নেই তুমি
-বর্ণালী জানা
দুই মেরুর বাসিন্দা বলতে যা বোঝায় ব্রত আর বাণী ঠিক তাই। নামে মিল থাকলে কী হবে অন্য সবকিছুতেই বেজায় অমিল, কিংবা গরমিল! একজন জীবন রসের রসিক। জীবনের সবটুকু ছেঁনে রসটা বের করবেই। সহজে সে দমে না। অন্যের কথা যতই টক হোক না কেন, নিজের মনের মধু মিশিয়ে সেটাকে মিষ্টি করে সে নেবেই। বন্ধুরা তো মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বলে… ‘সব সময় এত হাসিখুশি কী করে থাকিস তুই?’ সে মিটিমিটি হেসে বলে… ‘দুঃখকে নিয়ে আমি ছিনিমিনি খেলব। ভগবান যত দুঃখ দেবে আমি ততই হাসব’
ওদিকে জীবনের প্রতি অভিযোগের অন্ত নেই বাণীর। সারাক্ষণ গজগজ করেই যাচ্ছে। পান থেকে চূন খসলে আর রক্ষে নেই। চেঁচামেচি, জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি, মান-অভিমান, গোঁসাঘরে খিল দেওয়া…সব একেবারে চেইন রিয়াকশনে চলে। ব্রত মজা করে বলে একেবারে নিউক্লিয়ার ফিশন। মেয়েটার জন্মের সময় মুখে মধু তো পড়েইনি… বোধহয় দু-একটা ধানি লংকা গুঁজে দিয়েছিল মেয়ের মা। পরেও মেয়ের প্রতি মায়ের এই মুখনিঃসৃত বাণী অনেকবারই শুনেছে ব্রত… ‘শোন বাণী, পুরুষমানুষদের কিন্তু এক্কেবারে বিশ্বাস নেই। সব সময় টাইট করে ধরে রাখবি। একটু ঢিলে দিলেই হাতের বাইরে’। মায়ের আদেশ মেয়ে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। দিনে দুবার ফোন সার্চ, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর ব্যাগ সার্চ রুটিনমাফিকই হয়ে থাকে। যাক গে সে নিয়ে ব্রতর অত মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বউটার যদি একটু সেন্স অফ হিউমার থাকত! সে নিজে হুল্লোড়বাজ ছেলে… জনম-রসিক। রাম গড়ুরের ছানা হয়ে আর কতক্ষণই বা থাকতে পারে! ঐ যে কথায় বলে না, স্বভাব যায় না মলে। ভুলটা তার বার বার হয়েই যায়।
মাসিই এনেছিল সম্বন্ধটা। মেয়ের বাড়িতে গিয়ে শ্যামলা ঢলঢলে মেয়েটাকে দেখেই ব্রত দশগোল খেয়েছিল। মোহনবাগানকে নিয়ে তার যতই পাগলামি থাক না কেন ইস্টবেঙ্গলের মেয়েতে তার বিন্দুমাত্রও আপত্তি হয়নি। বিয়েটাও হল চটজলদি। ফুলশয্যার রাতেই হল প্রথম ভুল। নতুন বউকে সোহাগ করে বলেই বসলো… ‘আচ্ছা তোমার নাম তো বাণী ভদ্র। আজ থেকে তোমাকে বাণী অভদ্র বলে ডাকব’।
‘কেন বলবে? আমাকে বাণী ভদ্রই বলবে’।
ব্যস, ওখানেই গেল বেলুন চুপসে । তারপর দশ বছর ঠোকাঠুকি করেই নরমে-গরমে দিন কাটছে। ছেলেটা হওয়ার পরে মা বলেছিল… ‘বাবা-মা হয়ে গেলি। এবার তো তোরা একটু খান্ত দে’। কে শোনে কার কথা। একে অপরকে জব্দ করাটা এখন দুজনেরই নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ সূচ্যাগ্র জমিও ছাড়বে না। কথা কাটাকাটি হলেই আগে বাণী ছেলে নিয়ে সাতদিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়ে সেঁধোত। মায়ের কথায় ব্রতকেও তখন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সাধ্যসাধনা করে বউকে ফিরিয়ে আনতে হত। মা আবার নাতিকে না দেখে থাকতে পারে না। পালটা চাল বের করতে অবশ্য ব্রতর বেশি দেরি হল না। এবার একটু পা-পা দিয়েই সে ঝগড়া করে ফেলে। আবার বাণীর চরম হুমকি… ‘আমি কিন্তু এই মুহূর্তে জয়কে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাব’।
‘সে যাও। অনেক দিন তো ওখানে যাওনি। একটু রেস্ট হবে। মাস খানেক থেকো এসো’।
‘মানে? আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ? মানে এই এক মাসে তুমি লীলাখেলা করে বেড়াবে। কী যেন তোমার ঐ বান্ধবীর নাম? ওর সঙ্গে নিশ্চয়ই খুব ফস্টিনিষ্টি হবে?’
