মাথা গরম
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
মহুয়ার বিয়ে হয় এক ব্যবসায়ী পরিবারে। পরিবারের ছোট বৌ সে। ওর বর ধীমানের আলাদা ব্যাবসা। ধীমানের বড় দাদা বিমান পারিবারিক ব্যাবসাই দেখাশুনা করে।
মহুয়ার শাশুড়ী চুপচাপ মানুষ…শ্বশুর একসময় না’কি খুব রাগী ছিলেন। তবে বয়সের ভারে এখন আর সেই রাগ নেই…চুপচাপই থাকেন এখন… তবে শাশুড়ীমা এখনো ওনাকে বেশ ভয়ই পান।এখনো রান্নায় একটু এদিক ওদিক হলে খাবেন না…শাশুড়ীমাকে কোথাও যেতে দেবেন না। এসব আগের মতই আছে। আর রাগের দায়ভার এখন বর্তেছে দুই বউ -এর উপর… কারণ তারাই এখন সংসার সামলাচ্ছে। একটু ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটলেই উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। বৌরাও তটস্থ থাকে সবসময়।
মহুয়া শ্বশুরবাড়িতে এসেই বুঝলো এটা রাগের বাড়ি… বাড়ির ছেলেদের রাগ যেন নাকের ডগায়। আর সেটা বাড়ির দুই ছেলে যে উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে তা বুঝতে একটুও বাকী নেই ওর। বাড়ির পুরুষেরা বোধহয় ভাবে –রাগ দেখানোটাই পুরুষত্বের লক্ষণ! বৌদের প্রথম থেকেই রাগ প্রকাশ করে ভয় দেখিয়ে রাখলে তারা আর বাড়তে পারবে না…অর্থাৎ ওদের কন্ট্রোলে থাকবে। বড়বৌয়ের উপর এ পরীক্ষা করে ভালোই ফল মিলেছে। এবার ছোট বৌ-এর পালা। কিন্তু এরা তো জানে না ছোটবৌ বাঘা তেঁতুল!
বিয়ের পর বরকে ফেরার পথে শাড়ীর দুটো ম্যাচিং ব্লাউস এনে দিতে বলেছিলো মহুয়া। ব্লাউস এনে প্যাকেটটা মহুয়ার হাতে দিতে ও সেটাকে বাইরেই রাখলো…পরে আলমারীতে তুলে রাখবে ভেবে। তারপর নানা কাজে ভুলে যায়। দু’দিন ওটা বাইরে পরে আছে দেখেই… ধীমানের মাথা গরম! এত কষ্ট করে বউয়ের জন্য কিনে এনেছে আর সে কী’না সেটা অবহেলায় বাইরে ফেলে রেখেছে! ক্রোধে চিৎকার করে উঠে মহুয়াকে বললো- দাও, ওগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে নর্দমায় ফেলে দেবো। অতর্কিত এই চিৎকারে নতুন বউ মহুয়া একটু অবাকই হয়… প্রথমটায় থতমত খেলেও পরে মুখে একটা কথাও না বলে, গটগটিয়ে হেঁটে গিয়ে ব্লাউসের প্যাকেটটা বরের হাতে দিয়ে বলে- “নাও ছেঁড়ো। তোমার কষ্টের টাকায় কেনা… তুমি ছিঁড়বে না তো কে ছিঁড়বে?” ধীমান অবাক চোখে বৌয়ের দিকে তাকালো। ওর চিৎকার যে বউয়ের মনে একটুও ভয় জাগাতে পারলো না… এটা দেখে একটু যেন বিমর্ষই হলো। রাগের ভাব দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
এমনই বারবার হতে থাকলো… মুখে কথা বলে না কিন্তু কাজে করে দেখায়… এক তুড়িতে রাগের ভয় উড়িয়ে দেয়।
