শব্দভেদী বাণ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
বাড়িতে ঢোকা যাচ্ছে না। শব্দভেদী বাণ না নিয়ে বাড়িতে যাওয়া যাবে না।
বুলিবুলি নির্ঘাৎ সিঁড়ির পাশের বারান্দায় ঘুরঘুর করছে। যদিও রাত দশটা বেজে গেছে। এইটা ওর ঘুমোনোর সময়। কিন্তু আজ কি তেমনই হবে?
মাত্র চার বছর বয়স। কী সাংঘাতিক জেদ রে বাবা। অবিশ্যি দোষ কাকুরই।
টিভিতে রামায়ণ সিরিয়ালে রামের বাবা দশরথের ছোঁড়া শব্দভেদী বাণে অন্ধমুনির একমাত্র ছেলের মৃত্যু হলো।
চার বছরের বুলিবুলি কী মাথামুণ্ডু বুঝলো কে জানে, হঠাৎ কাকুর কাছে বায়না ধরলো, তার শব্দভেদী বাণ চাই।
কাকুর উচিৎ ছিল তখনই তাকে বুঝিয়ে বলা যে এসব প্রাচীন ব্যাপার, এখন আর শব্দভেদীর যুগ নেই। এখন শব্দ করার যুগ। দুম ফটাস ব্যস হয়ে গেল।
তা না করে বাহাদুরি দেখিয়ে বলে দিলো,
“ঠিক আছে কাল অফিস ফেরত নিয়ে আসবো।”
মনেই ছিল না। কিন্তু বুলিবুলি ভোলবার মেয়ে নয়। কাকু বাড়ি ফেরা মাত্রই ছুটে এলো।
“দাও শব্দভেদী বাণ।”
কী ভাবে বলবে ভুলে গেছে। তাই মিথ্যার আশ্রয়।
“আজকে বড্ড কাজ ছিল সোনা। একদম সময় পাইনি। কাল আনবো।”
পরের দিন আবারও একই ব্যাপার। আবারও নতুন মিথ্যা।
“আজ বাণ পেয়েছিলাম কিন্তু শব্দভেদী নয়। কাল আনবো।”
চার বছরের মেয়ে মিথ্যার কারসাজি বোঝে না। তার সরল বিশ্বাস। সুতরাং কালের অপেক্ষায় তার আরও কয়েকটা কাল কেটে গেল। ইচ্ছেপূরণ হলো না। এবার ধৈর্যের পাঁচিল খসে গেল। লাস্ট ওয়ার্নিং।
“আজই চাই। যেমন করেই হোক। আজ চাই…চাই… চাই… নইলে বুঝবে ঠ্যালা। কেঁদে কেটে একসা করবো। কারুর কথা শুনবো না। খাবোও না।”
এই শেষের কথাটা মারাত্মক। খাবোও না। ক্লিয়ার ব্ল্যাকমেইল। শিখলো কোথায়, কখন, কীভাবে? আশ্চর্য! এরা তো কিচ্ছুটি শিখে আসে না। এসে শেখে।
আজ আর চালাকি চলবে না। তাই আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার যতগুলো খেলনার দোকান আছে সব চষে ফেললো। নাহ্, কোথাও নেই।
হায় কপাল। এতো বড়ো শহরের একটা শিশুর চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা নেই?
তা-ও তো শব্দভেদী বাণ চায়ই নি। চাইবার প্রশ্নই নেই। যা নেই, কেবলই কল্পনা, তাই চেয়ে হাস্যরসের উপাদান যোগানোর মতো পাগল সে নয়। তাই শুধু একটা সাধারণ তীর-ধনুক চেয়ে ছিল। বিশ্বাস ছিল এটুকু পেলেই শিশুমন শান্ত হবে। হায় রে, তা-ও নেই।
সব দোকানদারদের একই কথা,
“এখনকার বাচ্চারা ওসব তীর-ধনুক টনুক নিয়ে খেলা করে না। অন্য কিছু নিয়ে যান। নতুন নতুন ইলেকট্রনিক ডিভাইস আছে। বাচ্চাদের এইসবই পছন্দ।”
সুতরাং কি আর করা। বুলিবুলির আবদার মেটানোর সাধ্য যখন নেই, তখন বিকল্প একটা কিছু তো ব্যবস্থা করতেই হয়। তাই অনেক ঘেঁটেঘুঁটে একটা বেশ বড় বন্দুক কেনা হয়ে গেল।
দারুণ দেখতে। প্লাস্টিকের তৈরি, ফুটখানেক লম্বা। খানকতক ব্যাটারি ভরে ট্রিগার টিপলেই বন্দুকের সারা গায়ে নানান রঙের আলো ঝলমল করে লাফালাফি করবে। আর আওয়াজ করবে গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট। বেশ চটকদার খেলনা।
তবুও সন্দেহ থেকেই যায়। বুলিবুলি যদি জেদ বজায় রেখে বলে, না আমার এ চাই না। আমার শব্দভেদী বাণ চাই, তবেই হয়েছে।
ছোটদের খুশি করতে না পারলে, বড়দের মনও যে দুখী হয়, সেকথা ছোটদের বোঝায় এমন সাধ্য কার!
