সুলতার হাতপাখা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
মিঠা পাতি পানটা মুখে পুরে, তালপাতার হাত পাখাটা নাড়তে নাড়তে বেশ রসিকতা করে সুলেখা তার বড়দি সুলতাকে বলে, হ্যাঁ রে বড়দি তোদের কলকাতাতে তো ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই যথেষ্ট ভালো। তাও তোর মাথা বালিশের পাশে হাতপাখা! ওরে হাতপাখার যুগ থেকে বেরিয়ে আয় তুই এবার।
তোর দুই ছেলেমেয়ের রুমেতেই তো এয়ার কন্ডিশন মেসিন লাগানো আছে। এবার তুইও একটা তোদের শোবার ঘরে এসি মেসিন লাগিয়ে নিস। আর কতকাল কৃচ্ছসাধন করবি।
পাশেই বসে ছিলেন সুলেখার বড় জামাইবাবু অঘোর বাবু। উনি এবার শুরু করলেন ঠিক এইভাবে, ছোট শালি তোমার বড়দির হাতপাখা নিয়ে কিন্তু রসিকতা করো না। যদি মাথাটা ওর গরম হয়ে যায় তখন কিন্তু পাখার হাতল দিয়ে ধরিয়ে দেবে দুচার ঘা।
সুলেখাও কম যায় না। সে বেশ কৌতুক করে বলে, জামাইবাবু মনে হচ্ছে আপনাকে শাসনে রাখতেই বড়দি আজও হাতপাখাটা মাথার গোড়াতে নিয়ে ঘুমায়?
অঘোর বাবু মুচকি হেসে বলে, বেডরুমের কথা স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। এইসব কথা পাঁচ কান করতে নেই। তবে তোমার দিদির হাতপাখা কিন্তু মানুষের জীবন পর্যন্ত বাঁচিয়েছে।
সুলেখা বিস্ময়ের সাথে বলে, বলেন কি জামাইবাবু? অ্যাই দিদি বল না একটু শুনি সেই গল্পটা।
সুলতাও একটা মিঠা পাতি পান মুখে পুরে তার নিজস্ব স্বভাববশত ফ্যানের রেগুলেটারের স্পিডটা খানিক কমিয়ে দিয়ে খাটেতে এসে বসল। বসেই হাত বাড়িয়ে সুলেখার কাছ থেকে তালপাতার পাখাটা চেয়ে নিল।
তারপর বলে, এটা তোদের কাছে তালপাতার একটা হাতপাখা মাত্র। কিন্তু আমার কাছে অজস্র স্মৃতির খাজানা বুঝলি। দেখ লেখা (সুলেখা) এই পাখাটার পাতার মধ্যে কত নাম লেখা আছে নিঃশ্চয় তুই দেখতে পেয়েছিস। গরমের দিনে ছাদে রিমি, বুবাইকে নিয়ে আগে যখন হ্যারিকেনের আলোয় পড়াতে বসতাম। তখন একটু ফাঁক পেলেই দুটোতে পেন দিয়ে পাখার গায়ে নাম লিখতো, মাঝে মধ্যে ছড়া’ও।
আজ’ও এইসব আঁকিবুকি দেখলে মনটা ভরে যায়। ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু ওদের ছেলেমানুষীর সাক্ষ্য এখনও এই তালপাতার পাখাটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এইসব কথাগুলো বলতে বলতে, সুলতা খানিক পাখাটার গায়ে হাত বুলিয়ে নিল।
তবে আমার হাতপাখা যে কোনো মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে পারবে এটা আমি আগে কোনদিন ভাবতে পারি নি।
গত বছর বাসে করে মায়াপুর যাচ্ছিলাম আমি আর তোর জামাই বাবু। বুবাই অনলাইনে থাকার ব্যবস্থা করে ছিল চৈতন্য ভবনে। আমি বারণ করে ছিলাম ছেলেকে যে এসি রুমের কোনো দরকার নেই। একটু বেশি গরম লাগলেই আমি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোল্ডিং হাত পাখাটা বের করে নেবো।সে তো ছেলে শুনলো না।
যাক গে সে কথা। বাসের সামনের দিকে সিট ছিল আমাদের। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমও তখন বেশ।বাসটাতে সব সিটই ভর্তি। বাসটা চালু হতেই বেজে উঠল হরিনাম সংকীর্তন।আমি তো জানালার ধারের সিটে বসেছিলাম। তাই বাইরের মানুষের ব্যস্ততা, কোলাহল, দোকানদারদের হাঁক ডাক, গাড়ী ঘোড়া দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম।
৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে বাস ছুটে চলেছে ঝড়ের বেগে। হঠাৎ বাসের পিছন সিট থেকে ভেসে এলো করুণ আর্তনাদের আওয়াজ, বাস থামাও, বাস থামাও।
গোটা বাসের যাত্রী বিস্ময়ের সাথে চেয়ে দেখে, একদম পিছন সিটে একজন বয়ষ্কা মহিলা ভীষণ ভাবে হাঁপাচ্ছে। তার পাশে বসে আছে সতেরো আঠেরো বছরের একটি মেয়ে। সে বয়ষ্কা মহিলার মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে ব্যাকুল ভাবে সাহায্যের আবেদন করছে সকলের কাছে।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই ড্রাইভার বাসটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করালো। বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা ছুটে গেল বয়ষ্কা মহিলাটির কাছে। একজন ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে চোখে মুখে ছিঁটে মারতে লাগলো।