বর ভাসুর একবার বড় জায়ের উপর রাগ করে চালের ড্রাম থেকে চাল নর্দমায় ঢেলে দিলো। বড় জা চোখে জল নিয়ে পরিষ্কার করতে যেতেই মহুয়া বাধা দিলো- বললো দিদি, ওনাদের পয়সায় কেনা চাল নর্দমায় ওনারাই ঢালছেন…পরিষ্কার ওনারাই করবেন। তুমি কোরো না। আর আজ ভালোই হলো ভাত রান্না করতে হবে না… সবাই উপোস দিক…চলো তুমি আর আমি সিনেমা দেখে বাইরে খেয়ে ফিরবো। হিসেবমত রাগ দেখিয়ে বাড়ির ছেলেরাই বাইরে খায় আর ঘরের বউরা উপোস দিয়ে চোখের জল ফেলে। এ যেন এক উল্টো পুরাণ!! পরে নর্দমা ভাসুরকেই পরিষ্কার করতে হয়েছিলো। মহুয়া বড়জাকে হেসে বলেছিলো- দেখলে, যেমন কর্ম তেমনি ফল।বড়জা মৃদুলা বলেছিলো- চুপ কর, চুপ কর।
সেদিন কী একটা কথায় উত্তেজিত হয়ে নিজের ভাতশুদ্ধ খাবার থালা ছুঁড়ে মারলো ধীমান… ভাত ডাল মাছ সব টেবিলে, মাটিতে ছড়িয়ে একাকার! বাকী যারা খাচ্ছিলো তাদেরও খাওয়া প্রায় পন্ড। এবারও বেশ জোরের সাথে প্রতিবাদ করলো মহুয়া বললো- অন্যের খাওয়া নষ্ট করার অধিকার কে দিয়েছে? ভদ্রতা জানা নেই? নিজে না খেলে উঠে চলে গেলেই তো হয়! এই নোংরা আমি পরিষ্কার করবো না… কেউ করবে না…এরকমই থাকবে অসভ্যতার প্রমাণ হিসেবে।
শাশুড়ী বললেন- তোমাকে কি বাড়ির লোক কিছুই শেখায়নি…বাড়ির ছেলেদের বাইরে কত কাজের চাপে মাথা গরম থাকে…তাদের খাওয়ার সময় উত্তেজিত না করলেই তো হয়।
এবারে মহুয়া আরো রেগে গিয়ে বলে-আপনাদের এই প্রশ্রয়েই তো আজ এই অবস্থা! সভ্যতা ভদ্রতা শেখাতে পারেননি। ওরা বাইরে খাটছে আর আমরাও তো ঘরে উদয়াস্ত খেটে চলেছি।
পরেরদিন কাজে যাবার আগে খেতে গিয়ে ধীমান দেখলো টেবিল সেরকমই নোংরা পরে আছে…মনে মনে লজ্জিত হলো সে৷ ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে ওর সামনেই মহুয়া সব শুকিয়ে যাওয়া এঁটোকাঁটা পরিষ্কার করলো…ওর সাথে হাত লাগালো ধীমান… যতই হোক নিজের বিয়ে করা সুন্দরী বউ। বেশী রেগে থাকলে নিজেরই ক্ষতি। হাত লাগিয়ে বুঝলো কাজটা সহজ নয়।
এভাবেই শিক্ষা!
ধীমান বোঝে অত অল্পেতে মাথাগরম করা.. রাগ দেখানো ঠিক নয়। বরং ক্ষণিকের রাগকে কীভাবে প্রশমিত করা যায় সেটাই শেখার। আজকাল ইউটিউবে নানা ভিডিওতে এসবই শেখায়। আসলে ক্রোধও ষড়রিপুর এক রিপু। আর রাগের বশে মানুষ সেকেন্ডের মধ্যে কত খারাপ কাজ করে বসে। রাগ হলে সেইজায়গা থেকে চলে যেতে হয়…একশ থেকে উল্টো দিকে গুনতে হয়… জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয় ছাড়তে হয়…প্রাণায়াম করতে হয়…এমনকি ডাক্তার অবধি দেখাতে হয়!! ও মনে মনে ঠিক করে আজ থেকেই নিজেকে শুধরোবে।
শাশুড়ীমা মহুয়াকে বলেন- তোমার পুলিশ হওয়া উচিত ছিলো।
মহুয়া বলে- আমার মামা পুলিশ… শ্বশুড়বাড়ির কারুর বেচাল দেখলেই কেস দিয়ে দেবো।
সবাই হাসে ওর কথায়।
ও গম্ভীরমুখে বলে- মোটেই হাসির কথা বলিনি, এখন কিন্তু বাড়ির বৌদের জন্য আইন শক্তিশালী। তাই সবাই সাবধান, নয়তো অত্যাচারের কেসে জেলের ঘানি টানতে হবে- ভাসুর,শ্বশুর,বর, শাশুড়ী সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ জোরে জোরেই কথাগুলো বলে মহুয়া।