গল্প- ছল চাতুরী

ছল চাতুরী
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

ঋদ্ধিমার বাসর ঘরটা বেশ জমে উঠেছিল গান, বাজনা আর হাসি ঠাট্টায়। ঋদ্ধিমার বান্ধবী অলি তার কানে কানে বলে, দারুণ একটা হ্যান্ডসাম বর তো জুটে গেছে। এবার আরো ভালো ভালো রোম্যান্টিক কবিতা লিখিস।
লাজুক হেসে ঋদ্ধিমা বলেছিল, ধ্যাত কি যে বলিস। কিন্তু মনে মনে ঋদ্ধিমাও তৈরী প্রেমের সাগরে ডুবে দিতে। সারাক্ষণ আড়চোখে দেখে চলেছে সে অতীনকে।
অতীনের গায়ের রং শ্যামলা হলেও অদ্ভুত আকর্ষণীয় চেহারা। উচ্চতার সঙ্গে মানানসই দেহের ওজন। আর চোখে চশমা থাকলেও তার ভিতর দিয়েই স্বচ্ছ চোখের চাহনিতে বারবার তির বিদ্ধ হচ্ছে ঋদ্ধিমা।
শুভ দৃষ্টির সময় অতীনের চাহনিটা ঋদ্ধিমার হৃদয়ে একেবারে গেঁথে গেছে। আর সেই চাহনির সঙ্গে ছিল একটা মিষ্টি হাসি। যে হাসির মধ্যে ছিল আস্থা আর বিশ্বাসের আশ্বাস।
ছেলেদের দল আর মেয়েদের দল মিলে শুরু করেছিল গানের লড়াই খেলা। এমন সময় বেজে উঠলো রিংটোন ‘মা গো আমার মা আমি তোমারি খোকা’। এই রিং টোন বেজে ওঠা মাত্রই অতীনের মামাতো ভাই তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোনটা বের করে ধরে বলে, হ্যাঁ পিসিমণি বলো?
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, বিয়ের সব পর্ব কখন শেষ হলো?
-ও তো অনেক ক্ষণ মিটে গেছে। আমরা সবাই এখন বাসর ঘরে।
-তা বেশ। ফোনটা অতীনকে একবার দে তো।
অতীনের মামাতো ভাই ফোনটা স্পিকারে দিয়ে অতীনকে দিলো। অতীন ফোনটা ধরে বলে, হ্যাঁ মা বলো?
-কি রে চব্বিশ ঘণ্টা এখনো হয় নি এর মধ্যেই বউকে পেয়ে মা’কে ভুলে বসে আছিস?
অতীন আমতা আমতা করে বলে, মা এতো ব্যস্ত ছিলাম যে ফোন করতে সময় পাই নি।
এবার বেশ ধমকের সুরে অতীনের মা সবিতা দেবী বলে, অনেক হয়েছে সাফাই দেওয়া। সকাল হলেই বৌ নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বি। আমি এখন রাখলাম।
সবিতা দেবীর প্রতিটা কথা ঋদ্ধিমার কানে বিঁধে ছিল কাঁটার মতো। বাইশ বছরের তরুণী, যার চোখে বিবাহিত জীবনকে ঘিরে অজস্র রঙিন স্বপ্ন। সে হঠাৎ কেমন গুটিয়ে গেল অজানা ভয়ে। মনে মনে সে বিস্ময়ে ভাবে, অতীন ওর মা’কে এতো ভয় পায়! বত্রিশ বছরের যুবক, যে সরকারি উচ্চ পদে আসীন, যার ব্যক্তিত্ব বেশ প্রকাশ পায় তার উজ্জ্বল মুখাবয়বে। সে কিনা তার মায়ের কাছে এখনও দুগ্ধ পোষ্য বাচ্চার মতো বকা খাচ্ছে!