বয়ষ্কা মহিলাটির শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। বারবার সে মুখ হাঁ করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এইসব দেখে তো ড্রাইভার তো বেশ ভয় পেয়ে যায়। সে চিৎকার করে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, আপনারা যে যার নিজের জায়গায় বসুন। একটু বাইরের হাওয়া আসতে দিন। কারোর কাছে কি হাতপাখা আছে? তাহলে সরাসরি হাওয়া করা যায় দিদিমাকে।
এই কথা শুনে তোর জামাইবাবু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আমাদের কাছে হাতপাখা আছে। এক্ষুণি দিচ্ছি।
তোর জামাই বাবুর চোখে মুখে আমি সেদিন দেখেছিলাম একজন অপরিচিত বয়ষ্কা মহিলার জন্য চরম উৎকণ্ঠা। সেদিন আমাকে বলেছিল, সুলতা তোমার হাতপাখাটা তাড়াতাড়ি দাও আমাকে। বয়ষ্কা মহিলাটির বাতাসের প্রয়োজন।
আমি জানতাম হাতপাখা দিয়ে বেশিক্ষণ বাতাস করার অভ্যাস তোর জামাইবাবুর নেই। তাই আমি নিজেই বেতের ফোল্ডিং হাতপাখাটা নিয়ে বয়ষ্কা মহিলাটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমাকে দেখা মাত্রই সতেরো আঠেরো বছরের মেয়েটি কেঁদে উঠে বলে, আন্টি আমার ঠাকুমার হঠাৎই খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। এখন আমি কি করবো? বিনা চিকিৎসায় আমার ঠাকুমা কি মারা যাবে?
বয়ষ্কা মহিলাটিকে দেখে আমারও পরিস্থিতি খুব একটা ভালো মনে হচ্ছিল না। তবুও বললাম তুমি এতো চিন্তা করো না। এই তো আমি হাতপাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করবো। উনি নিঃশ্চয় সুস্থ হয়ে উঠবেন। তুমি তোমার ঠাকুমার মাথাটা আমার কোলে রেখে দাও। এই বলে মেয়েটির জায়গায় আমি বসলাম আর প্রাণপণে হাতপাখাটা নেড়ে বাতাস করে চললাম।
ড্রাইভার সকলের উদ্দেশ্যে বলে, এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা নার্সিং হোম আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে চেষ্টা করছি পৌঁছানোর।
গোটা বাস একসাথে বলে উঠল, চলুন দাদা চলুন। তাড়াতাড়ি চলুন।
প্রায় আধঘণ্টা যাওয়ার পর পেলাম সেই নার্সিং হোম। ততক্ষণে অবশ্য বয়ষ্কা মহিলার শ্বাসকষ্টটা সামান্য কমে ছিল। আমার হাতপাখা অনবরত বাতাসে বোধহয় সামান্য আরাম বোধ করেছিল।
বাসটা থামিয়ে ড্রাইভার অনুরোধ করল, আমার সঙ্গে তিন চার জন মানুষ আসুন।রিসেপশনে কথা বলতে হবে।
তোর জামাইবাবু আরো দুই জন ব্যক্তি গেল নার্সিং হোমের ভিতরে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই স্ট্রেচার নিয়ে দুজন ছেলে এসে বয়ষ্কা মহিলাকে নিয়ে গেল।
ডাক্তার দেখা মাত্রই ইনজেকশন পুশ করে এবং আধঘণ্টা সকলকে অপেক্ষা করতে বলে।
আধঘন্টার পর বয়ষ্কা মহিলাটি কথা বলার চেষ্টা করে। সে জানায় সে এখন আগের থেকে অনেকখানি সুস্থ বোধ করছে। বারবার সে বলে, আমাকে যে ভদ্রমহিলা বাতাস করছিল তাকে একবার ডেকে দিন।
আমি তার কাছে যেতেই সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার হাতপাখার হাওয়া না পেলে আমি হয়তো বাসেই মারা যেতাম।
-থাক না মাসিমা এইসব কথা। এখন আরাম লাগছে তো?
চোখগুলো বুজে জানান দিয়েছিল, হ্যাঁ।
ওনার নাতনি ইতিমধ্যে বাড়িতে ফোন করে দিয়েছে। সুতরাং আর ভয়ের কিছু নেই। ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাড়ির লোক এসে পরবে।
ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ড্রাইভার বাসের স্টেয়ারিং এ এসে বসলো। ড্রাইভার সমেত পুরো বাসের যাত্রী আমাকে সেদিন বলেছিল, ভাগ্যিস আপনার হাতপাখা করার অভ্যাস আছে। তাই তো প্রায় আধঘণ্টা একনাগাড়ে বাতাস করতে পারলেন। আপনার হাতপাখার শীতল বাতাসে বয়ষ্কা মহিলাটির প্রাণটা রক্ষা পেল।
জানিস লেখা (সুলেখা) সেদিন তোর জামাইবাবুর চোখে মুখে দেখেছিলাম প্রশান্তির ছায়া। আমার এই হাতপাখা করার অভ্যাসটার জন্য মাঝে মধ্যেই উনি আমাকে ব্যাকডেটেড বললেও সেদিন আমার এই অভ্যাসের জন্য বেশ গর্বিত হয়েছিল সেটা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।