‘আরে তা কেন? এখানে এত কাজ, তুমি রেস্ট পাওনা। তাই বললাম। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি ম্যানেজ করে নেব’।
‘না, ভাবছি এখন আর যাব না। জয়ের স্কুল কামাই হয়ে যাবে। পরে না হয় যাব’।
খেলার চালগুলো শিখে নিলে খেলতে দারুণ মজা। বউকে জব্দ করে যে পুরুষোচিত মজা তার স্বাদ এবার ব্রত পেয়ে গেছে। তার এখন শুধু গোল দেওয়ার পালা। অফিসের চায়ের আড্ডায় তো বলেই ফেলে… ‘বুঝলেন দাসদা, এটা যদি রামমোহনের আগের যুগ হত তাহলে আমি ইচ্ছে করে রেল লাইনে গলা দিতাম’।
তা রামমোহনের আগের যুগে রেল লাইন এসেছিল কিনা তা নিয়ে একটু ধন্দে পড়লেও দাস বাবুও দমে যাওয়ার পাত্র নন… ‘তা গলাতেও দড়ি দিতে পারো। কিন্তু মরবেটা কেন?’
‘কেন মানে! তাহলে বউটাকেও তো সতী ওরা করবে। চিতায় পুড়তে পুড়তে তো বউয়ের নাকানি-চোবানিটা অন্তত দেখতে পাব। দেখ, জ্বলার কী মজা!’
দাস বাবু কথা না বাড়িয়ে ফাইলে চোখ রাখেন।
সেবার কিছু কাণ্ড ঘটেছিল বটে পুরুলিয়ায়। ছেলের বায়না বোটিং করবে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও নৌকায় ওঠা। কিছু দূর গিয়েই মহারানির মোক্ষম প্রশ্ন… ‘শোন না…এখন যদি নৌকোটা ডুবে যায়। তাহলে আমার আর ছেলের মধ্যে তুমি কাকে বাঁচাবে?’
‘ছেলেকেই বাঁচাতে হবে’।
‘সে তো আমি জানিই। আমি তো ফেলনা। খুব জানি, শুধু বংশরক্ষার জন্যই বিয়েটা তুমি করেছিলে। আমার ওপর তো কোন টানই নেই। আমিই শুধু তোমাদের সংসারের ঘানি টেনে গেলাম’।
‘আরে না না…তোমাকেই তো বাঁচাতাম। কিন্ত ঘাড়ে কী করে আমি দু-মন গমের বস্তা তুলব বলো তো ?’
‘কী আমাকে মোটা বললে! জানো না আমার থাইরয়েড। তোমরা পুরুষ মানুষেরা কী সেটা আমার বুঝতে বাকি নেই। তোমরা শুধু শরীরই বোঝ। অতই যদি রোগা-শিড়িঙ্গে মেয়েদের পছন্দ তাহলে আমাকে বিয়ে করলেটা কেন? ঐ মালবিকা, চৈতালি আর নীলাঞ্জনাকে বিয়ে করলেই পারতে। ওদের দেখেই তো নাল ঝরে তোমার। আমি বলেই এতদিন তোমায় সহ্য করছি। ওরা হলে মুখে একেবারে নুড়ো জ্বেলে দিত’।
‘ধুস তুমি ছাই জানো। তুমি কি জানো চৈতালি আমার জন্য আজও বিয়ে করেনি। ফ্ল্যাটে তো একাই থাকে’।
ব্যস, একদম বেড়ে চাল হয়েছে। চেক-মেট। পালটা আর কোনো চাল না থাকায় মহারানির এবার শেষ অস্ত্র চোখের জল। আকাশের মুখ ভার…তারপর গর্জন…বর্ষণ…সাধাসাধি…মানভঞ্জন…আবর সেই চেইন রিয়াকশন।
তবে অম্ল-মধুর এই জীবনটা খুব-একটা মন্দ লাগে না ব্রতর। এই ঝগড়াঝাটিগুলো তার কাছে স্পাইস অফ লাইফ। ডালে একটু ফোড়নের মতো। কিন্তু বাণীর কাছে একেবারে জীবন মরণের প্রশ্ন।
অফিসের ফাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে দাস’দার সঙ্গে একটু মনের কথা বলে হাল্কা হয় ব্রত।
‘বুঝলেন দাসদা এই উইক এন্ডে ভাবছি একটু সুন্দরবনে যাব। ছেলেকে মায়ের কাছে রেখেই যাব’।
‘বাহ বেশ বেশ। সেকেন্ড হানিমুনটা ভালো করে কাটিয়ে এসো’।