তারপরই ভেবেছিল, সন্তান যতই বড় হয়ে যাক না কেন সে তো তার মা বাবার কাছে ছোটটি থাকে চিরকাল। তাই হয়তো অতীনের মা এমন করে বকাবকি করলো।
বাসর ঘরে সবাই ঘুমে ঢুলে পড়েছে। অতীনের পাশে কখন যে ঋদ্ধিমাও ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায় নি নিজেও। দূরে কোনো মসজিদের আজানের ধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে যায় ঋদ্ধিমার। ঘুম ভাঙতেই লক্ষ্য করে অতীনের হাতের ওপর মাথা রাখা আছে তার। অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে ঘাড় ঘুরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো অতীনের দিকে।
নববধূকে নিয়ে অতীন বেলা এগারোটার মধ্যে পৌঁছে গেল। গড়িয়া থেকে বারাসাত।এই ঘন্টা খানেক পথটা এসেছিল ঋদ্ধিমা অতীনের কাঁধে মাথা রেখে। অতীনের কাঁধটা ঋদ্ধিমার মনে হয়েছিল একটা নরম বালিশ।যে কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়।
বর বধূকে বরণ করার জন্য বরণডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবিতা দেবী। লাল চওড়া পাড়ের গরদের শাড়ি, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, গলায় বেশ মোটা একটা বলবিছা চেন, হাতে মোটা মোটা শাঁখা পলা সঙ্গে মানতাসা।
এই প্রথম ঋদ্ধিমা ওর শাশুড়িকে দেখলো। দেখাশোনার সময় একটি বারের জন্য উনি আসেন নি ঋদ্ধিমাকে দেখতে। বরং উনি বলে পাঠিয়েছিলেন, অতীনের পছন্দই আমার পছন্দ। এই কথাটা শুনে ঋদ্ধিমার ধারণা ছিল তার শাশুড়ি বেশ উদারমনষ্ক হবে।
বরণ করার পর সবিতা দেবী নিজের গলা থেকে বলবিছা চেনটা খুলে ঋদ্ধিমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর মুখটা বেজার করে বলেছিলেন, আমার বরণ পর্ব শেষ। এরপর যা যা স্ত্রী আচার আছে তোমরা করে নিও। অতীন এদিকের পর্ব মিটলে আমার ঘরে আসিস। আমার খুব মাথাটা ধরেছে।আমি আমার ঘরে চললাম।

সবিতা দেবীর কথাবার্তার মধ্যে বেশ একটা একনায়কতন্ত্রের ভাব ছিল। হাবে ভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন তিনিই এই পরিবারের সর্বেসর্বা।
তবে একথা বোঝানোর তো কিছু নেই। সবিতা দেবী নিজের সংসারে নিজেই সর্বময় কত্রী হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। ঋদ্ধিমা সদ্য এসেছে একটা নতুন পরিবারে। সে এখন অতীনদের পরিবারে ছোট্ট চারাগাছ।তার ডালপালা বিস্তার করতে এখনও ঢের দেরি।
ঋদ্ধিমার ছোট ননদ অনুশ্রী তাকে নিয়ে গেল দোতলার একটা বড়সড় ঘরে। এই ঘরটার সব আসবাবপত্র দেখেই ঋদ্ধিমা বুঝতে পারে এটা অতীন আর ওর ঘর।
-কি গো বৌদি পছন্দ হয়েছে তোমার ঘরটা?
-খুউব পছন্দ হয়েছে। এই ঘরটাতে আগে তোমার দাদা থাকতো নিশ্চয়?
-না গো এটা একদম নতুন তোমার ঘর। এই ঘরে প্রথম তুমিই থাকবে।
-তাহলে তোমার দাদার ঘর কোনটা ছিল আগে?
