চৈত্র মাস বাংলার লোকসংস্কৃতির মাস
-সুমিত মোদক
চৈত্র মাস জুড়ে এক আলাদা মাদকতা আমাদের জীবনে। আমরা যারা মূলত গ্রামে বাস করি, সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি বাংলার অন্য মাসগুলির তুলনায় চৈত্র মাসটি পুরোটাই লোকসংস্কৃতির মাস। আগুন ঝরা কৃষ্ণচূড়ার আড়াল থেকে ভেসে আসে কোকিলের কুহু তান। আর ঝাঁঝালো রোদ্দুর মেখে শিবের নাম- গান গেয়ে দলবদ্ধভাবে মেঠো পথে হেঁটে যাওয়া শিব সন্ত্রাসীদের দল।
চৈত্র মাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে গ্রামে বেশ কিছু পুরুষ শিব-সন্যাস নেন। মূলত পাড়ার কোন মধ্যবয়স্ক একজন মূল সন্যাসী হয়। তিনি একটা সাদা ধুতি বা গামছা পড়ে থাকেন। গলায় ধারণ করেন সাদা সুতো- উত্তরি। আদুল গা, হাতে বেতের ছড়ি থাকে। সারা দিনে একবার হবিষ্যি খান। সংসার থেকে এই এক মাসের জন্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকেন। দুটো ইট দিয়ে তৈরি হয় উনান। সেই উনানে খড় দিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। উনানে মাটির মালসায় ফোটে চাল-ডাল-আলু-সবজি। সন্দক নুন, লঙ্কা দিয়ে কলা পাতায় খাদ্য গ্রহণ। এই এক মাস গ্রামের আটচালায় খড় বিছিয়ে থাকেন। সেখানে অন্য সন্যাসীরাও হাজির হন। ভোর থেকে শুরু হয় শিবের গীত। সকালে সে গীত সহকারে গ্রাম প্রদক্ষিণ করেন। পিছনে পিছনে দল বেঁধে হাঁটে গ্রামের শিশু-কিশোররা। সন্ধ্যায়ও হ্যারিকিনের আলোতে জমে যায় আসর।
গ্রামের কিছু ছেলেরা গাজন দল করে সে সময়। শিব-পার্বতীর কিছু পৌরাণিক কাহিনী, কিছু লোককাহিনী নিয়ে শুরু হয় গাজন। বাংলার লোকসংস্কৃতিতে গাজন দল ও গাজন গানের প্রভাব দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চলে লক্ষ্য পড়ার মতো। সারাটা মাস চর্চা চললেও নীলের দিন প্রথম পালা শুরু করে। ও দিনটা মূল সন্যাসীর পাশাপাশি অন্য সন্যাসীরা শিবের ঘরে বাতি দেন। শিবের আরেক নাম নীলকন্ঠ। সে কারণেই নীলের ঘরে বাতি বলা হয়ে থাকে। গ্রামের বউ-ঝি, ছেলে-মেয়েরা ও শিবের গীত গাইতে গাইতে স্নান সেরে বাতি অর্থাৎ দীপ জ্বালায়।
নীলের পরের দিন ঝাঁপ। এখানে আরেক লোক সংস্কৃতি। সন্যাসীরা গ্রাম পরিক্রমা করেন। একটা কাঁসার থালায় করে হলুদ জল, তাতে দূর্বাঘাস দেন। প্রতিটি ঘরে উঠানের রোদে রাখেন। মূল সন্যাসীর হাতের বেত দিয়ে সে জল গৃহস্থের মঙ্গল কামনায় ঘরে ছড়িয়ে দেন। তখন বাড়ির সকলে এক সঙ্গে শিব ধ্বনি দেয়।
দুপুর থেকে ঝাঁপতলার মাঠে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়। গাঁটওয়ালা দুটো বাঁশ পোঁতা হয়। ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ছোটদুটো বাঁশ দিয়ে খাচা বাঁধা হয়। ওখানেই উঠে সন্যাসীরা ঝাঁপ দেন। নিচে পাতা থাকে খড়। তার উপর থাকে একটা লাল কাপড়। তার উপর বঁটি পাতা থাকে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বালায়। সন্যাসীরা প্রথমে একটা ডাব ছুঁড়ে দেন শিবের উদ্দেশ্য। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় শিব ধ্বনি। সেই ধ্বনি নিয়ে ঝাঁপ দেন সন্যাসীরা। তার পর অন্যরা।
এদিন থেকে গাজন দলগুলি জোর কদমে শুরু করে গাজন গান। এক গ্রামের গাজন দল আরেক গ্রামে গাজন গান করে। প্রতিটি গ্রামে প্রতি দিনই গাজন গান হয়ে থাকে। কোথাও আটচালার সামনে। কোথাও ঠাকুর দালানের সামনে। কোথাও খেলার মাঠে। কোথাও বা কারোর খামারে। এমন কিছু গ্রাম আছে যেখানে আছে গাজন তলার মাঠ। ছেলেরাই মেয়ে সেজে অভিনয় করে।
এ ছাড়া এ সময় গ্রামের পথে-হাটে দেখা মেলে বহুরূপীদের। বেশ কিছু পুরুষ শিল্পকে ভালোবেসে সাজে বিভিন্ন দেব-দেবী। পেটের তাগিদ দিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিগ মাগে ।
ঝাঁপের পরেরদিন চড়ক। প্রায় গ্রামে একটি করে চড়ক মাঠ আছে। সেখানেই চড়ক মেলা বসে। মূলত ফাঁকা ধান জমিতে এই মাঠ। সেখানেই একটা চড়কগাছ বসানো হয়। ডালবিহীন মসৃন লম্বা একটা গাছ। তার মাথায় লাগালো হয় একটা বাঁশ। বা লম্বা একটা কাঠ। এমন ভাবে পেরেক পোঁতা থাকে যাতে কাঠটা বা বাঁশটা সহজে ঘুরতে পারে। তার দু’ প্রান্তে ঝোলানো থাকে মোটা দড়ি। এক প্রান্তে মূল সন্যাসীকে বেঁধে ঝোলানো হয়। আরেক প্রান্তে দড়িটা ধরে অন্য সন্যাসীরা বনবন করে চড়ক গাছটাকে প্রদক্ষিণ করতে থাকেন। তখন মূল সন্যাসী চড়কগাছে ঝুলে ঘূর্ণাবত্যের মধ্যে। আশেপাশে তখনই একটাই ধ্বনি- হর হর মহাদেব…….