মন
-শচীদুলাল পাল
জগতের সবচেয়ে দ্রুতগামী হলো মন।
এই মুহুর্তে এখানে, পরমুহূর্তে দিল্লি বা আমেরিকায় এমনকি মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে যায়।
আমাদের যখন কোনো বিষয়ে লিখতে বলা হয়, তখন সেই বিষয়ের অনেক গভীরে প্রবেশ করি। সেই বিষয়ের মন সাগরের অতল জল থেকে সেরা মণিমুক্তাদি সংগ্রহ করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি।
বিকশিত মন:-
মনের তিনটি স্তর। প্রথম স্তরটি হলো মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা আর বুঝতে না পারা যে সে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সচেতন না হওয়া। এক ভ্রান্তিতে থাকে। বুঝতে পারে না তার ধারণাটা ভুল।
দ্বিতীয় স্তরে বুঝতে পারে মায়ার বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। কষ্টের কারণ হলো এই মায়ার বাঁধন।
তৃতীয় স্তরে সে বুঝতে পারে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত। মায়া দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বুঝতে পারে মায়া তার কিছুই করতে পারবে না।
দ্বিতীয় স্তরে বুঝতে পারে কোনো বিশেষ ব্যক্তি সম্বন্ধে যা ভেবেছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যা ভেবেছিল তা সেরকম নয়। তার থেকে বের করে আনা যায় না।
মন আহারের দ্বারা, পরিবেশের দ্বারা, যে সময়ের মধ্যে যাচ্ছে সেই সময়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
কখনো কখনো জীবনে এমন পরিস্থিতি আসে তখন আবেগের ঝড়ের ভিতর পড়ে যায়। সময়, খাদ্য আর পরিবেশ এই তিনটির প্রভাব থাকে মনের উপর।
অন্যকে দোষ দেওয়া মনের এক অস্বাভাবিক রূপ। এই স্বভাব সবার মনেই থাকে। অনেকে আবার নিজেকে দোষ দেয়।
এই দুটি স্বভাব থেকে মুক্ত করে জেগে উঠতে হবে। সচেতন হতে হবে।
কাউকে দোষ দিলে যেমন তার সাথে থাকতে পারে না তেমনই নিজেকে দোষ দিয়ে নিজের সাথেই থাকতে পারে না। আত্ম বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজেকে দোষ না দেওয়া।
তা বলে অন্যকে দোষ দেওয়া চলবে না। নিজের সব ভুলকে সমর্থন করা স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করা এক্কেবারে উচিত নয়।
মনের গভীরে শান্তি পেতে হলে বিশ্রাম আর কর্মের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে।
বিশ্রাম মানে শরীর বিছানায় এলিয়ে দেওয়া নয়। ভাবতে হবে আমি সন্তুষ্ট, আমি তৃপ্ত। কেবল তৃপ্তিই শান্তি দিতে পারে। কোনো কাজে নিযুক্ত থেকে এই মানসিক সন্তুষ্টি দিতে পারে না।
কেবল প্রজ্ঞায় দিতে পারে মানসিক তৃপ্তি।
জীবনের যথার্থ জ্ঞান হলো
১.সবকিছুই অস্থায়ী,
২.আমি পরিতৃপ্ত,
৩.আমার কিছুই চাইনা।
এই তিনটিই হলো প্রজ্ঞার নির্যাস।
ক্ষমা করতে শিখতে হবে। মন যখন বিদ্বেষকে আর ধরে রাখতে পারে না, ঘৃণা করবার যন্ত্রণাকে আর সহ্য করতে পারে না, ক্রোধকে আর বইতে পারে না তখন ক্ষমার ভাব মনে এসে যায়।
নীরব মন:-
মনের ভাবনাগুলো তাদের নিজেদের উদেশ্যে নয়। তাদের লক্ষ্য হলো নীরবতা। শ্বাসের সঙ্গে যে প্রার্থনা হয়, সেই প্রার্থনা নীরব।অন্তরের মধ্যে যে ভালোবাসা সে ভালোবাসা সেও মৌন। নিঃশব্দ প্রজ্ঞাও মৌন। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া দয়ামায়া, সেও নীরব।কর্তাবিহীন কর্মের সাধন হয় নীরবতায়।সম্পূর্ণ সত্তাময় যে হাসি সেই হাসি নীরব।
চেতনার বিকাশ থেকে মনের শান্তি আসে।
মন ভালো রাখতে হলে নিজের মুখের হাসিকে সহজলভ্য করে তুলতে হবে।
সাধারণত আমরা অন্যের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করি। হাসিকে লুকিয়ে রাখি। এর উল্টোটা হওয়া উচিৎ। ক্রোধকে সম্বরণ করে হাসিকে উপহার দিতে হবে।