-দাদা তো মায়ের কাছে থাকে।
ঋদ্ধিমা মনে মনে বলে, সে আবার কি কথা? এতবড় ছেলে এখন ও মায়ের কাছে ঘুমায়! শাশুড়ি মনে হচ্ছে ছেলেমেয়েকে একটু বেশিই ভালোবাসে।
তারপর বলে, তোমাদের খুব মজা বলো। এখনো পর্যন্ত মা বাবার কোল ঘেঁষে ঘুমাও।
অনুশ্রী মুখ বেঁকিয়ে বলে, আমার তো আলাদা রুম আছে। দাদা একা ঘুমাতে পারে না। তাই ও মায়ের কাছে ঘুমায়।
তারপর খাটের গদিটা হালকা তুলে একটা চাবির গোছা বের করে বলে, এই নাও। ধর তোমার আলমারির চাবি। আমি এখন আসি বৌদি।
আগের দিন বিয়ের ধকলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ঋদ্ধিমা। স্নান সেরে খোলা চুলে সিলিং ফ্যানের হাওয়াতে চোখটা বুঁজে এসেছিল। দুপুর দুটো নাগাদ অনুশ্রীর ডাকে ঘুম ভেঙেছিল।
দুপুরে খেতে বসলো বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে। শ্বশুর বাড়িতে আসার পর থেকে একবারের জন্য কাছে পায়নি সে অতীনকে। শুধু দূর থেকে দেখছিল তার নতুন বরকে।

পরের দিন বৌভাতের আয়োজনে ভীষণ ব্যস্ত ছিল অতীন। সকালে চা খাওয়ার সময় একটিবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, রাতে ঘুম হয়েছিল তো? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
ঋদ্ধিমা ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল, তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ব্যাস সেই কথা।
সন্ধ্যা বেলায় রিসেপশনের অনুষ্ঠানে ঋদ্ধিমাকে দেখে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না।অতীনের এক তুতো বৌদি তো রসিকতা করে বলেই ফেলেছিল, আজ বুঝতে পারছি কেন অতীন বিয়ে না করার সংকল্প ত্যাগ করলো। এমন রূপে লাট্টু তো হতেই হবে অতীনকে।
পাশেই ছিল সবিতা দেবী। উনি ঋদ্ধিমার রূপের প্রশংসায় খানিক বিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিলেন, রূপ তো দুদিনের। শুধু রূপ দিয়ে কি স্বামীকে বশে রাখা যায়?
দু’ একবার ঋদ্ধিমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অতীন কেবলমাত্র ছবি তোলার জন্য। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে অতীন যখন ফুলশয্যার ঘরে ঢোকে তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা।
থেমে গেছে সানাইয়ের সুর, মানুষজনের হৈ চৈ। সন্ধ্যার বিরাট কর্মযজ্ঞ হয়েছে সমাধা।তবে মাঝে মধ্যেই কুকুরগুলো রব তুলছে। ওদের ভোজ পর্ব এখনও মেটেনি।
অতীন ক্লান্ত শরীরটা কে এলিয়ে দিলো ফুলের বিছানায়। তারপর বলে, বিয়ে করা বেশ ধকলের। তোমারও তো খুব ধকল যাচ্ছে বলো?
ঋদ্ধিমা বলে, সে তো যাচ্ছে। তবে এখন মনে হয় সব ধকলের অবসান ঘটবে।
অতীন ঋদ্ধিমার অনামিকাতে পরিয়ে দিল এ লেখা আংটিটা। তারপর হাত পেতে বলে, আমার উপহার কই?
ঋদ্ধিমা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে মাথার বালিশের নিচে থেকে বের করে একটা রুপোর পেন। পেনটা অতীনের হাতে দিয়ে বলে, আমি শুনেছিলাম তুমি খুব ভালো কবিতা লিখতে পারো। তাই আমার মনে হলো, আমাদের ফুলশয্যার রাতে এই পেনটার থেকে আর ভালো উপহার হয় না। কিগো পছন্দ হয়েছে তো?
অতীন ঋদ্ধিমার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। তারপর মুখটা একদম কাছে নিয়ে এসে বলে, ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আজকের রাতের সমস্ত সুখ স্মৃতি লিখবো এই পেনটা দিয়ে।
তৃষিত চাতকের মতো চেয়ে রইলো ওরা একে অপরের দিকে। ভালোবাসার উত্তাল ঢেউ বারবার আছড়ে পড়ছে দুজনের হৃদয়ে। মনের স্বাভাবিক দ্বিধা দূরে সরিয়ে অতীন স্পর্শ করে ছিল ঋদ্ধিমার ওষ্ঠ যুগল। আরো কিছুটা ঘনিষ্ঠ হতে যাবে এমন সময় দরজার পরে টোকা। অনুশ্রী ডাকছে, অ্যাই দাদা তাড়াতাড়ি নিচে আয়। মায়ের শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।

এই কথা শোনা মাত্রই অতীন ছুটে এসে দরজা খুলেছিল। তারপর দৌড়ে নিচে নেমে আসে। ঋদ্ধিমা মনে মনে বলে, সারা সন্ধ্যাবেলায় আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে বেশ ঘটা করে আপ্যায়ন করলেন উনি। একবারের জন্য মনে হয় নি যে উনি অসুস্থ।তাহলে এখন আবার কি হলো?
