Site icon আলাপী মন

গল্প- ঘোর কলিকাল

ঘোর কলিকাল
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

প্রভাত মাস্টারিটা পাওয়ার পর থেকেই তার স্কুল, ছাত্রছাত্রী এইসব হয়েছে ধ্যান জ্ঞান। একেবারে সঠিক সময়ে প্রার্থনা বসার আগেই সে হাজির হয়ে যায় স্কুলে। যদিও তার জন্য তাকে সকাল আটটার মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হয়।
প্রভাতের মা রমা দেবীকে তাই ভোরে উঠেই রান্না চড়াতে হয়। যদিও রমা দেবীর এতে কোনো অসুবিধা হয় না। ভোর ভোর রান্না করার অভ্যাসটা তার গড়ে উঠেছে বিয়ের পর থেকেই। প্রভাতের বাবা বিমল বাবুও ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক। ওনার’ও স্কুল তাদের বাড়ি থেকে অনেকখানি দূরত্বে ছিল।
ছোট থেকেই প্রভাত শুনে আসছে স্কুলের খাতা দেখার নিয়ম কানুন, কেউ নকল করলে তার কি শাস্তি হয় এইসব।
রমা দেবীও সবসময় ছেলেদের শেখাতেন ‘অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।’
রীতিমত একটা সৎ ও আদর্শ পরিবারে বড়ো হয়ে উঠেছে প্রভাত। যদিও তার চাকরির সময়কালে পারিপার্শিক আদর্শ, সততা এইসব চারিত্রিক গুণাবলীগুলো অনেক কমে গিয়েছে। তবুও প্রভাত নিজের মতো করে সৎ থাকার চেষ্টা করে এবং একজন সুশিক্ষকের আদর্শ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করে।

কিন্তু দুই তিন দিন আগে হঠাৎ জনা দশেক বিক্ষুব্ধ গার্জেন দলগত ভাবে স্কুলে এসে হাজির। প্রধান শিক্ষক মহাশয় চেয়ার ছেড়ে ছুটে আসতে বাধ্য হন গার্জেনদেরকে শান্ত করার জন্য। কিন্তু গার্জেনদের একটাই বুলি, ‘প্রভাত স্যারের বদলী চাই।’

প্রভাত তখন নাইনের পরীক্ষার রুমে গার্ড দিচ্ছিল। বেয়ারা সুনীল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে প্রভাতের কানে কানে বলে, স্যার খুব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন কিন্তু। গার্জেনরা একদম মার মুখী হয়ে রয়েছে। হেড স্যার ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করছেন। জানি না কতদূর কি করতে পারবেন। আপনি কিন্তু ভুলেও নীচে নামবেন না এখন।
প্রভাতও অবাক। সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না তার অন্যায়টা কি? সুনীল চলে যাওয়ার পর প্রভাত পুনরায় নাইনের ক্লাসরুমে ঢুকে চেয়ারটা টেনে খুব ধীরে ধীরে বসলো।

নীচে থেকে ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের চিৎকার চেঁচামেচির মাত্রা লাগাম ছাড়া হলে প্রধান শিক্ষক মহাশয় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য লোকাল থানায় ফোন করে। মিনিট কুড়ির মধ্যে একজন অফিসার আর দুজন কনস্টেবল এসে হাজির বড়বেলুন হাইস্কুল প্রাঙ্গনে।

পুলিশকে দেখা মাত্রই গার্জেনরা অভিযোগের সুরে বলে, প্রভাত স্যারের যোগ্য শাস্তি চাই।বদলী চাই।
পুলিশ অফিসার রীতিমত ধমকের সুরে বলে, আমি সকলের অভিযোগ শুনবো কিন্তু একে একে। দয়াকরে আপনারা চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ করুন আগে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন আজও পরীক্ষা চলছে ছাত্রছাত্রীদের। এরমধ্যে আপনারা যে হট্টগোল করছেন তার জন্য কিন্তু আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

পুলিশ অফিসারের কাছে ধমক খেয়ে উত্তেজিত গার্জেনরা কিছুটা সংযত হলো। পুলিশ অফিসার বলেন, কি কারণে প্রভাত স্যারের বদলী চাইছেন তা আমাকে একজন বলবেন বিস্তারিত ভাবে।

একজন গার্জেন কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, স্যার এই প্রভাত মাস্টারের জন্য আমার মেয়েটা সুইসাইড করতে গিয়েছিল।
চমকে উঠলেন অফিসার এবং প্রধান শিক্ষক মহাশয়। অফিসার রাশভারি গলায় বলেন, কেন?
-গতকাল আমার মেয়ের পরীক্ষার খাতা কেড়ে নিয়েছে প্রভাত স্যার।

প্রধান শিক্ষক মহাশয় তাড়াতাড়ি বলেন, ওওওও ইলেভেন বি- এর কেসটা।

অফিসার প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে থামিয়ে দিয়ে বলে, স্যার আগে ওনার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনে নিই। তারপর আপনার কাছে আসছি।
-তা প্রভাত স্যার কেন আপনার মেয়ের পরীক্ষার খাতা কেড়ে নিয়েছিল?
অভিভাবকটি বলে ওঠেন, স্যার সে কথা কিছু মেয়ে লিখে রাখে নি চিঠিতে। এই বলে পকেট থেকে সুইসাইড নোটটা বের করে পুলিশ অফিসারকে দেখালো।

সুইসাইড নোটে লেখা আছে, প্রভাত স্যারের জন্য আমি স্কুলে কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। খাতাটা কেড়ে নিয়ে স্যার আমার চরম ক্ষতি করলেন। তাই আমি ধানের কীটনাশক খেতে বাধ্য হচ্ছি।

পুলিশ অফিসার চিঠিটা একজন কনস্টেবলের হাতে দিয়ে প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে বললেন, আমি প্রভাত স্যারের সাথে কথা বলতে চাই। উনি কি আজ স্কুলে উপস্থিত আছেন?

