ব্লাড সুগার
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
হরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। গজাদার পাড়া থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। সন্ধ্যে সাতটা। সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুটো নলেন গুড়ের রসগোল্লা টপটপ ক`রে মুখে ফেলে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে খেয়ে পরম তৃপ্তিতে দোকানের জগে রাখা জল মুখ উঁচু করে খেয়ে মুখ নামাতেই চোখে পড়লো “মনসা”। গজাদার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
মনসা, গজাদার বাড়ির রাত দিনের কাজের লোক। এক নম্বরের চুকলি বাজ। সারা পাড়ার সেরা সাংবাদিক। কোথায় কার কী হয়েছে কেন হয়েছে সেই হওয়াটা উচিৎ ছিল কিনা তার চুল চেরা বিশ্লেষণ না করতে পারলে রাতের ঘুমের তেরোটা।
মনসার সেই ক্ষুরধার বিজ্ঞ সমালোচনার একনিষ্ঠ শ্রোতা বৌদি অর্থাৎ গজাদার স্ত্রী । তার শোনবার প্রবল আগ্রহ মনসাকে আরও উৎসাহ দান করে এবং তার ফলস্বরূপ যেকোনো কাহিনী চমকপ্রদ রূপ ধারণ করে তিল থেকে তাল অতিক্রম করে তরমুজ আকৃতি নিয়ে উপস্থিত হয়। তার পরিবেশন গুণে প্রতিটি কাহিনীই শুধু উপভোগ্য নয়, টিভি সিরিয়ালের পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত হয়ে উঠেই মহাশুন্যে বিলীন হয়ে যায়।
মনসার দুর্ভাগ্য তার এই প্রবল ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভার সন্ধান কেউ পেলো না।
মনসা চোখ পাকিয়ে অভিভাবকের সুরে বললো, “এটা কী হলো দাবাবু, তুমি মিষ্টি খেলে?”
সর্বনাশ করেছে। এ কথা তেনার কাছে পৌঁছে যেতে মাত্র কয়েক মিনিট, তারপরেই শুরু হবে প্রলয় নাচন। শব্দবাণে কান ঝালাপালা। ওফ্ফ, শালা রক্তও বিট্রে করে। সেখানে সুগার ঢুকে বসে আছে। ডক্টর, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, ইনসুলিন একেবারে ন্যাটাপ্যাচা জীবন।
যে জীবন একটা রসগোল্লা খাবার অধিকার পায় না, সেই জীবনের কী দাম? গজাদার এখন এই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে উপায়ও নেই। প্রেস্টিজের ব্যাপার। তিন মাইল দূরে এসেও রেহাই নেই। ঠিক শ্যেনদৃষ্টি আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, তাও আবার যে সে নয় একেবারে মা মনসা। সর্পকুলের রাণী। কি আর করা, এই বয়সে মিছিমিছি মিছেকথা কইতে মন চায় না। তবুও উপায় নেই।
-কী যা-তা বলছি, কোথায় মিষ্টি। এ-তো জল। অনেকটা হেঁটে জলতেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল তাই একটু জল খেলাম। মিষ্টি কোথায়?