গুটি গুটি পায়ে ঋদ্ধিমা দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো। সবিতা দেবীর ঘর থেকে বেশ গুঞ্জন ভেসে আসছে। ঋদ্ধিমা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো সবিতা দেবীর ঘরে।
সবিতা দেবী বিছানায় শুয়ে। মাথার গোড়ায় বসে আছে অতীন। সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পীডে ঘুরলেও অনুশ্রী হাত পাখাটা নেড়ে চলেছে। অতীনের বাবা ডাক্তার ডাকার কথা বললে, সবিতা দেবী হাত নেড়ে আস্তে আস্তে বলে, এত রাতে ডাক্তার বদ্যি ডাকতে হবে না। একা ঘুমানোর অভ্যাসটা একদম নেই তো তাই অন্ধকারে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন ঠিক আছি। তোমরা সবাই যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।
অতীনের বাবা বলে, গিন্নি তাহলে আজ আমি এই ঘরেই শুয়ে পড়ছি কেমন?
-না একদম না। তুমি ভীষণ নাক ডাকো।আমি একটুও ঘুমাতে পারি না। তুমি তোমার ঘরেই শুয়ে পড়ো।
ঋদ্ধিমা এইসব শুনে বলে, অনুশ্রী তুমি তাহলে আজ মায়ের কাছে শুয়ে যাও।
অনুশ্রী মুখ বেঁকিয়ে বলে, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়েই যেত বৌদি। আমি নাকি ঘুমের ঘোরে ভুল বকি। তাই মা আমাকে শুতে নিতে চায় না।
ঋদ্ধিমা মনে মনে বলে, এতো বেশ ঝামেলার শাশুড়ি। ছেলের বিয়ে দিয়েছেন অথচ ছেলে ছাড়া ঘুমাতে পারবেন না রাতে! অনেক রকম শাশুড়ির কথা শুনেছি। কিন্তু নিজের বেলায় এমন আজব শাশুড়ি এসে জুটবে কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবে নি। বেশ আজব ব্যাপার তো।
অতীন সবিতা দেবীর ঘরের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। শরীর আর তার সাথ দিচ্ছে না। সে ঋদ্ধিমাকে বলে, তুমি ওপরে চলে যাও। অনুশ্রী বরং তোমার সঙ্গে শুয়ে পড়ুক আজ। আমি মায়ের খাটেই শুয়ে পড়ছি।
ঋদ্ধিমার বিস্ময়ের পালা যেন শেষ হচ্ছে না। ছেলের ফুলশয্যার রাতেও ছেলেকে কাছছাড়া করতে চায় না। মনে মনে বলে, তাহলে এমন ধেড়ে খোকার বিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিল?
অনুশ্রী অতীনের কথা শুনে বলে, দাদাভাই আমি কারোর সঙ্গে শুতে পারবো না। একা না শুলে ঘুম আসবে না।
কান্নায় ভিজে আসছে ঋদ্ধিমার গলাটা। কোনো রকমে সে বলে, আমার একা ঘুমানোর অভ্যাস আছে। এই কথাটা শেষ করেই প্রায় ছুটে পালিয়ে আসে নিজের ঘরে। দরজায় ছিটকিনিটা তুলে আছড়ে পড়ে বিছানায়। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমে এসে দেখেছিল, তার শাশুড়ি দিব্বি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। টকাটক কথাও বলছে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে উৎসুক নয়নে অতীনকে খোঁজে ঋদ্ধিমা।
সবিতা দেবী ঋদ্ধিমার উৎকণ্ঠা বুঝতে পেরে বলেছিল, বৌমা অতীন এখনও ঘুমাচ্ছে।আজও তো অফিসের ছুটি। কদিন যা ধকল গেল ছেলেটার ওপর দিয়ে। ওকে যেন ঘুম থেকে তুলতে যেও না। ওর ইচ্ছা মতো ও ঠিক উঠে পড়বে।
তুমি বরং স্নান করে পুজোর ঘরে এসো। আমি একটু দেখিয়ে দেবো সব কিছু। পূজোর ঘরটাতে কাজের মাসিকে আর ঢুকতে দিই না। আগে নিজেই মুছে নিতাম। এখন হাঁটু মুড়ে বসা একদম বারণ। তাই আর পারি না। ঘর মোছার লাঠি দিয়ে কোনোরকমে মুছে নিই। এবার থেকে তুমি আমার এই কাজটা করে দিও কেমন মা?
ঋদ্ধিমা স্নান সেরে বের হতে না হতেই সবিতা দেবী বলে, ঋদ্ধিমা তোমার কাচা জামা কাপড় ছাদে মেলবে। নীচের উঠানে কেবল আমি জামা কাপড় শুকাতে দিই। আসলে আমি তো মাছ মাংস খাই না। আর তোমরা সবাই আমিষ খাও। তাই বললাম আর কি।কিছু মনে করো না মা।
ঋদ্ধিমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, কাচা জামা কাপড়তে কোনো দোষ হওয়ার কথা নয়। তারপরই মনে পড়ে যায় তার মায়ের কথা। ঋদ্ধিমাকে ওর মা বলেছিল, শ্বশুরবাড়ি তে গিয়ে প্রথম থেকেই নিজে বেশি কথা বলবি না। মানুষগুলোকে আগে ভালো করে বুঝতে হয়।
ঋদ্ধিমা তাই একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করে চলেছে তার শাশুড়িকে, স্বামীকে, ননদকে, শ্বশুর মশাইকে। আর এই বোঝাপড়া আজও চলছে সতেরো বছরটা ধরে।
তবে আজকাল আর সে চুপচাপ সব কথা হজম করে না। তার মতো শান্ত স্বভাবের মেয়েও বেশ সরব হয় মাঝে মধ্যেই।
যেদিন প্রথম ঋদ্ধিমা ওর বিয়ের আলমারিতে অতীনের প্যান্ট জামা গুছিয়ে তুলে রাখতে চেয়েছিল সেদিনও সবিতা দেবী বলেছিলেন, কেন বৌমা অতীনের প্যান্ট জামা আমার আলমারিতে থাকলে তোমার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে?
ঋদ্ধিমা সেদিনও আকাশ থেকে পড়েছিল। স্বামীর জামা প্যান্ট স্ত্রী গুছিয়ে বাগিয়ে নিজেদের আলমারিতে তুলে রাখবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেও সবিতা দেবীর আপত্তি।
সেদিন ঋদ্ধিমা মনে মনে খুব কষ্ট পেলেও এখন কিন্তু রসিকতা করে সে অতীনকে বলে, তোমার মা সেদিন আমার যে কি উপকার করে ছিল তা কি বলবো। তোমার প্যান্ট জামা মেশিনে পরিষ্কার করতে দিয়েই আমি মুক্ত। বাকিটা কিন্তু এতকাল তোমার মা সামলে এসেছেন।
অতীন এই মাঝ বয়সে এসে বেশ বুঝতে পারে মায়ের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি দেখাতে গিয়ে সে ঋদ্ধিমার প্রতি অনেক অবিচার করেছে। মাঝেমধ্যেই অতীন ঋদ্ধিমাকে বলে, তোমার আমার ওপর খুব রাগ হয় তাই না?
ঋদ্ধিমা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে এসে বলে, হতো খুব রাগ হতো। কতবার ভেবেছি সব ছেড়ে ছুড়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকবো। বিয়ের পর টানা একটা সপ্তাহ তুমি আমার সঙ্গে রাতে এক ঘরে কাটাও নি। তোমার মায়ের বেশিরভাগ দিনই কিছু না কিছু অসুবিধা হতো। কিন্তু যেদিন উপলব্ধি করলাম মা হতে চলেছি আমি। সেদিন আমার সব মনোযোগ তোমার কাছ থেকে সরিয়ে আমাদের সন্তানের দিকে দিতে লাগলাম।
তারপর যখন রুচিরা এলো কোলে তখন দেখতাম তুমিও অফিস থেকে ফিরে আগে তোমার মায়ের ঘরে না গিয়ে মেয়েকে দেখার জন্য আমার ঘরে ছুটে আসতে। তোমাদের বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে আমার মনটা ভরে উঠতো। সন্ধ্যা হলেই এইটুকু মেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতো তোমার জন্য।
তখন ভাবতাম যদি আমি তোমাদের ঘর ছেড়ে চলে যেতাম তাহলে রুচি কি তোমাকে এতটা কাছে পেত। বাবার ভালোবাসা, বাবার আদর থেকে ওকে হয়তো আমি বঞ্চিত করতাম।