হৃদয় সব সময় পুরানোকে চায় আর মন চায় নতুনকে। জীবন এই দুইয়ের সমন্বয়। প্রত্যেক বছর যেন জীবন পুরানো জ্ঞান আর নতুনত্বে ভরে দেয়। জীবনে এই দুটিরই প্রয়োজন।
সৎসঙ্গ:-
যখন মানুষ সৎসঙ্গে আসে তখন তাদের সবার মনে যত বোঝা থাকে সব দূর হয়ে যায়।তারা তাদের মনকে অতিক্রম করে এক আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হয়। আর ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
মন সাকার নয়- অমূর্ত। অর্থাৎ মনের কোনো নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। মন কোনো ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তুও নয়।
বাইরের জগতের বিভিন্ন অনুভূতি আমরা গ্রহণ করি পঞ্চেন্দ্রিয় মাধ্যমে। এই পঞ্চেন্দ্রিয় হলো চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। এই পঞ্চেন্দ্রিয়র মধ্যে কোনোটির সাহায্যেই মনকে আমরা জানতে পারি না। যদিও গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ইন্দিয় সমূহের মধ্যে আমি হলাম মন। অর্থাৎ সে অর্থে মন যদি ইন্দ্রিয় হয় তবে সে পঞ্চেন্দ্রিয়র বাইরে অন্য কোনো ইন্দ্রিয় বা বিশেষ ধরনের অনূভুতি বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।
ধ্যান:-
ধ্যান প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব–
মানুষের সব দুঃখ কষ্ট যাতনার মূলে রয়েছে -মনের আলতু ফালতু ভাবনা। অকারণে অযথা চিন্তা করা। মনের স্বভাব হচ্ছে এটা সেটা চিন্তা করা। এর ফলেই মনের স্বাস্থ্য দূর্বল হয়,অবসন্ন হয়। তার ফলেই রোগ যাতনা অশান্তি জন্ম নেয়। মানুষ নিরানন্দ হয়ে পড়ে। তাহলে উপায় কি? মনকে কিন্তু শিক্ষা দেওয়া যায়। মনকে একমুখী করা যায়। মনের আসল রূপ কিন্তু খুবই মনোরম। খুবই উদার খুবই বিশাল। যে শিক্ষা দ্বারা মনকে বশ করা যায় সেটি হচ্ছে ধ্যানযোগ। ধ্যানযোগ করলে মন একমুখী হয়। শান্ত হয়।রাগহীন হয়। এক অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায়। এই আনন্দ থাকলে রোগ দুঃখ হয় না।হলেও তা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করা যায় এই ধ্যানযোগের দ্বারা।
মন তার নিজের সৃষ্ট কুট কাচালি, ভ্রম ও অবাস্তবকে প্রশয় দেয়। কিন্তু ধ্যান মানে হচ্ছে চিন্তা থেকে মুক্তি।
একজন মানুষ যখন যথেষ্ট পরিণত তখন সে বুঝতে পারে তোষামোদে তুষ্ট হওয়া বা অপমানিত হওয়া সবই হলো মনের অহং ও স্বার্থপরতারই প্রকাশ। সুতরাং এগুলোতে তার কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ারই কথা।
মনকে ভালো রাখার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় ধ্যান।
কিন্তু দেখা যায় ধ্যান করার সময় নানান বিকার এসে জ্বালাতন করে। কামনা, লোভ, কারুর প্রতি রাগ, ঈর্ষা, কারোর প্রতি অনুরক্তি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
এগুলো জয় করতে হলে প্রত্যাহার সাহায্য করে। প্রত্যাহার মানে-
ঠিক আছে এই মুহুর্তে আমি কোনো কিছুর গন্ধ নিতে চাই না। এই মুহূর্তে আমি কোনো সুস্বাদু জিনিষের স্বাদ গ্রহণ করতে চাই না। এই মুহুর্তে আমি জগতের কোনো কিছু দেখতে চাই না। এমনকি এখন আমি কোনো পরোয়া করি না কোনো সুন্দর শব্দের। আমি কোনো স্পর্শের অনুভুতিও পরোয়া করিনা।
এইভাবে আমরা মনকে পঞ্চন্দ্রিয় থেকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে আনি। তখনই জাগতিক মায়ার ভ্রম থেকে মুক্ত হওয়া যায়।সুতরাং ধ্যান সফল হয় তখনই এইসব কৌশল দ্বারা মনকে ফিরিয়ে আনে। ধ্যান সফল হয়।
অনেক জটিল ব্যাধি সৃষ্টি হয় না ধ্যানযোগের ফলে। মন পবিত্র হয়। শান্ত হয় তাই নয় বহু রোগ ভালো হয়। সাময়িক রাগের ফলে বহু মানুষ হার্ট স্ট্রোকে মারা যায়। এমন ঘটনা অনেক। ধ্যানযোগের ফলে তাদের অন্তত হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হবে না।
