পঞ্চমুখী জবা
-কাজল দাস
দিনটা ছিল ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭৫
প্রতিদিনের মত সেদিনও অফিসে বেরুবার তোড়জোড় চলছে।
খাবারটা কোনোরকমে মুখে নিয়ে-
দরজার পাশ থেকে জুতোজোড়া তুলতেই,
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো।
-“এখন আবার কে ফোন করলো, থাকগে্ ধরবো না।”
খানিকটা বিরক্তির সাথে হলেও ফোনটা তুললাম।
মা! যাকে আমি দশ বছর আগে রেখে এসেছিলাম, একটি সাধারণ বৃদ্ধাশ্রমে।
মা ভাঙা ভাঙা গলায় বললো-
-“বাবা, সকাল থেকেই শরীরটা খুব খারাপ লাগছে- রে, ভেবেছিলাম ফোন করবোনা তোকে, তোর তো আবার অফিস, না?
তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, পারলে একবার আয়!”
হঠাৎ করে মনটা ডুকরে উঠলো, কাউকে কিছু না বলেই- বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
বাড়ি থেকে বৃদ্ধাশ্রমের দূরত্ব প্রায় তিন ঘন্টা।
আমার পৌঁছতে প্রায় দু’টো বেজে গেল।
বৃদ্ধাশ্রমের দরজায় ধাক্কা দিতেই-
ফ্যাকাশে নীল রঙের আধ খাওয়া দরজাটা
বার্ধক্যের করুন সুরে বিলাপ করে খুলে গেল।
ভেতরে ঢুকতেই- মনে হলো,
একটা নীরবতার ঠান্ডা বাতাস যেন,
সম্পূর্ণ আশ্রম-টাকে বেঁধে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে।
সারা শরীর যেন ভার হয়ে আসছে।
মনটাকে শক্ত করে, সোজা চলে গেলাম মায়ের ঘরে।
-“মা, মাগো!”
কোন উত্তর এলো না।
একজন ভদ্র লোক এগিয়ে এলো আমার দিকে।
আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বললেন-
-“তোমার মা ঘন্টা খানেক আগেই…..”
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলাম!
তারপর চিঠিটা পকেটে পুরে, মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম।
তখনও মা-
অম্লান হাসিতে নিজের বুকের যন্ত্রণা আগলে রেখেছে।
যেমন করে মা তার সন্তানকে আগলে রাখে।
জানেন!
এটা মায়ের চির কালের স্বভাব,
নিজের যন্ত্রণা কোনোদিন কাউকে বুঝতে দেননি।
খুব অভিমানী কিনা!
কিছুক্ষন নিজের ভেতরের অনুতাপের আগুনে-
পুড়িয়ে নিলাম পরিস্থিতির সমস্ত অজুহাত।
তারপর সকলে মিলে তুলে দিল মায়ের নিষ্প্রাণ দেহ খানি, একটা ম্যাটাডোরে।
আমি বেরিয়ে পড়লাম মাকে নিয়ে।
ম্যাটাডোরে তখন দুটো মানুষ, একজন মৃত আর অন্য জন বিবর্জিত।
গোধূলির পড়ে আসা আলোয়-
মায়ের ক্লান্তি-মোছা মুখের দিকে তাকাতেই,
মনে পড়ে গেল চিঠিটার কথা।
তড়িঘড়ি করে চিঠিটা খুলতেই-
মনটা বিষাদে ভরে উঠলো, তাতে লেখা-
“বাবা তোমার সাথে হয়তো আমার আর দেখা হবে না, আমি আজ পর্যন্ত তোমার কাছে কিছুই আবদার করিনি, এমন কি তোমাকে চোখের দেখাও দেখতে চাইনি, কিন্তু আজ আমার একটা ইচ্ছে, বলতে পারো মৃত মায়ের একটা দাবি তোমাকে রাখতে হবে যে!
এই বৃদ্ধাশ্রমের মানুষ গুলো খুব অসহায়, গরমের সময় সারারাত কেউ ঘুমোতে পারে না, আমার দেখে ভারি কষ্ট হয়,
বাবা, পারলে তুমি তাদের দুটো পাখা কিনে দিও।”
হয়তো তারপর আর কিছু লিখতে পারেনি। কিন্তু খুব গভীর একটা দাগ কেটে গেল, একটা জিজ্ঞাসা-
তবে কি মা এতোটা বছর গরমে কষ্ট পেয়ে কাটালো, একবারও কি মুখ ফুটে বলতে পারলোনা, -খোকা আমি ভালো নেই।
“হে ঈশ্বর আমায় ক্ষমা করো, আমায় ক্ষমা করো তুমি।”
তারপর চোখের জল মুছে তাকাতেই-
চোখ পড়ল চিঠিটার শেষ প্রান্তে, তাতে সন্ধ্যের আবছা আলোয় অস্পষ্ট ভাবে জড়িয়ে আছে একটা কথা,- ‘পঞ্চমুখী জবা।’
আমার বয়স যখন এগারো বছর।
আমার মা আমাদের সদর দরজার পাশে-
একটি জবা গাছ রোপণ করে।
তারপর সহাস্যে আমাকে বুকে জড়িয়ে বলে,-
“ খোকা আমি যখন তোর পাশে থাকবো না, এই গাছটা থাকবে তোর পাশে, দেখবি!
প্রতিদিন নতুন নতুন কুঁড়ি, কত ফুল……”
সেদিন আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম,
দু’হাত দিয়ে মায়ের মুখ চেপে ধরে বলেছিলাম-
“ অমন কথা বল’না মা, আমি তোমাকে ছাড়া একা থাকতে পারবনা, তুমি ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই।”
বাবাকে আমার ঠিক করে মনেও পড়ে না, বাবার মৃত্যুর পর মায়ের নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ আশ্রয় আমি।
কিন্তু জীবনের টানাপোড়েনে সেটুকুও ছিঁড়ে গেল।
যেদিন মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, গাড়িতে ওঠার সময় আমার হাত দুটো ধরে বলেছিল-
“বাবা- দেখিস গাছটা যেন শুকিয়ে না যায়।”
আজ ৭ই ডিসেম্বর ২০১৪,
আজ আমিও সংসারের অতিরিক্ত একজন।
নিয়ম মাফিক আমার ছেলেও আমাকে আজ নিয়ে চলল সেই আশ্রমের দিকে।
বাড়ি থেকে বেরুবার সময় অনুভব করলাম,
কত কষ্ট বুকে চেপে মা আমার……..
আমার দু’চোখ ভরে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো জল।
শেষ বারের মত মাথা উঁচু করে দরজাটার দিকে তাকাতেই-
চোখে পড়লো ছোট্ট একটি ফনিমনসা,
আর ঠিক তার পাশেই মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে,
-আমার মায়ের পঞ্চমুখী জবা গাছটি।
যেন সে চিরতরে একা হয়ে যাওয়ার বেদনায়, অভিমানে ভেঙে পড়েছে আজ।
আমি আমার একমাত্র নাতির ভরসায় রেখে এলাম তাকে,
আর হাতদুটো ধরে বলে এলাম,-
“ দাদুভাই দেখ’ গাছটা যেন শুকিয়ে না যায়, শুকিয়ে না যায়।”