়, কোথায় বলিবে, তুমি রাজার আদরের কন্যা,গৃহকর্মে অপটু, তাহা না করিয়া, তুমি স্বয়ং জনসমক্ষে স্বীয় রন্ধনপটুত্বের সংবাদ পরিবেশন করিয়া ফেলিলে। ইহা তাহারই পরিণাম। তবে ভগিনী ইহাও বলি, অযথা পতিদিগকে দোষারোপ উচিত কার্য হয় না। তাঁহাদের উপরে এই বিশাল রাজ্য পরিচালনার গুরুদায়িত্ব, উহাদের সময় কোথায়!”
“ঘোড়ার ডিম। তুমি ঐ আনন্দেই থাকো। দেশে এখন গণতন্ত্রের হাওয়া। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজ্য শাসিত হয়।”
“তাহা হইলে ইঁহারা সারাটা দিন করেন কি?”
“ওঃ তাতে আর অসুবিধা কোথায়! বড়জন সারাদিন মোবাইলে জুয়ার বাজি ধরেন,
মধ্যমপান্ডব ছিপ ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করেন, আজ অবধি একখানা চুনোপুঁটিও ধরা দেয় নি।
তৃতীয়জনের অস্ত্রগুলো এখন ভোঁতা, তাই বাচ্চাদের খেলনা পিস্তল নিয়ে সারাদিন মুখেই রাট, ট্যাট, ট্যাট শব্দ করে, কুকুর বিড়ালকে ভয় দেখায়, আর ছোট দুজন সারাদিন লুডো খেলে।”
“কী সর্বনাশ! যুধিষ্ঠির আবার জুয়া খেলিতেছেন?”
“আরে না না, চিন্তার কিছু নাই। রাজকোষ থেকে খুব সামান্যই হাতখরচ মেলে, তা দিয়ে বেশি অঙ্কের বাজি ধরা চলে না।”
“ওহ্ এইরূপ অলস পুরুষদিগকে লইয়া তো মহা মুস্কিল! চা সরবরাহ করিতে করিতে দিন যায়। দাঁড়াও সত্বর ইহাদের ব্যবস্থা করিতেছি।”
অতঃপর সীতা দেবী হনুমানের সহিত পরামর্শ করিয়া পান্ডবদিগকে টেলিসিরিয়ালে অভিনয় করিতে নামাইয়া দিলেন।
সমগ্র ভারতবাসী তাহা দর্শন করিয়া মহাভারত পাঠের পূণ্যলাভ করিতে লাগিল।
—– বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ—–
~স্বপ্নাদ্য কাহিনী কথা
নহে তুল্যমান,
অকিঞ্চিৎ লেখক রচে,
পড়ে ধৈর্যবান~।