লাল্টু
-অঞ্জনা গোড়িয়া
“শীতের মোজা! সোয়েটার গেঞ্জী রুমাল যা লাগবে তাই পাবে। চলে এসো বৌদিরা দাদারা। আমার চলন্ত ভ্যানের সামনে”।
সেই সঙ্গে সুন্দর একটা গান ভেসে আসছে বক্সে। বাড়ির বাইরে এসে দেখি পাড়ার লাল্টু ভ্যান ভর্তি করে এনেছে শীতের পোশাক। একটু অবাকই হলাম। হাসতে হাসতে বললাম, এই লাল্টু কাল দেখলাম কুমড়ো তরমুজ ভ্যান ভর্তি। আজ আবার শীতের জামা। তোর আসল ব্যবসাটা কী বল তো?
লাল্টুও মজায় মজে উত্তর দিল, বৌদিমনি যখন যা চাইবে তাই পাবে। আমি হলাম আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। বুঝলে। বেশ জমে উঠল ভীড়। কম দামে সুন্দর সুন্দর মোজা সোয়েটার কে না চায়?
গানের তালে তালে গান করতে করতে চললো লাল্টু হাটের দিকে। সন্ধ্যার মধ্যেই গেঞ্জি বিক্রি করে খালি ভ্যানে বাড়ি ফিরলো হাসতে হাসতে।
সকাল হতেই আবার সেই হিন্দি গান চালিয়ে লাল্টু এসে হাজির লেবু, শশা, কুল, আপেল যাবতীয় ফলের ভ্যান সাজিয়ে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি লাল্টু হাসতে হাসতে বলছে, ও বৌদি নেবে নাকি পাকা পাকা ফল। শরীর চাঙ্গা করতে আমি এসে হাজির তোমাদের দোরগোড়ায়।
আবার অবাক হলাম। আজ সেই লাল্টু ফল সাজিয়ে। আমাকে কিছু বলতে হল না, নিজেই বললো যে দিন যা কম দামে বাজারে পাই, তাই কিনে এনে বিক্রি করি। মানুষের চাহিদা আর আমার মন যা চায় তাই বিক্রি করে আমি আনন্দ পাই।
আজ ফল দেখছো গাড়িতে। কাল আনব ফুচকা, চানা, আলুকাবলি। ঠিক বিকাল চারটেয়। তোমরা রেডি থেকো কিন্তু। লাল্টুর ফুচকা যে একবার খেয়েছে তাকে আবার খেতে হবে। মুখে সব সময় তার হাসি লেগে আছে। ফলের গাড়িটা এগিয়ে গেল বাজারের দিকে।
আবার একঘন্টার মধ্যেই বিক্রি করে হাসতে হাসতে লাল্টু বাড়ি ফিরলো।
সপ্তাহে সাতদিনে সাতরকম জিনিসের বিক্রি। এ এক আজব ব্যবসা। লাল্টুর ব্যবহার, হাসি হাসি মুখ আর বিশ্বাসী মন লাল্টুকে আরও মানুষের মনের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। লাল্টুর ভ্যান ভর্তি যে কোন জিনিস তাই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।
একদিন বাড়ির সামনে ফুলকপি, বাঁধাকপি, আরও সব্জি নিয়ে হাজির লাল্টু। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। প্রশ্নটা করেই ফেললাম। আচ্ছা লাল্টু এত রকম ব্যবসা কেন করিস? আর তোর যা বুদ্ধি দেখছি ভালো পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করতে পারতিস। এসব রকমারি ব্যবসা করে ক’টাকা পাস?
লাল্টু ইংরেজিতে গড়গড় করে বললো, আমি মাধ্যমিক পাশ ছেলে বুঝলে বৌদি। কিন্তু তারপর আর স্কুলে যাই নি। কেন জানো বৌদি?
আমার দাদা বি এ পাশ। একটা চাকরির জন্য ফাইল নিয়ে ছোটাছুটি করেছে এ অফিস থেকে ও অফিস। দিনের পর দিন পরীক্ষা ইন্টারভিউ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে আজ মানসিক প্রতিবন্ধী। উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পায় নি। যেখানেই যায় নেতার দাদা কাকা আর টাকার বান্ডিল চায়। সাধারণ মানুষের জন্য চাকরি কে দেবে?
বাবার তখন কারখানা বন্ধ। বিবাহযোগ্যা দিদি বাড়িতে। মা পরের বাড়ি কাজ করে আমাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব তুলে নিল।
লজ্জায় অপমানে দাদা, একপ্রকার পাগল হয়ে ঘরের এককোণে বসে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে সবসময়। তাই আমি আর একমুহূর্ত ভাবিনি। মাধ্যমিকটা পাশ করেই বেরিয়ে পড়ি ব্যবসা করতে। পরের কেরানি গিরি না করে এই স্বাধীন ব্যবসায় অনেক সুখ গো বৌদি। মনে আনন্দ পাই। শান্তি আসে। কিছুদিনের মধ্যে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ভ্যানটা কিনে নিলাম। তারপর দিব্যি চলছে আমার রকমারি বিক্রি। আর একমাসের মধ্যে লোনটাও শোধ হয়ে যাবে। সামনে মাসে দিদির বিয়ে দিচ্ছি। মাকে আর পরের বাড়ি কাজ করতে দিই না। বাবা এখন খুব খুশি। আর দাদাকে… ভালো ডাক্তার দেখাচ্ছি।
একমুখ হাসতে হাসতে বললো, এবার আসি গো বৌদি। কাল আনব নতুন ডিজাইনের চুড়িদার,ৎব্লাউজ শাড়ি। কী একটা নেবে তো বৌদি?
আমি বললাম, তোর মুখের হাসি দেখতে আসতেই হবে তোর গাড়ির সামনে। আর না কিনে উপায় আছে! লাল্টুর সঙ্গে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরলাম। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে লাল্টুর ভ্যানের সেই গানটা। “হাসতে হাসতে রোনা শেখো। রতে রতে হাসনা শেখো।”