মিউউউউউ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
শীতের দুপুর। ঠাকুমা সবে একটু রোদ পুইয়ে এসে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছে, ওমনি ছাদের কার্নিশে বসে একঘেয়ে মিউউউউ করে ডেকে চলেছে ভবঘুরে বেড়াল।
এ তো ভারী উৎপাত।
প্রথমে শুয়ে শুয়েই মুখে হুট হ্যাট আওয়াজ করে তাড়াবার চেষ্টা হলো কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সে তার মতো করে গলা সেধে যাচ্ছে, মিউউউ।
ঠাকুমা বিরক্ত হয়ে মনে মনে বেড়ালের রচনা সৃষ্টি করতে লাগলো। এ ব্যাটারা আসে কোত্থেকে! মাঝেমধ্যেই কেউ না কেউ এসে হাজির হয়। কখনো সাদা, কখনো কালো, কখনো সাদাকালো মেশানো। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ একটা ধুমসো হুলো ছাদে বারান্দায় সিঁড়ির চাতালে ঘুরঘুর করবে।
দু-একদিন বাদেই আবিষ্কার হলো হুলো একা নয় সঙ্গে দোকা মেনিও আছে। নিশ্চয়ই অন্য পাড়া থেকে ফুসলিয়ে এনেছে হুলো।
এই ফুসলিয়ে আনার ব্যাপারটা কিন্তু ভাববার আছে।
এপাড়ার মেনি ওপাড়ার হুলোর সাথে কেটে গেল এই মহাবিদ্যা মা ষষ্ঠীর একনিষ্ঠ বাহন শিখলো কোথায়! কার কাছে? মানুষের সঙ্গে নির্বিবাদে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে এই ব্যাপারটা বেড়াল সমাজে সংক্রামিত হলো, না-কি উল্টো? মানে মার্জার গোষ্ঠী থেকে মনুষ্য সমাজে?
ঠাকুমার রচনা ভাবনা এবার কিন্তু অসহ্য হয়ে উঠছে। এসপার উসপার মনোভাব নিয়ে খাট থেকে নেমে বাইরে এলো।
হুলো ততক্ষণে কার্নিশ ছেড়ে বারান্দার রেলিঙের ওপর উঠে গলার কাজ দেখাচ্ছে।
ঠাকুমা হাত তুলে মারবার ভঙ্গিতে বারকয়েক হুস হাস করলো কিন্তু আশ্চর্য, হুলো ঠাকুমার দিকে নিরীহ ভাবে তাকিয়ে স্পন্ডালাইটিস রুগীর মতো দু’বার ঘাড়ের ব্যায়াম ক`রে পুনরায় ডাক ছাড়লো- মিউউউ
ঠাকুমার মাথায় ভিসুভিয়াস ফাটছে। নগন্য বেড়ালের এই তাচ্ছিল্য কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। একটা লাঠি হাতের কাছে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এইসব জঞ্জাল প্রাণীদের কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় ভালোই জানা আছে।
আবারও সেই ডাক- মিউউউউউ। এবার আরও জোরে। ঠাকুমা কোমরে হাত রেখে কটমট ক`রে তাকিয়ে দেখলো। এই অবজ্ঞা কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব নয়।
মুঠো করে শাড়ির খুঁট উঁচুতে তুলে হুড়মুড় করে রেলিঙের দিকে যেতে গিয়ে একেবারে দুম। পড়ে গিয়ে আলুরদম।
পড়ে যাওয়ার বিকট শব্দ আর ঠাকুমার চিৎকার শুনে যুবক তমাল ছুট্টে বাইরে এসে ঠাকুমাকে টেনে তোলবার চেষ্টা করতে লাগলো। ঠিক তখনই আবারও সেই ডাক
মিউউউউউ। সম্ভবত বুঝেছে এখানে কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। গোলগোল চোখ আরও বড়ো আর চকচকে হয়ে উঠেছে।
কালের নিয়মে ঠাকুমার এ সংসার থেকে আধিপত্য বিদায় নিয়েছে কিন্তু স্বভাব দোষ? সে তো যাবার নয়। স্বভাব সাসপেন্ড হতে পারে কিন্তু রিটায়ার করে না।
ঠাকুমা চিৎপটাং অবস্থাতেও জোয়ান নাতি তমালকে আঙুল দিয়ে বেড়ালের দিকে ইশারা করে ওটাকে তাড়াতে বললো।
তমাল এক হাতে ঠাকুমাকে ধরে রেখে অন্য হাতে বেড়ালের দিকে মারবার তাক করতেই সে এক লাফে পগার পার।
ঠাকুমা নাতির কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, ফাঁকা রেলিঙের দিকে তাকিয়ে কুঁইকুঁই করে বললো,
“নচ্ছার বেড়াল। ওফ্ফ… কী শয়তান।”
জোয়ান নাতির হাত ধরে ঘরে যেতে যেতে আক্ষেপের সুরে বললো,
” হায় রে, বয়স্ক লোককে একটা বেড়ালও ভয় পাওয়া তো দূর পাত্তাই দেয় না।”
ঠিক তখনই দূর থেকে একটা শব্দ হাড় পিত্তি জ্বালিয়ে ভেসে এলো,
মিউউউউউউউউ….
তমাল আর ঠাকুমা দু’জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো কয়েক সেকেন্ড, তারপরই দু’জনেই একসঙ্গে খুব জোরে আওয়াজ ক`রে হেসে উঠলো, হা হা হা হা হা হা হা হা…