‘ দূর, হানিমুন না ছাই। সুন্দরবন যাচ্ছি কি সাধে। ওখানে নৌকো করে একটু ঘুরতে বেরোবো। তারপর মাঝির সঙ্গে শাট করে দেব মহারানিকে আলতো করে ধাক্কা। বাঘ বা কুমির কিছু একটাতে নেবেই’।
‘দূর তুমি যে কী বল। সবকিছুতেই ইয়ার্কি। একটু সিরিয়াস হতে পারো না’।
অফিসেও কি একটু শান্তি আছে? বাড়ি থেকে বউয়ের দশবার ফোন। এটা লাগবে, সেটা লাগবে। আজ চিতল মাছ চাই, কাল পাবদা, পরশু গলদা চিংড়ি। বউ তো নয় যেন একখানা বেড়াল। সেবার দীঘা গিয়ে অকালের ইলিশ খেতে গিয়ে আটশো টাকা একেবারে গচ্ছা গিয়েছিল ব্রতর। সে তো রাজা-মহারাজা নয়, যে মাসে তিরিশ দিনই চর্ব্য-চোষ্য খাওয়াতে পারবে। একার চাকরি। একটু বুঝেশুনে তো চালাতে হবে। কিন্তু বাণীর সেই এক গোঁ… ‘আর সব কিছু ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু মাছের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করতে পারব না’।
‘তা তুমি কোন লাটসাহেবের বেটি শুনি’।
‘জানো না আমরা চিরকালই অমন ভালো ভালো মাছ খাই। বাংলাদেশে আমাদের কতবড় জমিদারি ছিল জানো না! কত পুকুর! সের সের মাছ’।
‘তা সে জমিদারি তো কবেই ঘুচেছে। আর তুমি তো এখানেই জন্মেছ। তোমার মুখে এত বড়াই মানায় না’।
‘দেখো এটা জিনের ব্যাপার। তুমি বুঝবে না’।
‘খুব শিগগিরি তুমি বিধবা হবে বুঝলে। একদম মাছ খাওয়া ঘুচে যাবে। আমার দুটো পয়সা তো অন্তত বাঁচবে’।
অমনি মহারানির ফুঁপিয়ে কী কান্না!… ‘তোমার মুখে একটুও বাধল না’।
কথাটা তো ঝোঁকের মাথাতেই ব্রত বলে ফেলেছিল। অন্তর্নিহিত অর্থটা সে নিজেও বুঝে বলেনি। বউকে জব্দ করতে হবে তাই বলা। তাছাড়া আজকের দিনে বিধবার নিরামিশ খাওয়ার আচার বিচার আর আছে নাকি? না না, এবারটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে। তারপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুতই ঘটল। একেবারে সিনেমার ফ্রেমের মতো। এবারেও চেইন রিয়্যাকশন। একটার পর একটা। মাঝে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কোভিড। লক-আউট। বাণীর ধূম জ্বর। শ্বাসকষ্ট। হাসপাতালে ছোটাছুটি। তারপর সব শেষ।
বাড়িতে এখন অপার শান্তি। বারান্দায় এখন কাক-চিলের বসতে কোনো বাধা নেই। বুড়ো বয়সে মায়ের ওপর আবার নতুন চাপ। নাতিকে সামলানো, রান্নাবান্না। মা আর পেরে ওঠে না। অনেক দিন পরে সেদিন একটু ভালো করে বাজার হাট হল। মা বলে… ‘যতই শোকতাপ থাক। বাচ্চাটাকে তো একটু ভালো-মন্দ খাওয়াতে হবে’। অনেক দিন পর ভাতের থালায় তেল-কই। কইমাছ ব্রতর নিজেরও খুব প্রিয়। কিন্তু মাছটা আজ আর গলা দিয়ে নামে না।
‘মা, কাল থেকে জয়কেই মাছ দিও। আমাকে আর দিয়ো না’।
বউটা এবারও তাকে দশ গোল দিয়ে গেছে!
আগেও একবার পড়েছি, তোমার পাঠানো link থেকে, কয়েকজনকে শেয়ারও করেছিলাম। প্রত্যেকেই প্রসংশা করেছে। আবার পড়লাম। বিয়োগান্তিক হলেও খুব রসালো। লেখায় ধার আছে।
ভীষণ ভালো লাগলো ।