রম্য- ফুঁ বাবার ফুসমন্তর

ফুঁ বাবার ফুসমন্তর
সুজিত চট্টোপাধ্যায়

-ফুঁ বাবা, একটা প্রশ্ন ছিল।
-ক`রে ফ্যাল। ( ছিলিমে টান দিয়ে )
-বাবা, জীবন কী?
-হা হা হা হা হা, জীবন হলো সময়ের সীমাবদ্ধ কাল।
-আর একটু সহজ করে যদি বলেন। মানে জানেনই তো, ভেজাল খেয়ে খেয়ে একেবারে
-এককথায় আয়ু। আরও সহজ কথায় প্রাণবায়ু। কেউ বলে প্রাণ আত্মা নির্ভর, আমি বলি আত্মনির্ভর। (ধোঁয়া ছেড়ে )
-তফাৎ কী গুরুদেব?
-ওহে বৎস, আসলে তো বায়ু। নাসারন্ধ্রে প্রবেশ এবং বাহির। সেই গর্বিত বায়ু যতক্ষণ হাপড় টানবে আর ছাড়বে ততক্ষণ জীবন।
বায়ু ফুরলো জীবন জুরলো। ( আবার টান)
-বড়ই ক্ষণস্থায়ী গুরুদেব।
-আক্ষেপ থাকবে না, যদি এ-কে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারিস।
-কাকে ফুঁ বাবা, বায়ু কে?
-দূর বোকা। তাকে ব্যবহার করেই তো বেঁচে আছিস, আবার কী?
-তাহলে?
-জীবন, সুখের স্বর্গে বেঁচে থাকার পথ।
-কেমন করে ফুঁ বাবা? পথ দেখান প্লিজ। সত্যি কথা বলতে, নানা মুনির নানা মতের ধাক্কায় আমরা অর্বাচীনের দল একেবারে দিশেহারা। যখন যেটা শুনি সেটাই ঠিক মনে হয়। গোলকধাঁধার চক্কর। পথ বাৎলে দিন প্রভূ।
-দু’টো রাস্তা। একটা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর পথ, অন্যটা সর্বগ্রাসী ভোগের পথ।
– না না স্যার মানে গুরুদেব, আজেবাজে কথা বলে লাভ নেই, পেটে খিদে মুখে লাজ। ওসব সন্ন্যাসী টন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব নয়, মেন্টেইন করা যাবে না। অনেক ঝক্কি, নিয়ম কানুন আচার বিচার অমাবস্যা পূর্ণিমা জপ তপ পুজো, না না তার চাইতে ঐ ভোগের রাস্তার ব্যাপারটা যদি একটু খোলসা করেন কৃপা করে।
-আগে ভোগ পরে ত্যাগ, তাই তো? একেবারে সহজ মসৃণ পথ। শুধু বুদ্ধি খরচ করে দাপিয়ে চলো।
-নট ক্লিয়ার। মানে আর একটু যদি..
-কিচ্ছু নয় শুধু বারফট্টাই মারো, মিথ্যের বুলেট ট্রেন চালাও। লেঙ্গি দাও, অন্যের নামে চুকলি আর নিন্দেমন্দ করে নিজে প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠো। চামচা বাজি করে ধীরে ধীরে ওপরে চড়ে যাও, তারপর সুযোগ সুবিধে মতো গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে একটা ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছে গিয়ে চোখ পাল্টাতে কতক্ষণ?
-তার মানে বেইমানি?
-ওরে, এপথে এটাই দস্তুর। কাজ ফুরলেই পাজি। শোন, গিরগিটি দেখেছিস তো? গায়ের রঙ বদল করে কিন্তু গিরগিটির স্বভাব চরিত্র বদলে যায় না।
– হ্যাঁ, এটা বেশ লাগদাই মনে হচ্ছে। চলবে। এরকম আরও দু’একটা অস্ত্রের সন্ধান দিন গুরুদেব।