কী কপাল লিখন রে, বাড়ির কাজের লোকের কাছেও কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে, হায় হায় একেই বলে প্রাণের দায়।
-আবার বাজে কথা বলে, নিজের চোখে দেখলুম চেটেপুটে রসগোল্লা খেলে, খেয়ে মিছেকথা কইতে নেই জানো না।
-আরে কী আপদ, আচ্ছা এই কথা তো, মিষ্টি খেয়েছি, তাহলে তার দাম দিতে হবে তো? হেঁ হেঁ এ-ই দ্যাখ আমি গটগট করে চলে যাচ্ছি, কৈ আমার কাছে দাম চাইছে না তো।
-এক জিনিসের কতবার দাম নেবে দোকানদার? সে তো আগেই দিয়ে দিয়েছো। আমাকে অত বোকা ঠাওরিও নি। চলো বাড়ি বৌদিকে গিয়ে সব বলছি। ছি ছি তুমি কেমন মানুষ গা। বৌদি বলে তোমাকে চায়ে পর্যন্ত চিনি দেয় না। গাদাগাদা দামী দামী ওষুধ চলছে, এদিকে তুমি নুকিয়ে নুকিয়ে নলেন গুড়ের, চলো বাড়িতে।
গজাদার মনে হচ্ছিল এই রাস্তার মধ্যেই চুলের মুঠি ধরে দেয় ঘা কতক। কিন্তু মান বড়ো দায়। রাস্তায় এখন এর সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না। অবিশ্যি বাড়িতেও পারা যাবে না। কেননা ঘর শত্রু মহিলা বিভীষণ ওর সহায়। তারও কারণ আছে। সবই স্বার্থের চাহিদা। মনসা না থাকলে আদরের বৌদি একেবারে কানা।
লক্ষ্মীকান্তপুর না-কি যেন ঐ দিকেই কোথাও বাড়ি। মাঝেমধ্যে যখন সেখানে যায় তখন এখানে কী অবস্থা হয় সে তো দেখাই আছে। ফ্রিজ নির্ভর রান্নাঘর। বার করো আর কোনোরকমে কিছু একটা ঘেঁটেঘুঁটে ফুটিয়ে ফাটিয়ে ক’টা দিন চালিয়ে নেওয়া কেস।
মনসা যখনই নিজের বাড়িতে যায় তখনই গজাদার ওনার মনে কু গায়। মনসা যদি আর না ফিরে আসে, কী হবে! চলবে কীভাবে! সব তো থেমে যাবে অচল হয়ে যাবে এ সংসার। কাজ কি কম? সকাল থেকে রাত অবধি কাজের শেষ নেই।
মনসা বাজার দোকান কোথাও গেলে, মানে ওর অসাক্ষাতে তো প্রায়ই বলে।
ভাগ্যিস মনসা ছিল, নইলে কি করে কি সামলাতুম বলো দেখি। ভগবান ওকে জুটিয়ে দিয়েছে।
কথাটা অবিশ্যি ফেলে দেবার মতো নয়। ছেলে আর বৌমাকে নিয়ে চারজনের ব্যস্ত সংসার। ছেলে আর বৌমা দুজনেই চাকরি করে। ওদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। টাকা দিয়েই খালাস।
মনসা যখনই বাড়ি যাবার কথা বলে তখনই আতঙ্কে ভোগে কম বেশি সবাই। তবে গৃহিণীর দায়িত্ব যেন অলিখিত ভাবে সক্কলের থেকে বেশি। কারুর যেন কোনও অসুবিধে না হয়। কেউ যেন অভিযোগ করতে না পারে।
-হ্যাঁ রে মনসা তাড়াতাড়ি চলে আসবি তো? তুই তো জানিস তুই না থাকলে আমি একা পেরে উঠি না।
মনসা আস্বস্ত করে,
-কিচ্ছু চিন্তা কোরো না। সামান্য দু’চার দিনের কাজ। মিটিয়েই চলে আসবো বৌদি।
দাবাবু গো নুকিয়ে নুকিয়ে মিষ্টি খেও না কো। তুমি অসুস্থ হলে বৌদির অশান্তি বাড়বে, বুঝেছো।
গজাদার মাঝেমাঝে মনে হয়, মনসা ওদের মাইনে করা কাজের লোক নয়। এই সংসারের একজন সক্রিয় সংবেদনশীল সদস্য।
বরঞ্চ ছেলে বৌমা যেন পেইং গেষ্ট। আছে থাকছে নিজেদের মতো। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, নিজস্ব চিন্তায় বিভোর। প্রয়োজনের বাইরে কথাবার্তাও হয় না আজকাল। হাসি ঠাট্টা গল্পের পাট কখন যে শেষ হয়ে গিয়েছে কে জানে। যেন মনে হয় একই বাড়িতে পাশাপাশি বাস করে দুটি আলাদা পরিবার।
