বেড রেস্ট
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
গরম দুধের গ্লাসটা হাতে ধরে চুপচাপ বসে রইল দিতি। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে তার শাশুড়ি মা অপর্ণা দেবীর বাক্যবানগুলো।
খুব সম্ভবত দিনটা ছিল রবিবার। সারাদিন রাজীব বাড়িতে আছে। সকালে একবার বাজারে যাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনো কাজ সে করে নি। আর রবিবার মানেই সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে রাতের ডিনার অবধি কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া। দিতি সকাল সাড়ে ছয়টাতে রান্নাঘরে ঢুকেছে তো ঢুকেছে। একটার পর একটা কাজ করে দুপুরে খাওয়ার টেবিলে খেতে বসে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
স্বামী ও শ্বশুর মশাই-এর খাওয়া দাওয়া শেষ হলে দিতি ও তার শাশুড়ি মা খেতে বসেছিল।দিতি খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাজীবকে বলে, শুনছো তুমি বাবার আর তোমার এঁটো থালা বাটিটা তুলে নিয়ে গিয়ে গামলাতে রেখে দাও।
দিতির এই কথা শুনে অপর্ণা দেবী বাজখাঁই গলায় বলে উঠেছিল, খবরদার না। রাজীব তুই কোনো এঁটো বাসন তুলতে যাবি না। আমাদের বাড়ির পুরুষ মানুষেরা খাবার খেয়ে থালা বাসন তোলে না।
তোমার বাবার বাড়িতে ছেলেদের এঁটো থালা বাসন তোলার রীতি থাকতে পারে। কিন্তু আমার বাড়িতে এইসব নিয়ম কানুন লাগু করতে এসো না। ভুলে যেও না সংসারটা এখনও আমার।
দিতি তো হতবাক তার শাশুড়ির এমন ধারার কথা শুনে। তার অতি সাধারণ কথার কি সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া। আর সব থেকে বেশি অবাক হয়েছিল সেদিন রাজীবকে দেখে। মুখ দিয়ে একটি বাক্য খরচ না করে চুপচাপ ডাইনিং রুম থেকে সোজা বেডরুমে চলে গিয়েছিল। তবে সেদিন দিতির শ্বশুর মশাই বরঞ্চ মৃদু স্বরে মিউমিউ করে বলে ছিল, থাক না গিন্নি। মেয়েটা সারাদিনের খাটাখাটনির পর খেতে বসেছে। এত কড়া কড়া কথা না বললেই চলে।
অপর্ণা দেবী সেদিন এমন কটমট করে রাজীবের বাবা দুলাল বাবুর দিকে তাকিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পারলে কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নেয় তাকে। শুধু তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিল, বৌমাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে সংসারটা চালাতে হবে। আমার সংসার কিভাবে সুষ্ঠভাবে চালাবো আমি তা তোমাকে বলে দিতে হবে না। খাওয়া দাওয়া যখন হয়ে গেছে এখানে বসে না থেকে ঘরে গিয়ে পিঠ পেতে আরাম করো।
সেদিন দিতি চোখের জল মুছতে মুছতে কোনো রকমে ভাত খেয়েছিল। খাসির মাংসটাও আলুনি লাগছিল। রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে যখন ঘরে এসেছিল তখন দেখে রাজীব পাশবালিশে পা তুলে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। দু’চার কথা শোনাবে ভেবেছিল। কিন্তু আর বলা হয় নি তার অভিমানের কথা।
দিতির বিয়ের বছর খানেক পর রাজীব পেয়েছিল স্কুলের চাকরিটা। ঠিক বিবাহ বার্ষিকীর দিনেই নিয়োগ পত্রখানি হাতে পেয়েছিল রাজীব। সেদিন সবাই বলেছিল, দিতির পয়ে তেই রাজীব চাকরিটা পেল।দিতির বাপের বাড়ি থেকে ওর বাবা, মা, দাদা বৌদি সবাই এসেছিল ঐদিন। দিতির বাবা এই খুশির খবরটা শুনে বলেছিল, বেয়াই মশাই রাজীবের স্কুলটা কিন্তু আপনাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে হয়ে গেল। রোজ আসা যাওয়া করলে রাজীবেরই কষ্ট হবে বেশি। তার চেয়ে ভালো রাজীব স্কুলের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া করুক।
অপর্ণা দেবী ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলেছিল, বেয়াই মশাই আপনাকে এত ভাবতে হবে না আমার ছেলেকে নিয়ে। আমার ছেলের ভাবনা একান্তই আমাদের।
