গল্প- মুদ্রার অপর পিঠ

মুদ্রার অপর পিঠ
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

 

 

 

“কাকিমা এই নাও তোমার আর কাকুর ওষুধ। তোমাদের একটা কথা বলবো সেন্টার থেকে একটা ভালো সারাদিনের বাড়ি সহকারী রাখো। অত দূর থেকে এসে আমার পক্ষে তোমাদের সব কাজ করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাছাড়া আজকাল সবই অনলাইন হয়। তোমার ছেলেদের বোলো বিদেশ থেকে অনলাইন সব ব্যবস্থা করে দিতে।”
অনুরূপার মোবাইলটা বাজছে। অনিন্দিতা ফোন করেছে। “তোর ছেলে তোদের কাজ করে দিতে পারে আর আমাদের বেলায় লোক রাখতে বলছে, কি এমন রে! তোরা থাকিস কল্যাণীতে আর আমরা কাঁচড়াপাড়া একটা তো স্টেশান। নিজের নাইবা হলাম আমরাও তো কাকু কাকিমা। আমার ছেলে আর তোর ছেলে তো এক স্কুলে আর এক ক্লাসেই পড়তো। “শোন অনিন্দিতা আমার সুনয় এখন খুবই ব্যস্ত। ওর মেয়েকে পড়া, নাচ এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া, নিজের কোচিং সেন্টার আবার আমাদের দুই বুড়োবুড়িকে নিয়ে বিভিন্ন টেস্ট করানো, ওষুধ আনা, ওর বাবাকে নিয়ে চিকিৎসার কারণে কলকাতা নেওয়া আরো অনেক ব্যস্ততা রে! ওর পক্ষে তোদের দায়িত্ব আর নেওয়া সম্ভব নয়, এটা অপ্রিয় হলেও সত্যি কথা। তাছাড়া তুই একবার মনে করে দেখ তো যখন এরা দুজন একই স্কুলে পড়তো তুই কি তোর ছেলে আর আমার ছেলেকে সমান চোখে দেখতিস?”

স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে স্বপ্ননীল। প্রায় প্রতিটা বিষয়েই পুরোয় পুরো নম্বর। স্কুলে সবাই ধন্য ধন্য করছে। অনিন্দিতা নাকি রত্নগর্ভা। এ ছেলে অনেক বড় হবে জীবনে। অনিন্দিতাও গর্বিত মুখে সবার সাথে কথা বলছে। সুনয়(অনুরূপার ছেলে) মোটামুটি রেজাল্ট করেছে। এক থেকে দশের মধ্যে নেই। সুনয় স্বপ্ননীলের সাথে কথা বলতে এলে অনিন্দিতা কেমন যেন ছেলেকে সরিয়ে নিচ্ছে। অনুরূপা শুনতে পায় অনিন্দিতা একজনকে বলছে, “এসব ফালতু রেজাল্ট করা ছেলের সাথে আমি বাবা ছেলেকে মিশতে দিই না, ভালোদের সাথে মিশলে ওর মধ্যে আরো ভা৬ল করার মানসিকতা আসবে।” অনুরূপার ছেলের অপমানে চোখে জল আসে। ধীরে ধীরে উচ্চমাধ্যমিক। হ্যাঁ এখানেই বিশাল ভালো রেজাল্ট স্বপ্ননীলের। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, বিশাল ভালো চাকরি, তারপর বিদেশে যাত্রা। গর্বিত অনিন্দিতা অনুরূপা আর ওর বরের সাথে দেখা হলে বলে তোরা ছেলেকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারিসনি। তাই তোর ছেলে সামান্য একটা কোচিং সেন্টার চালায়। আমার ছেলে দেখ্ কতো রোজগার করে। অনুরূপার বর বলে “মাফ করবেন আপনার কাছে মানুষ বা সফলের যে সংজ্ঞা আমার কাছে তা নয়। আমার ছেলে সৎভাবে রোজগার করে। কিছু কিছু দরিদ্র ছেলেমেয়েকে বই খাতাও দেয়। আর আমাদের ভীষণ যত্নে রাখে। আমার নাতনীটাও ঠাম্মি দিদা অন্ত প্রাণ। আমি মনে করি আমার ছেলে একজন সফল মানুষ।” ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসে অনিন্দিতা আর অনিন্দিতার বর।
-“যতই বল আমরা ছেলে বউকে নিয়ে গর্ব করে যা বলতে পারি, বলতে পারি আমার ছেলে আমেরিকায় বড় ইঞ্জিনিয়ার বউ ও ইঞ্জিনিয়ার আর তোরা..!”
আবার ফোনটা বাজছে। আবারও অনিন্দিতা, “তোর ছেলেটাকে একটু পাঠিয়ে দে না। আমাদের কিছু দরকারী জিনিস লাগবে!”
“কেন তোর রত্ন ছেলেকে অনলাইন করতে বল। না রে ও খুব ব্যস্ত, ওর বউও খুব ব্যস্ত। আজকাল ফোন করারও সময় পায় না।” “কিছু মনে করিস না, যে ছেলে নিজের বাবা মায়ের খোঁজ নেওয়ার সময় পায় না তাকে আমরা সফল মানুষ মনে করি না রে! আমার ছেলে যতই ব্যস্ত থাক আমাদের জন্য তার সময় আছে। তাই আমরা মনে করি আমরাই ছেলেকে মানুষ করতে পেরেছি। তাছাড়া ওর লকডাউনের জন্য বেশ কিছুদিন ছাত্রছাত্রী কমে গিয়েছিল, আবার সবে বাড়তে শুরু করেছে, এখন ও আর সময় দিতে পারবে না। তাছাড়া ওর বাবার একটা ছোটখাটো বেড়াতে যাওয়া দরকার। আমরা সবাই তাই দীঘা যাচ্ছি। জানিস আমরা সবাই যখন কোথাও যাই, খুব আনন্দ করি। আমি তো নিশ্চিত আমাদের কোনো অসুবিধা হলে সুনয় পাশে থাকবে। আর হ্যাঁ, ও বেড়াতে যাবে বলে একস্ট্রা ক্লাস ওকে করাতে হচ্ছে রে! ওর একদম সময় নেই।
-“আর এখন যদি তোর কিছু লাগতো সময় দিত না?”
-“হ্যাঁ দিতো, বাস্তব সত্য নিজের মা বাবার ক্ষেত্রে যে সময়টা বার করা যায় সেটা অন্যের জন্য সবসময় বার করা যায় না রে!তোরাই তো বলতিস আমরা নাকি ছেলেকে মানুষ করতে পারিনি তা আজকে কেন এই সাধারণ ছেলেকে নিয়ে টানাটানি করছিস। তোর সফল মানুষ ছেলেকে বল, বিদেশের আয়েশ ছেড়ে তোদের দরকারে পাশে এসে দাঁড়াতে। অনেক কথা আগে শুনিয়েছিস!শোন তবে মুদ্রার একপিঠ দেখেছিস! মূদ্রার অন্য পিঠটাও দেখ। রাখি রে আমাকে আবার নাতনীর সঙ্গে লুডো খেলতে হবে মজা করে। তোদের মত নাতনীকে ভার্চুয়াল জগতে পেতে আমার আবার ভালো লাগে না। ওর নরম গাল গালে ঘষে যখন ঠাম্মি বলে আমায় আদর করে মনে হয় আমি পৃথিবীর সেরা মানুষ। রাখলাম রে!”

Loading

Leave A Comment