মনের খবর
-শিলাবৃষ্টি
ভীষণ ভালোবাসতাম জানো, ওর প্রতি খুব টান অনুভব করতাম। কিন্তু বলতে পারিনি সেদিন। কিছুতেই বলতে পারিনি। কতবার ছুটে গেছি শুধু একবার জানতে চাইব বলে, সেও কি ভালোবাসে আমাকে? না অন্য কাউকে! সময় বয়ে গেছে তার নিয়মে। আমার না বলা কথা মনের অন্তস্থলেই থেকে গেছে। এখনো দেখা হয় বছরে দু’এক বার।
বিচলিত হই। একান্তে বসে গল্প করার ইচ্ছেও হয়।
হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের একটা মাধ্যম যদিও আছে, তবু সেখানে বিশেষ দিনে বিশেষ ম্যাসেজ ছাড়া আর তেমন কিছু দেয়া নেয়া হয় না।
আমাদের পাড়ায় ভাড়া এসেছিল অশোকদারা।
দুর্গাপূজার সময় আলাপ হলো ওদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের। বিজয়া সম্মেলনে অশোকদা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে আমার মন জয় করে নিল। জানলাম প্রেসিডেন্সি কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। ম্যাথ অনার্স। আমার তখন ইলেভেন। সাইন্স নিয়ে পড়ছি। মাঝে মাঝে অঙ্কের খাতা নিয়ে ছুটির দিনে দৌড়াতাম অশোকদার কাছে। কখনো দেখিয়ে দিত, সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত। আবার কখনো “ধুস পালা৷ আমি এখন বেরোবো, কাজ আছে” বলেই বেরিয়ে যেত। মাসীমা যেতে দিতনা সহজে। রান্না করতে করতে গল্প করতো। ওদের বীরভূম জেলায় বিরাট বাড়ি, অনেক মানুষ। ছেলের লেখাপড়ার জন্য কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। নাড়ু মোয়া, এটা ওটা আমায় খাওয়াতো। কখনো কখনো বলতো “দেখতো মা, তোর দাদা এলো কিনা!”
“দাদা” শব্দটায় আমি হোঁচট খেতাম। একদম ভালো লাগতোনা। কারণ আমার মনে তখন ভালোবাসার প্রথম বসন্ত। অশোকদাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমার চোখে। বুঝতাম পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে! তবু মন মানতো না। চোখ শুধু খুঁজে ফিরতো কাউকে। কিন্তু তার তেমন কোনো ইন্টারেস্ট দেখতাম না। তুই বলে সম্বোধন! এসব দেখেশুনে আমার কেবলই মনে হতো.. তাহলে অশোকদাও কি আমাকে বোনের চোখেই দেখে! এই ভাবনাটাই আমার কাছে কষ্টদায়ক ছিল। আমার নিজের দাদা ছিলনা তবু আমি দাদার আসনে ওকে বসাতে পারিনি।
ভালোভাবেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে রেজাল্ট নিয়ে ছুটলাম ওদের বাসায়। কিন্তু খুব খুশী হলো না। মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললো “ফাঁকি দিয়েছিস! এর থেকে অনেক ভালো রেজাল্ট তুই করতে পারতিস।” তারপরেই চেঁচিয়ে মাকে ডাকলো “মা ওকে মিষ্টি খাওয়াও! অনেক কষ্ট করে পাশ করেছে।”
জানাতে পারলাম না আমার মনের কথা। ওর তখন সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। এসব কথা বললে হয়তো পড়াশুনার ক্ষতি হবে!
