জ্ঞাতি ধর্ম
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
গুরুদেব, কী করা যায় বলুন দেখি, আর যে পারি না। জ্ঞাতিগুষ্টির অত্যেচারের ঠ্যালায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি।
-কী করতে চাস?
-কিচ্ছু করতে চাই না। শুদ্ধু রেহাই পেতে চাই।
-কী থেকে রেহাই! জ্ঞাতিগুষ্টি নাকি অত্যাচার?
-আজ্ঞে নাজেহাল অবস্থা থেকে।
-বড়োই মুশকিল;
-এই সেরেছে; কেন গুরুদেব! কিসে আটকাচ্ছে?
-দাঁতে। কচি পাঁঠার ঝোল ভাত খাওয়ালি যে, তারই টুকরো-টাকরা যাক গে, শোনো বাবা, আসলে ব্যাপার কী জানো, জাগতিক কারণেই জ্ঞাতি সর্বদাই দুর্যোধন গোত্রীয় যাঁতি ধর্মী।
-আহা, আহা, কী শোনালেন গুরুদেব। মধুর বাণী। এক্কেবারে ঠিক কথা। স্বভাব যায় না ম`লে।
-এই তো কেমন সুন্দর বুঝেছ। রতনে রতন চেনা কেস কিনা,
-মানে?
-সে তোমার জ্ঞাতি, অর্থাৎ তুমিও তার জ্ঞাতি, ঠিক কি না?
-তা অবিশ্যি ঠিকই, কিন্তু,
-আরে বাবা আমড়া গাছে কি আম ধরে? সেখান যে রক্ত তোমাতেও সেই একই রক্তধারা।
-তাহলে উপায়?
-উপায় যাঁতি। জ্ঞাতি ঠেকাতে যাঁতির জুরি নেই।
-ওভার বাউন্ডারি হয়ে যাচ্ছে গুরুদেব। জলবৎ তরলং হলে বুঝতে সুবিধে হয়।
-এ-ই হলো তোদের সমস্যা। টাকা আছে ষোল আনা, লোভ আছে আঠারো আনা, হিংসে আছে বত্রিশ আনা অথচ বিদ্যে নেই এক আনা।
-(মনে মনে) বিদ্যে নেই বলেই তো গুরুদেব পুষছি গাদা খানেক দানদক্ষিণা দিয়ে। সঙ্গে প্রণাম টোনাম সব উপরি। নেহাৎ পারিবারিক পুরনো পরম্পরা, নইলে কে পোঁছে তোকে…
(মুখে) তা-ও ঠিক। কিন্তু গুরুদেব সেই একই দোষ তো ওদিকেও রয়েছে, তাহলে?
-হা হা হা হা, দুই ষাঁড়ের লড়াই দেখেছিস কখনও। গোদা শরীর, আর মাথায় মোটা শিঙের ঠোকাঠুকিতে মরণপণ যুদ্ধ। একটা শুয়ে না পড়া পর্যন্ত রেহাই নেই।
-শান্তি কি নেই গুরুদেব?
-হা হা হা হা, একবার একজন শান্তিকামী সমাজকর্মী দু’টো যুদ্ধরত ষাঁড়ের কানের কাছে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি গানের কলি শোনাতে গেল-
“তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল..”
গোড়ায় গোড়ায় তেমন গা করেনি ষাঁড় দুটো। হঠাৎ শিঙ বাগিয়ে দিলো গুঁতো। ব্যস, এক গুঁতোতেই শান্তিকামীর চিরশান্তি প্রাপ্তি। হরিবোল হরিবোল।
-তাহলে লড়াই চলবে বলছেন?
-একপক্ষ শুয়ে না পড়া পর্যন্ত।
-তাহলে যাঁতির ব্যাপারটা?
-আরে এখনো বুঝলি না?
-যাঁতির দুটি অংশ। ওপর দিকে ধারালো অংশ নিচের দিকে ভোঁতা। ঐ দুয়ের মাঝখানে সুপুরি বসিয়ে যাঁতির ওপর আর নিচের হাতলে মার চাপ একসঙ্গে। কট আওয়াজ। কঠিন সুপুরি একেবারে দু’ফাঁক। আর বিবাদ নেই। ধারালো আর ভোঁতা এক হয়ে মিশে আছে। যাঁতি আর জ্ঞাতির স্বভাব, দু’ভাগ না করে বিশ্রাম নেবে না।
হরি হে মাধব, চান করবো না, গা ধোবো।