বেয়ারা সুনীল ছুটতে ছুটতে গিয়ে ডেকে আনে প্রভাতকে। প্রভাত অন্য একজন শিক্ষকের দায়িত্বে ছেড়ে আসে নাইন ক্লাসের পরীক্ষাটা।

প্রভাতকে দেখা মাত্রই অভিভাবকরা মারমুখী হয়ে ওঠে। যদিও পুলিশ অফিসারের রক্ত চক্ষু দেখে তারা চুপ হয়ে যায়।

অফিসার প্রভাত স্যারের উদ্দেশ্যে বলে, স্যার আপনি আমাকে বলুন তো গতকাল সুলতা নামের মেয়েটি ঠিক কি কান্ড করেছিল পরীক্ষার হলে।
প্রভাত বলে, আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম সুলতা ওর শাড়ির আঁচলটা বারবার ওলোটপালট করছে। আমি কাছে এলেই শান্ত হয়ে যাচ্ছে। আমিও ওঁত পেতে ছিলাম ।যখনি টুকলিটা বের করবে আমি ঝপ করে ধরবো।

একদম পরীক্ষা তখন শেষের দিকে সুলতা যেই টুকলিটা আঁচলের নিচে থেকে বের করে দেখে লিখতে শুরু করে আমি গিয়ে চেপে ধরি ওর খাতাটা। ও তো ভয় পেয়ে যায় প্রথমে। টুকলিটা আমার কাছে জমা করার কথা বলা মাত্রই সুলতা ওর টুকলিটা ব্লাউজের ভেতর চালান করে দেয়। আমি তখন বাধ্য হয়ে নমিতা ম্যাডামকে তল্লাশি করতে বলি। ম্যাডাম বাথরুমে নিয়ে গিয়ে টুকলিটা বের করে।
তারপর হেড স্যারের কাছে সুলতাকে নিয়ে যাই আমরা। হেড স্যার সুলতার ইতিহাস পরীক্ষার খাতা বাতিল করে দেয়।

পুলিশ অফিসার সব শুনে সুলতার বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, কি মশাই আপনার মেয়ের সুইসাইড করার আসল কারণটা জানতে পারলেন তো।

সুলতার বাবা কাঁদতে কাঁদতে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলে, স্যার মেয়েটা হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে শুধু মাত্র এই প্রভাত স্যারের জন্য। স্যার এতটা কঠোর ব্যবস্থা না নিলেও পারতেন। এখন যদি আমার মেয়েটার কিছু হয়ে যায় তখন আমি কি করবো স্যার?

অন্য অভিভাবকরা বলে ওঠে, এমন কড়া টিচার আমাদের গ্ৰামের স্কুলে দরকার নেই। আমরা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। চিকিৎসার পিছনে এতো পয়সা খরচা করতে পারবো না। তার থেকে প্রভাত বাবুকে আমাদের স্কুল থেকে বদলী করিয়ে দেওয়া হোক।

প্রধান শিক্ষক ও পুলিশ অফিসার বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ফিরে এলেন গার্জেনদের মধ্যে। প্রধান শিক্ষক মহাশয় সুলতার বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার মেয়ের হসপিটালে চিকিৎসা বাবদ যা খরচ হয়েছে তার সবটাই দেবে প্রভাত স্যার এবং যত দিন না আপনার মেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ততদিন বিকালের ভিজিটিং ওয়ারে আপনার মেয়েকে দেখতে যাবেন প্রভাত স্যার।
দেখুন প্রভাত বাবুর মতো শিক্ষক অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেলে আমাদের স্কুলেরই ক্ষতি হবে।
অহেতুক আপনারা আর ঝুট ঝামেলা না বাড়িয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিন।

সমবেত অভিভাবকের দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে জানায়, পুলিশ অফিসার আর প্রধান শিক্ষকের জন্যই তারা প্রভাত স্যারকে ক্ষমা করে দিল।
অভিভাবকের দল চলে গেলে, প্রধান শিক্ষক মহাশয় প্রভাতের কাঁধে হাত রেখে বলে, এ ঘোর কলি বৎস। এখানে জীবন আদর্শের অন্য পাঠ চলে। যেখানে দেখিবে অন্যায়, মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় আর নাই।
প্রভাত বাড়িতে ফিরে তার মা বাবাকে সুলতার টুকলি সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। বিমল বাবু সব শুনে বলে, কিছু বোধ বুদ্ধিহীন অভিভাবকদের জন্য আজ শিক্ষা ব্যবস্থার এই অধঃপতন। টুকলি করলে শাস্তি দেওয়া যাবে না, ক্লাস রুমে লাঠির ব্যবহার নিষিদ্ধ। এখন না আছে গুরুর শাসন না আছে আগেকার মতো গুরুদের ভালোবাসা। শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যেও এখন give and take policy. এই কঠিন সময়ে তুই যখন শিক্ষকতার পেশাটাই বেছে নিয়েছিস তখন তোকে একটা কথাই বলবো, ‘যেমন কলি তেমন চলি’ এই প্রবাদকে নীতিবাক্য হিসাবে মেনে নিতে শেখ বাবা। না হলেই আরো অনেক সুলতার মতো অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী তোকে হতে হবে।

Exit mobile version