দিতির বাবা সেই দিন অবাক হয়ে গিয়েছিল অপর্ণা দেবীর এইরকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা শুনে। আর সেই দিনের পর থেকে দিতির বাবা দিতি ও রাজীবের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতো না। দিতির শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় উনি বলেছিলেন, মা রে তোদের ভালো মন্দ ভাবার অধিকার টুকুও রইলো না আমার।
দিতির চোখ দিয়ে গড়িয়ে এসেছিল তপ্ত অশ্রু ধারা। অশ্রু ভারাক্রান্ত গলায় বলেছিল, বাবা সবই আমার কপাল। এমন ঘর, বর তোমরা আমার জন্য ঠিক করলে যে আমাকে সারা জীবন মাথা নিচু করে থাকতে হবে। শুধু শ্বশুর, শাশুড়ি খারাপ হলেও স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়। কিন্তু তোমাদের জামাই-এর কাছে তার মা বাবা দেবতূল্য। মায়ের কোনো অন্যায় ওর চোখে পড়ে না।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আবার চোখটা ভিজে উঠলো। চোখের জলটা না মুছেই দিতি ওর পেটে হাত বুলাতে লাগলো আস্তে আস্তে। এখন সে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নানা রকমের কম্প্লিকেশন থাকার জন্য দু’ দুবার মিস ক্যারেজও হয়ে গেছে।
এইবার ডাক্তার বলেছেন, সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দরকার দিতির। বিছানা থেকে ওঠা একদম নিষেধ। কোনো রকমে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে স্নানটা করছে সে। তাও নিজে নয়। রাজীব স্কুলে বের হবার আগে দিতিকে স্নান করিয়ে দিয়ে যায় রোজ। তারপর নিজে হাতে টিফিন খাইয়ে নটার মধ্যে স্কুলে বেরিয়ে পড়ে। দুপুরে বিছানায় কোনো রকমে বসে ভাতটা খায়। অপর্ণা দেবীই দুপুরের খাবারটা খাইয়ে দেন। তারপর একটা ছোট বালতিতে মুখ হাত ধুইয়ে দেন দিতির। প্রথম দিন দিতি কিছুতেই পারছিল না মুখের কুলকুচির জল বালতিতে ফেলতে। অপর্ণা দেবীই বলেছিলেন, বৌমা কোনো অসুবিধা নেই আমার। তুমি নিশ্চিন্তে কুলকুচি করতে পারো। তোমাকে এখন ডাক্তারের কথা মতো চলতে হবে যে।
এইসব পুরানো কথা ভাবতে ভাবতে দুধের গ্লাসটার কথা ভুলেই গিয়েছে দিতি। তার মায়ের গলার আওয়াজে স্তম্ভিত ফিরে এলো, কি রে এখনও দুধ টা শেষ করিস নি?
দিতি ওর মায়ের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলে, মা একটা কথা সবসময় মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুতেই সঠিক উত্তরটা পাচ্ছি না।
দিতির মা অনুভা বলে, কি কথা রে?
-এই যে আমার স্বামী, শাশুড়ি সবাই এতো খেয়াল রাখছে আমার আজকাল। এর তো একটাই কারণ আমি ওদেরকে বংশধর দেবো ।তাই না?
অনুভা মোটা দাঁড়ার চিরুনি দিয়ে দিতির চুলটা আঁচড়ে দিতে দিতে বলে, সব কিছুর পিছনে রহস্য খুঁজতে যাস না দিতি। রাজীব আজ তোর যে খেয়াল রাখছে তা শুধুই কি কর্তব্য এর মধ্যে ভালোবাসা নেই বলতে চাইছিস?
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিতি বলে, সেটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি মা। রাজীব আজ পর্যন্ত কোনদিন শব্দে প্রকাশ করে নি ওর ভালোবাসা।
-যতদিন যাবে ঠিক বুঝতে পারবি তুই। রাজীবের ভালোবাসার ধরণটা হয়তো তোর সাথে মেলে না। তাই বলে সে ভালোবাসতে জানে না সে কথা বলা উচিত নয়। রাজীব যে ভাবে তোকে বুকে আগলে রেখেছে তা আমার কল্পনার অতীত।
চাইলেই রাজীব এবং তোর শাশুড়ি কিন্তু তোকে আমাদের ওখানে পাঠাতে পারতো।আমি তো অনেক বার অনুরোধ করে বলেছিলাম, দিতিকে আমরা নিয়ে যাই। তখন তোর শাশুড়ি বলেছে, না বেয়ান। সেটি হবার জো নেই। রাজীব বলে দিয়েছে, আমার বউ আমাদের কাছেই থাকবে। আর এইখানেই ডেলিভারি হবে। যা সেবা শুশ্রূষা করার দরকার পড়বে আমরাই করবো।
একটু থেমে অনুভা বলে, এরপরও তুই বলবি রাজীব তোকে ভালোবাসে কিনা তুই ঠিক বুঝতে পারছিস না?
দিতি ওর মায়ের কথাগুলো শুনে, ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। তারপর বালিশে মাথাটা দিয়ে তার মাকে বলে, বাবাকে বলো আমার জন্য তার আর দুঃশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।