বাবা, বেঁচে আছেন
-সুনির্মল বসু
কথাটা প্রথম কোথায় কার কাছে শুনেছিলেন, আজ আর মনে করতে পারেন না, অথচ, কথাটা মনে ধরেছিল তাঁর, সেই থেকে লেখালেখির শুরু। কথাটা ছিল, প্রকাশ কি ঔর।
মাটি কামড়ে পড়ে থেকে কবিতা লিখতো লোকটা। তাঁর ডায়েরি, খাতা ভরে যেত অজস্র লেখায়। আকাশের রঙ, নদীর ঢেউয়ের জল তরঙ্গ, অরণ্য পাখির গান, বন শিরীষের মর্মর ধ্বনি, সমুদ্রের দূরাগত ধ্বনি, লোকটার লেখায় উঠে আসতো। সংসারের প্রতি ক্ষেত্রে পরাজিত লোকটা পাতার পর পাতা অজস্র লিখে যেত। সবাই বলতো, লিখে কি হয়। কেউ কেউ বলতো, আপনার লেখায় বাস্তবতার ছোঁয়া নেই।
একসময় লোকটার নিজের মনে হয়েছিল, সত্যি সত্যি লেখার জন্য তাঁর এই আত্মত্যাগের হয়তো কোনো মূল্য নেই। শুধু শুধু কালি কলমের অপব্যবহার। তবুও না লিখে উপায় ছিল না তাঁর, রক্তের মধ্যে সৃষ্টির নেশা জেগে থাকলে, বারবার লেখার টেবিলে ফিরে আসতে হয়, সেভাবেই প্রতিদিন সৃষ্টির নেশায় মগ্ন চৈতন্যে জেগে থেকেছেন তিনি।
সংসারে অভাব ছিল, দারিদ্র প্রতিদিন সকালে দরোজায় এসে দাঁড়াতো, টালমাটাল সংসার, প্রতিদিনের জীবনধারণের গ্লানি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতো, এসব আপনার জন্য নয়।
তাহলে লিখে লাভ কি, থেমে যাওয়াই ভালো।
গগনদা বলেছিলেন, লিখে যা, কে কি বললো, তাকাস না, মহাকালের জন্য রেখে যা, কাল একদিন বিচার করবে।
রাত জেগে তিনি লিখতেন, ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে তিনি লিখতেন। তাঁর মেয়ে লিপি তখন ছোট।
সে প্রায়ই অনেকের মুখে শুনতে পেত, সংসারের প্রতিক্ষেত্রে তাঁর বাবার ব্যর্থতার কথা।
আমাদের উনি তিনখান বাড়ি করেছেন, আপনি তো কিছুই করতে পারলেন না।
বাবার এই ব্যর্থতা ছোটবেলায় লিপিকে কষ্ট দিত। বাবা আজ নেই। তাঁর কবিতার বইগুলো রয়েছে।
লিপি এখন কলেজে পড়ে। আজ তাঁর বাবার জন্মদিন। আজ নানা জায়গায় তাঁর বাবার স্মরণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। লিপি আলমারি থেকে বাবার কবিতার বই বের করে পরম মমতায় কবিতা পড়ছে।
চিরকাল শুনে এসেছে, বাবা একজন সংসারের ক্ষেত্রে ব্যর্থ মানুষ। আজ বড় হয়েছে লিপি। কে বলেছে, তাঁর বাবা পরাজিত মানুষ।
কবিতার ছত্রে ছত্রে কত অনুভবের ঢেউ বয়ে গেছে, কী আশ্চর্য মায়া জগতের সন্ধান রয়ে গেছে এই সব কবিতায়। কম কথা বলা তাঁর বাবাটা কী এক আশ্চর্য মায়া জগতের সন্ধান পেয়েছিলেন সেদিন, কেউ তা জানতো না।
লিপির চোখের জল ঝরে পড়ল বাবার কবিতা বইয়ের উপর। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছে, সারা জীবন তাঁর বাবা কিছু করতে পারেনি। আজ লিপি স্পষ্টতই অনুভব করতে পারছে, বাবা নেই বটে, অজস্র লেখার মধ্যে, অনুভূতির আলোড়নের মধ্যে
তাঁর বাবা সেদিনের মতো আজও বড় বেশি করে বেঁচে আছেন।
লিপি বাবার লেখার টেবিলের উপরে রাখা বাবার প্রতিকৃতির দিকে চাইলো।
সেদিনের মতো বাবা যেন হেসে বললেন, মাগো, আমি কোথাও হারিয়ে যাই নি, হালকা উদাস হাওয়ার মতো আমি বারে বারে আসি, বারে বারে চলে যাই। আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো।