Site icon আলাপী মন

গল্প- অন্ত-যাম

অন্ত-যাম
-রীণা চ্যাটার্জী

আজ রাতেও শোনা গেল, ‘মালাইইই বরফফফ.. মাআলাই বরফ..’ আওয়াজটা আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেলো। গান আর ঘুঙুরের শব্দ ভেসে এলো। ঘড়িতে রাত তখন বারোটা। আবার শোনা যাবে ঠিক দু’ ঘণ্টা পর। অভ্যাস হয়ে গেছে এলাকাবাসীর ঘুমের মধ্যেই এই আওয়াজটা শোনার। কিন্তু মাসের ঠিক একটা দিন ‘মালাই বরফ’ ডাকের সাথে একটা কান্নার আওয়াজ তারপর আর্ত চিৎকার ভেসে আসে দূর থেকে। বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে পড়ে, কাঁদে। বয়স্করা শুয়ে থেকেও ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। কৈশোর উৎসাহিত হয়ে ওঠে জানার জন্য- মনের আনাচে কানাচে প্রশ্নরা ভেসে বেড়ায়। জানতে চায় মা, ঠাকুমা, দাদু, কাকার কাছে। উত্তর আসে, বড়ো হও সব জানতে পারবে।
এইসব সেই তখনকার কথা যখন কলকাতা আজকের কলকাতা হয়ে ওঠে নি। মেট্রোরেল, মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল, আইনক্স খুব অজানা শব্দ। তখন ভোরবেলার প্রথম ট্রামটা হরিনাম সঙ্কীর্তনের সাথে খঞ্জনী বাজাতে বাজাতে পুণ্যার্থীদের নিয়ে দিনের প্রথম নিস্তব্ধতা ভেঙে শহরের বুকে পা ফেলে যান্ত্রিক আওয়াজে এগিয়ে যেত গঙ্গার দিকে। আওয়াজ শুনে ঘরের কোনে ঘুমখোর গৃহবাসীরা আধবোজা চোখে নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তো।
পাড়ার মোড়ে গুমটি চায়ের দোকানের উনুনে আগুন ধরিয়ে দোকানি ময়দা মাখতো হিং-এর কচুরির। কাঠ-কয়লার কালো ধোঁয়া সাদা ভোরের গায়ে আল্পনা দিতে দিতে মিলিয়ে যেতে বাতাসে। বাড়িতে বাড়িতে দরজা খুলে সদরে জল ঢালা হলে, বেলে পাথরের সিঁড়ি আর লাল রোয়াক জল ধোয়া হয়ে ভোরের শিউলির মতো একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে অপেক্ষা করতো প্রতিবেশী-পথচারীদের জন্য। ভিস্ত্রিওয়ালা চামড়ার ব্যাগে জল ভরে পিঠে নিয়ে দিতে আসতো কিছু খ্রীষ্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে। বাজারের থলি হাতে বেড়িয়ে পড়তেন বাবুরা সকালের টাটকা সব্জি-মাছ কেনার জন্য। ফ্রীজ তখন প্রায় অচ্ছুত সাবেকি বাঙালী বাড়িতে। মাসী-কাকির হাতের ঝোলে-ঝালে-অম্বলে স্বাদ বদল হতো প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের হেঁসেলে। হরেক ফেরিওয়ালার ডাকে দুপুর থেকে সন্ধ্যা সরগরম হয়ে থাকতো।
তখন কলকাতা- আত্মীয়ের কলকাতা, আত্মার কলকাতা, আন্তরিকতার কলকাতা।

এখন যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট্রাল মেট্রোরেল অফিস, সেটা তখন একটা একতলা এক বাজার। “সব পেয়েছির” ঠিকানা এলাকাবাসীর কাছে। ঠিক তার উল্টো দিকে বড়ো রাস্তা পেরিয়ে কিছু কিছু বাড়ি থেকে রাত বাড়লেই নাচ, ঘুঙুর, গানের আওয়াজ ভেসে আসতো। রাত বাড়তো, আওয়াজ বাড়তো। কৌতুহলী কৈশোর ঘুম চোখে জানলা দিয়ে চোখ বাড়াতো- মায়াবী নীল আলোয় ওড়নার আবছা প্রতিবিম্ব। বড়োদের চোখ এড়িয়ে দেখতে হতো- ওটা যে খারাপ জায়গা, এড়িয়ে চলতে হয়। সেটা বাড়িতে বাচ্চাদের আড়ে আড়ে বুঝিয়ে দেওয়া হতো আগে থেকেই বা বলা যায় জ্ঞান হওয়া থেকেই বুঝে যেত ওরা। অবশ্য কৌতুহল তাতে আরো বাড়তো- দুপুরের অবসরে আলোচনা জমে উঠতো কৈশোর মজলিসে। বয়সে একটু বড়ো মুরুব্বি দাদা, দিদিদের সংগ্ৰহে খবর একটু বেশিই থাকতো। চোখ গোল গোল করে, হাত নেড়ে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে সেই খবর ছড়িয়ে পড়তো কানে কানে। কেউ বুঝতো, কেউ বুঝতো না- যে বুঝতো না তার জন্য বেদবাক্য, ‘তোকে বুঝতে হবে না, তোর মাথায় গোবর পোড়া.. মাথামোটা..’
বিস্তর রাজনৈতিক চাপান-উতোর, আইনি জলঘেলা সেরে সদ্য একতলা বাজার বাড়িটা ভাঙা হয়েছে, মেট্রোরেল হবে। রাস্তার এপার- ওপার পরিস্কার দেখা যাচ্ছে এখন- তিনতলা বা ছাদে না উঠলেও।

কৈশোরের কৌতুহলী চোখগুলোতে আজ উত্তেজনা ভরপুর। বাড়িতে আজ উৎসবের মেজাজ- বড়দা আজ ফিরেছে হোষ্টেল থেকে। দুপুরে ঠিক হয়েছে আজ রনি, বাচ্ছু, আমি, বড়দা একসাথে দোতলায় রাস্তার ধারের শোবো। রাতে আওয়াজ পেলে মিলি, রিমিদের ডেকে নেবে। আজ সবাই দেখবোই ওপারে কি হয়!
ঘড়িতে রাত দুটো আবার শোনা গেল, ‘মালাইইই বরররফ, মালাইইফ বরফফফ..’
বিছানা থেকে নিঃশব্দে উঠে জানলায় চোখ রাখলো বড়দা- আমরাও পিছু পিছু উঠে এলাম। রণি ফিসফিস করে বললো, ‘ওদের ডাকবো?’ বড়দা মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলেই আঙুল দিয়ে দেখালো দূরে.. দেখি মালাইবরফওয়ালা মাথায় লাল কাপড় চাপা দেওয়া হাঁড়ি নিয়ে ওপারের একটি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। হঠাৎ করে ওই বাড়িতেই একটি জানলায় তখন নীল আলোর মায়াবী হাতছানি- পুরোনো বাড়ির জানলা। অনেকটাই খোলা, স্বচ্ছ পর্দার আবরণ দেওয়া। মেঝের গালিচা, কড়িকাঠে ঝাড়লন্ঠন সব দেখা যাচ্ছে- অচেনা অন্য জগৎ প্রায় অর্ধোন্মুক্ত। কৈশোরের উৎসাহের আতিশয্যে গলা আওয়াজ বেশ তুলেই বাচ্ছু বলে উঠলো, ‘এই জানলাটা তো বন্ধ থাকে! আজ খোলা?’ রণির পায়ের চাপে, বড়দার চুপ থাকার ইশারায় বাচ্ছু চুপ করে গেল। দরজায় খুট করে আওয়াজ হলো- মনে হয় রিমি, মিলি। আস্তে করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ওরা ঘরে ঢুকে এলো। হঠাৎ করে ওপারে গানের আওয়াজ তীব্র হয়ে উঠলো। সবার চোখ জানলায়।
তারপর আচম্বিতে কান্নার এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ। গান থেমে গেল, বাজনাও। তারপর একটি মেয়েলী গলার আর্তনাদ, সাথে সাথেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো মেয়েটি। ভালো করে দেখলো ওরা একটা নয় দুটি দেহ পড়ে আছে। একজনের বুকের ওপর আরো একটি দেহ। নীল আলোতেও দেখা গেল মেঝেতে রক্ত ভেসে যাচ্ছে। ঘরের আলো নিভে গেল। যেন সিনেমার পর্দা- যবনিকা পতন।
আমাদের সবার তখন হাত-পা কাঁপছে। তাও আরো একবার তাকিয়ে দেখলাম। ওপারের জানলাটা যথারীতি বন্ধ। রিমি আমাদের ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো। এ-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, সবার মুখ ফ্যাকাশে। ছোটকা উঠেছিল রাতে, এই বিশেষ রাতে এলাকার প্রায় সবার ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে আলো জ্বলছে দেখে ছোটকা বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করেন- কি রে এতো রাতে আলো জ্বালিয়ে রেখেছিস? ঘুমোস নি?
ছোটকা’র গলার আওয়াজ শুনে আমরা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। বড়দা কিছু বলার আগেই তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো রিমি। ছোটকা বললেন- তুই এই ঘরে! বলতে বলতে ঘরে ঢুকে এলেন। এসে সবাইকে একসাথে দেখে, সবার মুখ চোখ দেখে বলে উঠলেন, ‘বুঝেছি কেন আজ একসাথে শোবার প্ল্যান তোদের? দেখা হলো সব? কৌতুহল মিটলো? অতঃপর.. এবার কি ভাবছো বাছারা?’
আমরা সবাই চুপ। এক তো রাতবিরেতে এইসব দেখা, তারপর সামনে ছোটকা। ধরা পড়ে যাবার ভয়। তার মধ্যেই একটু সাহস নিয়ে বড়দা বললো, ‘ছোটকা সেই মালাই বরফওয়ালা ওই বাড়ির ভেতরে গেল এতো রাতে। তারপরই আওয়াজ হলো কান্নার…’ বাচ্ছু বললো, ‘ছোটকা ওই বাড়ির জানলা তো খোলে না, কিন্তু আজ দেখলাম খোলা, দুজন মেঝেতে পড়েছিল, রক্ত ছিল। কিন্তু এখন তো বন্ধ হয়ে গেছে।’
ছোটকা বললেন, ‘ওই জানলা বন্ধ থাকে, খোলে না অনেক দিন। আজো খোলে নি..’
বড়দা বললো, ‘আমরা যে দেখলাম আজ খোলা!’
ছোটকা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমাদের ঘরের জানলা দিয়ে ওপারে দেখলো। ‘তোদের ভীষণ কৌতুহল না রে? আজ তোদের বলবো, আমি যা শুনেছিলাম। আমাদের বলেছিলো তোদের মেজদাদু। তার আগে চা বানিয়ে নিয়ে আয় দেখি, কেমন পারিস, শুধু মুখে তো গল্প হবে না।’
মিলি বললো, ‘এক্ষুণি আনছি ছোটকা.., কিন্তু আমি আসার আগে তুমি ওদের কিছু বলবে না।’ অগত্যা..
মিলি খুব তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে নিয়ে এসেই বললো, ‘এবার শুরু করো ছোটকা..’
