তিন বর
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
নববর্ষের সকালবেলা থেকেই জিকো তাড়া লাগাতে শুরু করলো…দাদুভাই, ঠাম্মি তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে ড্রেস পরে নাও।দাদুভাই তুমি ধুতি, পাঞ্জাবী পরবে আর ঠাম্মি,তোমায় কিন্তু আজ মা, গরদের শাড়ীটাই পরতে বলেছে।
খানিকবাদে অমিয়বাবু দেখলেন ওনার ছোটছেলে আর বৌমা সুন্দর সেজেগুজে রেডি হয়েছে আর জিকোবাবুও আজ পাঞ্জাবী পরে একেবারে ফুলবাবু। বছরের প্রথম দিন সবার বাঙালী সাজ দেখে অমিয়বাবু খুশী হলেন। বললেন, যাক্ তাও একটা দিন অন্তত তোমরা বাঙালী সাজে।
ধুতি, শাড়ী তো আজকালকার মানুষজন অনুষ্ঠান বাড়ি ছাড়া পরে না।
তা এত সেজেগুজে আমরা কোথায় যাবো জিকোবাবু?
দাদুভাই, আমরা কোথাও যাবো না কিন্তু আজ সবাই আমাদের বাড়ি আসবে।
শুনে ঠাম্মি বলে উঠলো- আজকে বছরের প্রথম দিন লোকজন এলে তো তাদের পেটভরে খাওয়াতে হবে-রে জিকো। সেসব আয়োজন তো কিছুই করা হয়নি! তোরা যে কি করিস! আগে বলবি তো!!
জিকো আর তার বাবা পাপু মুখ টিপে হাসতে থাকে। পাপু বলে মা, তুমি এত চিন্তা কোরো না… আজ সব ব্যবস্থা করবে ভূতের রাজা।
“ভূতের রাজা” সে আবার কোথা থেকে আসবে?
আসবে আসবে ঠাম্মি। আর আজ যা কিছু হবে সব ভূতের রাজার বরে। দেখতে থাকো।
এর মধ্যেই পাপু বাইরের ঘরে ল্যাপটপটা এনে ঝুঁকে পড়ে কাজ করতে বসলো।জিকোর হাতেও মোবাইল। বউমা মিমিও মোবাইলে মন দিয়েছে।
অমিয়বাবু বিরক্ত হলেন- এই এখনকার এক নতুন জীবন হয়েছে…মোবাইল, ল্যাপটপ ছাড়া একমুহূর্ত এদের চলে না।সবসময় চোখের সামনে যন্ত্র ঝুলিয়ে রেখেছে।মুখ তুলে একটু কথা বলতেও সময়ের অভাব।আজকাল তো জিকোর লেখাপড়া, পাপু, মিমির অফিসের কাজ… সবই ঘরে বসে এই যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে।
এই যন্ত্র যেন যন্ত্রণা অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর কাছে। ওনারা এসব শিখতেও চান না। কতবার ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে স্মার্টফোন কিনে দিতে চেয়েছে। কিন্তু ওনাদের সেই এককথা…আমাদের সাবেকী ফোনেই দিব্যি চলে যাচ্ছে… ওসব যন্ত্রণার দরকার নেই।
একদিন তো অমিয়বাবু রেগেমেগে বলেই ফেললেন- মোবাইলের নেশার মত খারাপ আর কোন নেশা নেই। তিনি মনে করেন এই সোশ্যাল মিডিয়াই সোশ্যাল দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের মানুষেরা দূরে চলে যাচ্ছে।পাশের মানুষের সাথে কথা বলার সময় নেই…সব সময় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে অচেনা মানুষদের সাথে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে এরা অথচ চেনা মানুষরা ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। কথা বলার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। কেউ এখন ফোন করে জিজ্ঞেস করে না… কেমন আছো তুমি?
অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর আজকাল বড় একা লাগে। ছেলেমেয়েরা দূরে দূরে…বছরে একবার আসে তারা…তাও মাঝেসাঝে বাদ যায়। সবাই যে কতদিন একসাথে হয়নি। তাও পাপুটা কাছে আছে বলে রক্ষে। একটু সন্তানের মুখটা তো দেখতে পাচ্ছেন। নাতি জিকোকে স্নেহের ছোঁয়া ছুঁতে তো পারছেন!
অমিয়বাবু এবার জোরে বলে উঠলেন-আমাদের শুধুশুধু সেজেগুজে বসিয়ে রাখার মানেটা কি? তোমরা কি করবে জিকোবাবু??