-অস্ত্রের শেষ নেই রে, কিন্তু এইসব দিয়ে কী হবে! লক্ষ্য কী?
-লক্ষ্য কী একটা প্রভূ। যতই প্রত্যাশা, ততই লালসা ততই লক্ষ্য।
-আরে মুর্খ প্রত্যাশার অন্ত নেই। অনন্ত কাল ধরেই অন্তহীন। শোন তবে, নেহাৎ সে যুগে অর্থোপেডিক্স সার্জারীর তেমন রমরমা ছিল না, নইলে ভীমের গদার গোঁতা খেয়ে ঊরুভঙ্গ দুর্যোধন ঊরুর বোন ফ্যাকচার সারিয়ে সেকেন্ড চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়ে যেতো। এতো সহজে হাল ছাড়ার পাত্র সে মোটেই ছিল না।
অতো অতো ধনসম্পদ, গোটা একটা রাজ্য হস্তিনাপুর সঙ্গে নবনির্মিত সুদৃশ্য ইন্দ্রপ্রস্থ, ঊরু উন্ডেড হলো বলে যাবতীয় বৈভব ফেলে রণে ভঙ্গ দেবে এটা বিশ্বাস করা মুশকিল নয় কী?
-ঠিকই তো,,,
-কামনা ফুরোয় না রে কামনা ফুরোয় না। ভাগ্যিস ফুরোয় না। কামনা ফুরোলে মন বাগিচার সতেজ পদ্ম শুকিয়ে একেবারে কড়কড়ে মড়মড়ে হয়ে মাটিতে নেতিয়ে পড়ে অবহেলায় গড়াগড়ি যেতো।
-এই তো মাথা সাফ হতে শুরু হয়েছে, সুতরাং বাঁচতে হলে ভেক ধরতে হবে, নাহলে বোকা বুদ্ধু হয়ে ভোটের বাজারে দেওয়াল দখলের সিজিনাল হিরো হয়ে যৌবনের শবযাত্রা দেখতে হবে। অতএব, মিথ্যের পিরামিড সাজাও। মনোলোভা মণিমাণিক্যের বাক্য বপন করো। নাই বা হলো কল্পনার কল্পতরু। নাই বা ধরলো তাতে মণিকাঞ্চন, বয়েই গেল। তোর কার্যসিদ্ধি হওয়া নিয়ে কথা।
-বুঝলুম। কিন্তু ঢপবাজি ধরা পড়তে কতক্ষণ, তখন? পাবলিক মেরে লাট করে দেবে না?
-ধুস, কিসসু হবেনা। পাবলিক এক অদ্ভুত প্রাণী। ওরা ভুলে যেতে ভালোবাসে। প্রতিশ্রুতির মেগা সিরিয়াল। আবার নতুন কেরামতি। পাবলিক হলো হাওয়া নিশানের মুরগী। যেদিকে হাওয়া সেদিকে চোখ। কি হলো, কী ভাবছিস? আরে বাবা পরের কথা পরে ভাববি। যখন যেমন তখন তেমন। এখন তো আখের গুছিয়ে সুখ ভোগ করে নে। দামী দামী স্যুট, কোট, নানান রঙের চোখধাঁধানো পোশাক। বহু মূল্যের বিলাসবহুল বিদেশি গাড়ি, অট্টালিকা, পারলে বিশ্বভ্রমণটাও সেরে ফেলিস। দুনিয়ায় সুখ ভোগের অণুসঙ্গ কি কম রে?
-কিন্তু!
-আবার সেই বোকার মতো কিন্তু কিন্তু করে, দ্যাখো! আরে বাবা সুখ পেতে সাহস চাই। বুকে বল আন, দেখবি সবই সহজ। তাছাড়া জানিসই তো… প্রতিশ্রুতির সহবাস আর পরকীয়াও বর্তমান আইন মোতাবেক অন্যায্য নয়। সুতরাং চালাও পানসি। চুটিয়ে ভোগ করো। নো রিস্ক নো গেইন। সাহসী হও। নির্ভীকতাই জীবনের উন্নতির সোপান।
গলাবাজিতে ফার্স্টক্লাস ফাস্ট হও। নাকের ডগায় কাঁঠাল পাতার টোপ ঝোলাও। লোভ মেশানো টোপ বড়ই কার্যকরী। বিষ মাখানো মাখন রুটি, নেংটি ইঁদুর মুখ দেবেই দেবে। প্রত্যাশার হাতছানি, রেহাই নেই। এ বড়ো সাংঘাতিক ছোঁয়াচে অসুখ। হে মানব জাতি ভুলিও না, যুগে যুগে এই সত্য। বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা।শুটআউট ইজ দি বেস্ট পলিসি।রাইভ্যাল দেখলেই উড়িয়ে দাও। আগুন আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই বৎস। নদীচরের সোনালী বালি বালুকাবেলায় ট্রাক বোঝাই করে পাচার করো। নদী বাঁধের কাটামাটি কাঁচাটাকা হয়ে তোমার কালো আমানতের শ্রীবৃদ্ধি করুক। শ্রী-ঘরের খোদ কর্তার খোসামোদের পাত্র হও। সেই হবে তোমার পাড়ানির কড়ি। কামিনীকাঞ্চন মোক্ষম দাওয়াই। নীলসায়রে কালীয় ফনায় ত্রিভঙ্গ মুরারি হয়ে যদি বাঁশীতে সপ্ত সুরের মূর্ছনায় ভাসতে চাও তাহলে “শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান…” আচার বিচারের মাথায় চড়ে তাতা থৈথৈ নেত্য যদি করতে চাও, হাতজোড় নাটুকে জনহিতৈষীদের জন্যে অম্লমধুর আচারের সুবন্দোবস্ত করো। জেনো তারাই তোমার চৌকিদার। হাইলাইটেড হও।
নিজের ঢাক নিজেই পেটাও। টুইটারে অশ্লীল বাণীর বান শানাও তোমায় রোখে কার বাপের সাধ্যি?
টিভি চ্যানেলে তোমার মুখনিঃসৃত বাণীকে হেডলাইন বানিয়ে প্যানেলে চর্বিত চর্চার মুখরোচক বিতর্কের কফি ঝড় বইবে। পাবলিককে গেলানো হবে। তোমাকে সেলিব্রিটি বানানো হবে। তুমি রাতারাতি এলেবেলে থেকে সেলএবেল হয়ে যাবে।
হা হা হা আর কি চাই?
এইবারে “হাম হ্যায় রাজা” হয়ে সমাজের কেউকেটা হয়ে বুক চিতিয়ে ফুলিয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি করে ব্ল্যাক ক্যাটের ঘেরা টোপে ঘুরে বেড়াও। সুখ সুখ আর সুখ। চারদিকে সপ্ত রঙের অজস্র বুদবুদ উড়ছে ঘুরছে আহা কী বাহার। তুমি যথার্থই জনগনেশের ত্রাস থুড়ি ত্রাতা। নাও সব্বাই উঠে দাঁড়াও, এখন উল্টো পতাকা টাঙ্গিয়ে দেশভক্তিতে গদগদ হয়ে গান শুরু হবে। সমস্বরে বলো সবাই,
জয় ফুঁ বাবার ফুসমন্তর এর জয়।

Loading

2 thoughts on “রম্য- ফুঁ বাবার ফুসমন্তর

  1. আ রে দারুণ দারুণ
    রম্য রচনায় সত্যিই আপনার জুড়ি মেলা ভার ।

Leave A Comment