খেলনাটা ব্যাগের ভেতর নিয়ে কাকু চুপিচুপি পা টিপে টিপে প্রায় চোরের মতো বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে চলে গেল। যাকে নিয়ে ভয় সেই বুলিবুলির সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
মা এসে বললেন,,
“কি রে আজ এতো দেরী হলো, কোথাও গিয়েছিলি?
“না। মানে, বুলিবুলির জন্যে একটা খেলনা কিনতে গিয়েছিলাম।”
“ওঃ, তাই বারবার তোর খোঁজ করছিলো!”
“কোথায় ও, ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“হ্যাঁ। এই তো খানিক আগেই, থাক না, কাল সকালে দিবি। হাতমুখ ধুয়ে আয়। খেতে দেবো।”
যাক, খানিকটা রিলিফ। কাল যা হয়, দেখা যাবে।
পরদিন, তখন সকাল আটটা নাগাদ বুলিবুলি কাকুর ঘরে এসে হাজির।
“কি গো এনেছো, ভুলে যাওনি তো? দাও।”
গলায় বড়সড় অফিসারের সুর। প্রবল দাবী। এ দাবী উপেক্ষা করে এমন সাধ্য কার।
কাকু কিছুটা ইতস্তত করে ভয়ে ভয়ে ব্যাগ থেকে সেই বন্দুকটা বের ক`রে বুলিবুলির হাতে দিলো।
সে সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোয়েন্দার মতো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। চোখে মুখে একটা কেমন যেন সন্দেহের ছায়া। তারপরই বললো,
“এটা তো বন্দুক। শব্দভেদী বাণ কোথায়?”
কাকু কাঁচুমাচু মুখে বললো,
“এই তো, এই দ্যাখো এই-যে ট্রিগার দেখছো এখানে একটু চাপ দাও, দেখবে কেমন শব্দভেদী বাণ হয়ে যাবে।
এইটা হলো আধুনিক মানে এখনকার শব্দভেদী বাণ। টিভিতে যেটা দেখেছো সেটা প্রাচীন কালের ব্যাপার। নাও ট্রিগারে চাপ দাও।”
ট্রিগারে কচি হাতের কৌতুহলী চাপ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক নানান রঙে রঞ্জিত হয়ে বিকট আওয়াজ করতে শুরু করলো।
গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট,,,
সারা বাড়িময় সেই বিকট আওয়াজ, সকালের কর্মব্যস্ততার যাবতীয় মনঃসংযোগ ভেঙে চুরমার করে দিতে লাগলো।
রান্নাঘর থেকে বুলিবুলির মা আর ঠাকুমা, তিতিবিরক্ত হয়ে রান্না ফেলে ছুটে এসে চিৎকার করতে লাগলো,
“এ-ই কী আরম্ভ করেছিস তোরা এই সকালবেলা! এখনো কত রান্না বাকি। এইভাবে যাচ্ছে তাই আওয়াজ করলে রান্না করতে পারবো না, বলেদিলুম। কী খেয়ে অফিস ইস্কুল যাবি সব যা।”
এখানে “সব” মানে, যাদের উদ্দেশ্যে এই সতর্কবার্তা বর্ষিত হচ্ছে তারা হলো,বুলিবুলির বাবা, কাকু এবং বুলিবুলি ও তার দু’বছর বড় দাদা।
বুলিবুলি বড়দের চ্যাঁচামেচি এবং সেই চ্যাঁচামেচির কারণ সে নিজে, এটুকু বুঝতে পেরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আওয়াজ বন্ধ করে কাকুর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রইলো। কাকু তার ঐরকম অসহায় মুখের চেহারা দেখে না হেসে পারলো না।
তার মাথায় নির্ভয়তার হাত বুলিয়ে প্রশ্রয় দেবার ভঙ্গিতে চোখ টিপে ফিসফিস করে বললো,
“চালিয়ে যা, থামবি না।”
বুলিবুলি দ্বিগুণ উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে ট্রিগারে আঙুল চালাতে লাগলো।
গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট ফটফট ফটফট।
এদিকে যত আওয়াজ হয়, ওদিকেও ততই মুখের তড়পানো বাড়ে।
“বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। বুড়োধাড়ি জুটেছে বাচ্চার সঙ্গে। সকাল থেকে অসভ্যতা শুরু হয়েছে, ছি ছি, লজ্জাও করে না।”
কাকু ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে,
“দেখলি তো? একেই বলে শব্দভেদী বাণ। কান দিয়ে ঢুকে একেবারে মাথার ঘিলুতে গিয়ে গোঁত্তা মারবে।
থামবি না, মনের সুখে চালিয়ে যা।
গোঁও গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট ফটফট। একেই বলে শব্দভেদী বাণ, হা হা হা হা,
বুলিবুলির মুখেও তখন দুষ্টুমি ভরা চওড়া হাসির নির্মল ঝিলিক।