জগতে সুখ, ভালোবাসা, আনন্দ আসবে। মানুষের মন মধুময় হবে।
সবরকম প্রতিকূলতা, ঋণাত্মক দিক নিয়েও মানুষের মন মধুময় থাকবে এমনই শক্তিধর এই ধ্যানযোগ।
অনেক সময় দেখা যায় কিছু কথা অন্যায়ভাবে বললো বা অপমান করলো। এর জন্য রাগ হলো। এর ফলে স্নায়ু থেকে এক উত্তেজক রস বেশি পরিমানে বার হবে। এই রস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্ষতি ডেকে আনবে। এই অঙ্গগুলি দূর্বল হয়ে পড়বে। এই ক্ষতিকে ঠিক করতে শান্তরসের দরকার হয়।আর এই শান্তরস বের করতে হলে চাই মনের ব্যায়াম। আর এই মনের ব্যায়ামই হলো ধ্যানযোগ।
ভালোবাসার ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়
মন ও হৃদয়ের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও হৃদয় তাকে গ্রহণ করতে পারে না। আবার হৃদয় চাইলেও মন তা গ্রহণ করতে পারে না।
সাহিত্যিকদের মনটাই আসল রাজা। গল্পের গরুকে গাছে চড়িয়ে দিতে পারে। তারা পাথরে ফুল ফুটিয়ে দিতে পারে।
মনের শক্তি বা ইচ্ছাশক্তি থাকলে ঝড় জল তুফানের মধ্যেও বেরিয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌছাতে পারে। আবার মন না চাইলে শুয়েই থাকে। সেই-
” বুঝলে নটবর, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না। “
পূর্বে রাজকন্যারা স্বয়ংম্বর সভায় যাকে ইচ্ছে তার গলায় মালা পরিয়ে দিত। এখন স্বয়ংম্বর সভা না থাকলেও যাকে মনে ধরে প্রেম প্রস্তাব করে বিয়ে করা যায়। বিপরীতে ঘৃণা মনেই সৃষ্টি হয়। আবেগ, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার জন্ম হয় মনে। মন থেকে হৃদয়ে।
মানব সত্তা বড় বিচিত্র। অনেক সময় বা কোন কোন সময় মন এমন কিছু পেতে চায় যা বিবেক সমর্থন করে না। অর্থাৎ মানব সত্তা একক নয়। মানুষের দুটো সত্তা রয়েছে। একটি দেহসত্তা, অপরটি নৈতিক সত্তা। দেহ হলো বস্তুসত্তা। দুনিয়াটাও বস্তুসত্তা। বস্তুজগতের কতক উপাদানেই মানব দেহ গঠিত। তাই বস্তুজগতের প্রতি মানবদেহের প্রবল আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। এ পৃথিবীতে ভোগ করার মতো যা কিছু আছে তাই দেহ পেতে চায়। দেহের মুখপাত্রই হলো মন। দেহ যা চায় তাই মনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সুতরাং, মন যা চায় তা দেহেরই দাবী।
মন কোনো সময় খালি থাকে না। চেতন বা অবচেতন মনে কিছু না কিছু সে চিন্তা করেই চলেছে।
মানসিক বা মনের রোগ:-
মনের রোগ হচ্ছে রোগীর অস্বাভাবিক আচরণ, অস্বাভাবিক জীবন-যাপন যা মস্তিষ্কের রোগের কারণে হয়। যার জন্য স্বাভাবিক পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত জীবন ব্যাহত হয় অথবা রোগী তীব্র মানসিক যন্ত্রণা বা অস্বস্তিতে ভোগে।
মন থাকে মস্তিষ্কে। মনের সাধারণত ৩টি অংশ। ক) সচেতন মন খ) অচেতন মন গ) অবচেতন মন। সচেতন মন, মনের মাত্র ১০ ভাগ। মনের ৯০ ভাগ জুড়ে রয়েছে অচেতন বা অবচেতন মন।
মানসিক রোগের প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায় নি। বিভিন্ন কারনে মনের রোগ হতে পারে।
তবে কারণগুলোর মধ্যে জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব, পরিবেশগত প্রভাব, শারীরিক মানসিক যৌন নির্যাতন, অস্বাভাবিকভাবে শিশুর লালন-পালন, ইন্টারনেট সহ অন্যান্য নেশা দ্রব্যের ব্যবহার, মস্তিষ্কের গঠন জনিত সমস্যা, নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাব, দীর্ঘমেয়াদী অস্বাভাবিক চাপ, এছাড়া মৃগীরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকস্, ব্রেন ইনজুরি, ব্রেইন টিউমার, কিডনি, যকৃত, হৃদপিণ্ডের ফেইলিয়রও মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।
পরিশেষে– সুস্থ মনই সুস্থ শরীর প্রদান করে দীর্ঘজীবন দান করে।