মিমি বললো- আসলে বাবা, সবাই নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে তো… তাই উত্তর দিচ্ছি।তোমরা একটু ধৈর্য্য ধরো…এক্ষুণি ভূতের রাজার বরের জোরে হাততালি দিলেই তোমরা চলে যাবে তোমার বড়মেয়ে, জামাই আর তিতলির কাছে সিঙ্গাপুরে।
একথাটা বলতে না বলতেই স্ক্রীন জুড়ে বড়মেয়ে ঝিমলিকে দেখতে পেলেন অমিয়বাবু আর মীনাদেবী। মেয়ের পিছনে জামাই বাবাজীবন উঁকি দিচ্ছে। আর ওই তো পেছনে তিতলি হাত নাড়ছে আর বলছে “শুভ নববর্ষ” দাদান। সবাই হাতজোড় করে প্রণাম করছে ওদের।
চোখ গোল হয়ে গেলো জিকোর দাদুভাই আর ঠাম্মির। এরপরই ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা গেলো মুম্বাই থেকে বড়ছেলে অপু, বৌমা আর রিকোকে, শিলিগুড়ি থেকে ছোটমেয়ে ইমলি, জামাই আর নাতনী রিমলিকে।
সব্বাইকে একসাথে দেখে অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর চোখ খুশীতে চকচক করছে।কত্তদিন পর একসাথে সব্বাইকে দেখতে পারছেন। কথা বলতে পারছেন।
অমিয়বাবু বললেন- তোদের মনে আছে ১লা বৈশাখের দিন তোদের মা কতরকম রান্না করতেন। কত আনন্দ হতো।একসাথে সবাই মিলে হৈ হৈ করে বছরের প্রথম দিনটা কী মজাতেই না কাটতো। আজ ভারচুয়ালি তোরা সবাই এলি আমাদের ঘরে কিন্তু তোদেরতো কিছু খাওয়াতে পারছি না।
ঝিমলি আর ইমলি একসাথে বলে উঠলো “আমরা তো আজ ভালোমন্দ খাবই কিন্তু এখন আড্ডা, গল্প, গান তো হোক।
এইভাবেই নববর্ষের সকালটা নবহর্ষে কেটে গেলো…এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হলো সবার মন। বিশেষত অমিয়বাবু আর মীনাদেবীর অশক্ত মনে ভালোবাসার পরশ দিয়ে গেলো তার ছেলেমেয়েরা। ছেলেমেয়ে, বৌমা, নাতি-নাতনীদের গিটার, গান, আবৃত্তি, নাচ, গল্প, আড্ডার শেষে ইমলি বললো-বাবা, মা এবারে তোমরা দু’জনে একসাথে একটা গান করো…কী সুন্দর গাইতে তোমরা!
সবাই একসাথে সায় দিলো। অগত্যা ওরা দু’জন দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ত গলায়… একসাথে গাইলেন… “এইতো হেথায় কুঞ্জছায়ায়…স্বপ্ন মধুর মোহে…এইজীবনের যে কটি দিন পাবো…তোমায় আমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাব দোঁহে….স্বপ্ন মধুর মোহে…….”
এরপর দুপুরের লাঞ্চ…মোবাইলে অনলাইনে অর্ডার করে বিখ্যাত দোকান “ভোজ” থেকে খাবার আনানো হলো।
সাদা ভাত, শুক্তো, মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, ঝুরি আলুভাজা, পটলের দোলমা, মোচার ঘন্ট, চিংড়ীর মালাইকারী, মাটন কসা, দই, মিষ্টি…
পরিতৃপ্তি করে খেয়ে দাদুভাই জিকোর কানে কানে চুপি চুপি বললেন… তোদের এই যন্ত্রপাতিগুলো মানে মোবাইল, ল্যাপটপ… এগুলো কিন্তু বেশ কাজের জিনিষ।
একগাল হেসে জিকো বললো দাদুভাই আজ ভুতের রাজার দেওয়া তিন বরের… এক নম্বর… যা চাই খেতে, পরতে পারলাম। ভূতের রাজার দুই নম্বর বরে গান, বাজনাও ভালোই হলো। আর তিন নম্বর… এই হাতে ছোঁয়া দিয়ে যেখানে খুশী যাওয়াও গেলো… দেখলে তো এক নিমেষে কলকাতা, মুম্বাই, শিলিগুড়ি, সিঙ্গাপুর কেমন জুড়ে গেলো!
তাহলে বলো– “ভূতের রাজার জয়”।
খুব ভালো
অনেক ধন্যবাদ 😊
Asadharon