তারপর যখন রুচি ক্লাস টু-তে তোমার হার্টের অসুখটা ধরা পড়লো। তোমাকে নিয়ে আমি চেন্নাই এলাম ট্রিটমেন্ট করতে। আর এই তিনটে মাস তোমাকে আমি নতুন করে চিনলাম, জানলাম আর সর্বোপরি বুঝলাম। বুঝলাম যে তুমি মানুষটা মায়ের প্রতি বড্ড বেশি অনুগত। নিজে কষ্ট পেলেও মায়ের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারো নি কোনদিন।
অতীনের চোখগুলো জলে ভরে ওঠে। ঋদ্ধিমা আমাকে ক্ষমা করে দিও। যৌবন কাল হচ্ছে মানুষের জীবনের সোনালী অধ্যায়। আর তোমার জীবনের সেই দিনগুলো আমি নষ্ট করে দিয়েছি। এই অনুতাপ যে আমাকে কুরে কুরে খায় অবিরত।
ঋদ্ধিমা বলে, পুরানো কথা ভেবে কষ্ট পেও না। জানো যেদিন প্রথম তোমার হার্টের ব্লকটা ধরা পড়লো সেদিন খুব কেঁদেছিলাম ঠাকুরের কাছে। তবে আজকে আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই। ভাগ্যিস তোমার হার্টের অসুখটা হলো। তাই তোমার সঙ্গে একান্তে তিনটা মাস কাটাতে পেরেছি।
নাইবা তুমি আমাকে দিতে পারলে শারীরিক সুখ। তুমি তো আমাকে মানসিক শান্তি দিতে পেরেছো এখন। জীবনে একটা প্রকৃত বন্ধু তো আমি পেলাম অবশেষে। যার কাছে নির্দ্বিধায় মনের সব কথা উজাড় করে দেওয়া যায়। শত চেষ্টা করেও কিন্তু তোমার মা আমাদের মনের মিলন আটকে রাখতে পারেন নি।
এমন সময় সবিতা দেবীর আয়া মিঠু এসে বলে, বৌদি একবার চলো মাসীমার ঘরে।উনি আমার হাতে খাবেন না বলছেন।
সবিতা দেবী মাস খানেক আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমড় ভেঙেছেন। এখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী। এছাড়াও বার্ধক্য জনিত নানান অসুখ ওনার শরীরে দানা বেঁধেছে।
ঋদ্ধিমা মুচকি হাসি দিয়ে অতীনকে বলে, নিশ্চয় তোমার মা টের পেয়ে গেছে আমরা বসে বসে গল্প করছি। তাই আর সহ্য হচ্ছে না। তাই আমাকে ব্যস্ত রাখার জন্য নতুন কৌশল।
অতীন বলে, সত্যি বাবা! মা পারেও। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই এখন। তবুও শুয়ে শুয়ে ভেলকিবাজি দেখাতে ছাড়ে না।
ঋদ্ধিমা সবিতা দেবীর ঘরে ঢুকে টুলটা টেনে বসলো খাবারের বাটিটা হাতে নিয়ে। তারপর এক চামচ খিচুড়ি মুখে পুরে দিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হতে হবে তো আপনাকে। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে আপনার ছেলে তো খুব কষ্ট পায়।
সবিতা দেবী ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ ঋদ্ধিমার মুখে দিকে তাকিয়ে থাকে। ওনার চোখের কোণেও জল টলমল করছে। ধীরে ধীরে বলেন, আমার মতো বজ্জাত শাশুড়ি পেয়েও তুমি টিকে রইলে এই বাড়িতে। কত ছল চাতুরী করেছি অতীনের থেকে তোমাকে দূরে রাখার জন্য। অসম্ভব তোমার সহ্য ক্ষমতা বৌমা। তুমি যদি অতীনকে ছেড়ে চলে যেতে তাহলে আমাদের মা বেটাকে এই দুর্দিনেকে বুকে করে আগলে রাখতো বৌমা?
ঋদ্ধিমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সারদা মায়ের বাণী ‘যে সয় সে রয়, যে নাশ হয় সে বিনাশ হয়।’ প্রত্যেকের জীবনে পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে নিয়ে আলাদা আলাদা সমস্যা থাকে। আর সেই সমস্যা থেকে কেউ পালিয়ে গিয়ে মুক্তি খোঁজে। কেউ আবার দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায় শেষ টুকু দেখার জন্য। ঋদ্ধিমা হচ্ছে এই দ্বিতীয় প্রকৃতির মানুষ ।

Loading

2 thoughts on “গল্প- ছল চাতুরী

Leave A Comment