ছোটকা শুরু করলেন, ‘তোরা যে জানলা আজ এখান থেকে দেখলি। তখন তো এখান থেকে দেখা যেত না, আমরা দেখেছিলাম ছাদ থেকে লুকিয়ে। খোলা ছাদে উন্মুক্ত আকাশের নিচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠেছিলাম। তোদের মতো আমরাও খুব ভয় পেয়েছিলাম রে সেদিন। তোদের মেজদাদুও আমাদের ধাওয়া করে ছাদ অব্দি উঠেছিল। সেদিন ছাদে বসেই শুনেছিলাম- একটা হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার গল্প। যার কান্নার আওয়াজ শুনিস, সিতারা ওর নাম। বড়ো অসহায় মেয়ে। বিহারের এক গ্ৰামে থাকতো, জ্ঞাতি কাকার কাছে। বাবা-মা কেউ ছিলো না। অপূর্ব সুন্দরী, গান শেখে নি, কিন্তু চমৎকার গানের গলা। সেই জ্ঞাতি কাকার ছেলে বলবন্ত ওকে গ্ৰাম থেকে এনে জোর করে দালালদের হাতে বিক্রি করে দেয়। গ্ৰামে বদনাম রটিয়ে দেয় সিতারা বেজাতের লোকের সাথে পালিয়ে গেছে, খারাপ পাড়ায় বাসা নিয়েছে। চরিত্র নষ্ট করে রোজগার করছে- এইসব নানান গল্প ফেঁদে যাতে সিতারা আর কোনোদিন গ্ৰামে ফিরতে না পারে- সেইজন্য সিতারার নাচের ছবি গ্ৰামে গিয়ে দেখায়। বেচারা সিতারা অনেক অত্যাচার সহ্য করে বাঈজী পেশায় নামতে বাধ্য হয়। অসহায় সিতারা মেনে নিয়েছিল নিজের এই জীবন- নাচ, গান, বাবুদের মনোরঞ্জন। কিন্তু দুঃখ যেন সিতারা কপালে লিখে নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। বাবুদের মজলিসে মালাই বরফ বেচতে আসতো কেতন। সেও বিহারের অধিবাসী। গভীর রাত ছাড়াও সন্ধ্যা রাতেও মালাই বেচতে আসতো। তখনই সিতারার সাথে আলাপ জমে। ভাষা এক হওয়ায় মনের মিল হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। দুঃখিনী মেয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে কেতনের সাথে। দুজনের চোখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন- বলবন্ত দালাল মারফত জানতে পারে সব কথা। সোনার ডিম দেওয়া হাঁস কে হাতছাড়া করতে চায়? তাই ষড়যন্ত্র করে একদিন রাতে মালাই বরফ কেনার অছিলায় ডেকে পাঠায় কেতনকে। তারপর দরজা বন্ধ করে চলে নির্মম অত্যাচার। সিতারা কাঁদতে থাকে, হাতে পায়ে ধরে ছেড়ে দেবার জন্য। কিন্তু কোনো কথাই শোনে না ওরা- অকথ্য অত্যাচারের পরিণামে কেতন লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর হয়ে। সিতারা আর্তনাদ করে ওঠে, উপুড় হয়ে জড়িয়ে ধরে নিথর কেতনকে। তারপর সিতারার আর জ্ঞান ফেরে না। বলবন্তকে বেশ কিছুদিন পর ওই বাড়ির সিঁড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তখন লোকে বলতো ওকে সিতারার আত্মা খুন করেছে। এসবের সত্যতা বলতে পারবো না, শোনা কথা- মুখে মুখে প্রচলিত। কিন্তু মনে হয় সিতারা- কেতন আজো ঘুরে বেড়ায়। তাই তো ওই আওয়াজ ভেসে আসে…’ ছোটকা যখন শেষ করলো সিতারার কাহিনী তখন ভোরের প্রথম ট্রামটা রাস্তার বুক চিরে এগিয়ে চলেছে পুণ্যার্থী নিয়ে।
ছোটকা বললেন, ‘চল আজ ভোরের কলকাতা দেখিয়ে আনি। তৈরী হয়ে নে চটপট সবাই।’
রাস্তায় বেরিয়ে ওই বাড়ি আর ওই বন্ধ জানালার দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো। গা শিরশির করে উঠছিলো। ফিরেছিলাম সবাই ভোরের গরম গরম কচুরি, জিলিপি খেয়ে।
আজ বহু দিন পর বাড়িতে আসা। এ বাড়িও বিক্রি হবে- তার মিটিং। ফেরার পথে সেন্ট্রাল এভিনিউ ক্রশিং-এ গাড়িতে বসে মুখ বাড়ালাম। নেই সেই বন্ধ জানলা, পুরোনো বাড়ি। নতুন ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং সেখানে। সিতারা হারিয়ে গেছে, কেতন মুছে গেছে, ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। অবুঝ মন প্রশ্ন করলো- সিতারার কান্না! কান্নাও হারিয়ে গেছে?
সম্বিত ফিরলো দেখি গাড়িটা আমার শৈশব, বাল্য স্মৃতি, সিতারাকে হারিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে।
এ কলকাতা নতুন কলকাতা- অনলাইন কলকাতা, কেতাদুরস্ত কলকাতা। সব অচেনা।

Exit mobile version