গজাদা ভাবে, কিন্তু কাউকেই কিছু বলে না।গৃহিণীকে তো নয়ই। গজাদা জানে এসব ওকে বলার কোনো মানেই হয়না। প্রথমত ও এসব কথার গুরুত্বই দেবে না। দ্বিতীয়ত মায়ের মন বুঝতে পারলেও স্বীকার করতে চাইবে না।
সম্পর্ক আলগা হচ্ছে। ছিঁড়ে যাবে হঠাৎই একদিন আচমকা। সেদিন খুব বেশি দূরে নেই। সময় মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে খানিকটা দূরদর্শীও।
মনসারও বয়স বসে নেই। চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। গরীব গুর্বো ঘরের অশিক্ষিত মেয়ে। পনেরো বছর বয়সে যে ছেলেটার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল সে দু বছরের মাথায় মনসাকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়ে অন্য আর একটি মেয়ের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। মনসার স্বামী সহবাসের অভিজ্ঞতা কেবল এইটুকুই।
স্বামীর থেকে পুত্র সন্তান ছাড়াও আরও দুটি উপহার সে পেয়েছিল। একটা টিনের ভাঙা ঘর আর বুড়ী মা।
পুরাতন অতীতকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ত্যাগ করতে পারে মাত্র দু’জন।
এক, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। দুই, স্বার্থান্বেষী আত্মসুখ অভিলাষী।
এর পরেই শুরু হয় মনসার জীবন সংগ্রাম। বুড়ী শাশুড়ীর কাছে বাচ্চা রেখে কলকাতার বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ।
সেই ছেলে এখন বিশ বাইশ বছরের যুবক। সাইকেল সারানোর দোকান দিয়েছে। অবিশ্যি সেটা তার মা’য়েরই অবদান। তারই উদয় অস্ত পরিশ্রমের ফল। তবে চুপিচুপি বলে রাখি, গজাদার অগোচরে বৌদির অবদান বড়ো কম ছিল না। তবে শর্ত ছিল তার এই কথা কাউকে জানানো যাবে না।
গৃহিনীরা সংসারের চাবিকাঠির অধিকার নিশ্চয়ই পেয়ে থাকেন, কিন্তু সেখানে স্বাধীনতার পরিমাণ কতখানি তা অবশ্যই ভাবার বিষয়।
যাই হোক, মনসার পেটে কথা না রাখতে পারার বদনাম অবশ্যই আছে। কিন্তু এইক্ষেত্রে সে আশ্চর্য রকম ভাবে শর্ত পালন করেছিল। আসলে মনসা নয়, নিষ্ঠার সঙ্গে শর্ত পালন করেছিল মনসার মধ্যে থাকা একটি মা। সর্বংসহা কর্তব্যরতা মা।
গজাদার অভিজ্ঞ মনের ভাবনা একদিন সত্যি হয়ে গেল। যৌথ উদ্যোগে রোজকার করা মোটা অঙ্কের টাকায় সাজানো ফ্ল্যাট কিনে, বয়স্ক মা বাবাকে পুরনো বাড়িতে রেখে দিয়ে অক্লেশে চলে গেল, হাসিমুখে হৈ হৈ করতে করতে। যাবার সময় পরিত্যক্ত বাবা মা-কে নতুন ফ্ল্যাট দেখতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে মনুষ্যত্বের নিদারুণ পরিচয় রাখতে ভুল হলো না।
মনসা’কেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল ওরা। নিজেদের নির্লজ্জ স্বার্থেই চেয়েছিল। কিন্তু মনসার তীব্র প্রত্যাখানে সেই আশায় ছাই পড়েছিল।
মনসা বলেছিল,
“যদিও তোমাদের মা বাবাকে, দাবাবু আর বৌদি বলে ডাকি, কিন্তু ওরাই আমার
মা বাবা। যাদের ভালোবাসার আশ্রয়ে সবকিছু পেলাম তাদের সঙ্গে বেইমানি বিশ্বাসঘাতকতা করলে নরকেও ঠাঁই হবেনা।”
সেদিন গজাদার মনসাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়েছিল নিদেনপক্ষে কপালে একটি কৃতজ্ঞতার পবিত্র চুম্বন। কিন্তু ইচ্ছেটা ইচ্ছে হয়েই মনের মাঝে রয়ে গিয়েছিল পরম যত্নে আমৃত্যু। রক্ত বিট্রে করে কিন্তু মিষ্টি মধুর সম্পর্কে অসুখ বাসা বাঁধতে পারে না, কিছুতেই না।