একটা সুযোগ এলো, অশোকদার পরীক্ষার পরে লম্বা ছুটিতে যখন ওরা বাড়ি যাবে বাসন্তী পুজো উপলক্ষে পাড়ার কয়েকজনকে আমন্ত্রণ করলো।
আমি আর মা ওদের সাথেই গেলাম ওদের বীরভূমের বাড়িতে।
পুরানো আমলের বিশাল জমিদার বাড়ি। সবুজ দিয়ে ঘেরা। আমার খুব ভালো লাগলো ওদের পরিবেশ। অশোকদা আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ওদের পুকুর, মন্দির, গ্রাম সব দেখালো, কেমন ছেলেমানুষ হয়ে গেল। অনেক গল্প করলো। ভাবলাম এই সুযোগ আর পাবোনা। পুজোর দিন বলবো। একটু ভয় ছিল! যদি রেগে যায়! আর কখনো কথা না বলে! না৷ ভয় পেলে চলবেনা কিছুতেই।… পরের দিন ভীষণ আড়ম্বরে পুজো শুরু হলো। হায় কপাল! আমি যখন সুযোগের সন্ধান করছি, ঠিক তখনই কলকাতা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র-ছাত্রী মানে অশোকদার বন্ধুরা এসে হাজির। ব্যাস ওদের নিয়েই ও ব্যস্ত হয়ে গেল! আমাকে যেন ও চেনেই না। খুব খারাপ লাগছিল। আরো খারাপ লাগছিল, যখন নিবেদিতাদিকে নিয়ে অশোকদাকে ওরা ইয়ারকি করছিল। নিবেদিতাদি বেশ ভালো দেখতে। পোশাক পরেছে খুব সোবার। কথাবার্তাও খুব সুন্দর, মার্জিত। সেদিন শুধু মনে হয়েছিল নিবেদিতাদিকেই অশোকদা ভালোবাসে।
আমরা বাড়ি এলাম পরের দিন। আর আমি পেছাতে শুরু করলাম।
এর কয়েকমাস পরেই ওরা চলে গেল আমাদের পাড়া থেকে। অশোকদা আমাদের বাড়িতে দেখা করতেও এসেছিল। বললো, ভুবনেশ্বর ইউনিভার্সিটিতে এম এস সি করবে। চান্স পেয়ে গেছে।
আমাকে বলে গেল “ভালো করে লেখাপড়াটা কর। ফাঁকি দিবিনা একদম। অবসরে চিঠি লিখিস!” আমার চোখে জল দেখে আবার বললো “পাগলি একটা! মায়ের সাথে দেখা করে আসবি!”
গেছিলাম। তখন ও ছিলনা। মাসীমার চোখেও জল দেখলাম। বার বার বললেন বীরভূমের বাড়িতে যেতে।
ব্যাস… এরপর মনটাকে বুঝিয়ে ছিলাম “যা আমার নয়, তার জন্য মন খারাপ করবোনা।
ঠিকানা দিয়েছিল। চিঠিও লিখেছি, উত্তর পেয়েছি কাব্যে ভরা। এরপর শুধুই ব্যস্ততা! প্রচুর চাপ। আমি এম এস সি করে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছি। তারপর একবার আমাদের পাড়ার কয়েকজন মিলে ওদের বাড়ির সেই বাসন্তী পুজোয় গিয়েছিলাম। দেখা হলো, কথা হলো। আমরা রাতেই ফিরে এসেছিলাম। তারপর ভালো পাত্র দেখে আমার বিয়ে দিয়ে দিল বাবা মা।
বিয়ের পর বরকে নিয়ে যখন তারাপীঠে গেছি, গাড়ি নিয়ে সোজা ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এসেছি। অশোকদা ছিলনা। শুনলাম উত্তরবঙ্গের একটা কলেজে পড়ায়। রিসার্চ করছে।
শুনে খুব ভালো লাগলো। আরো কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমি এখন মা। আমার ছেলের বয়েস দশ। দুর্গাপূজার সময় বাপের বাড়ি আসি, এবারেও এসেছি। বিজয়া সম্মেলনে চমকে উঠলাম অশোকদার নাম শুনে। গাইলো – “আমার প্রাণের পরে চলে গেল… ”
আবার দেখা হলো। বাড়িতেও এলো। অনেক কথা হলো। আমার বরের সাথে আলাপ করলো।
অবাক হলাম বিয়ে করেনি শুনে। একা কথা বলার অনেক সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু অশোকদা তো শুধুই আমার ছেলের সাথে খুনসুঁটি করতেই ব্যস্ত!
সামনেই মায়াপুরের রাধাকৃষ্ণর বিশাল ছবিটার দিকে তাকালাম। মন যেন নির্দেশ
পেল — এই তো একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক!! কি লাভ!! এখন আর বিব্রত করে বা বিব্রত হয়ে। যে কথা সময়ে বলা হয়নি, আজ আর তা বলতে চাইনা!