গন্ধ
–রাখী চক্রবর্তী
(আমরা ঘ্রাণ শক্তি নিয়ে সবাই জন্মগ্রহণ করি। ফুল, ফল, খাবারের গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারি এটা কোন ফুল ফল বা খাবার,
আশ্বিনে শিউলির গন্ধে আকাশ বাতাস ভরে যায়। রজনীগন্ধা, বেল, জুঁই ফুলের সুগন্ধীতে ভরে যায় আমাদের মন, এর মধ্যেও আরও একটা বিশেষ গন্ধ আছে, এই বিশেষ গন্ধ নিয়ে আমার লেখা “গন্ধ”)
অতনু কলেজের প্রফেসর। রোজ সকাল আটটায় চা বা কফির কাপ হাতে নিয়ে মা’র ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক সময় তো চা কফি ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সেটা মুখে দেওয়াও হয় না অতনুর।
আজ বৃষ্টি পড়ছে অতনু মা’র ছবি বুকে নিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে।
শ্রীতমা দশ মিনিট আগে অতনুকে চা দিয়ে গেছে। অতনু’র স্ত্রী শ্রীতমা, ধনী পরিরাব থেকে এসেছে। অতনুও বেশ বড় ঘরের ছেলে তবুও শ্রীতমার জীবনযাত্রা একটু অন্য রকম। পার্টি হৈচৈ এই নিয়ে বেশ ভালো আছে ও।
অতনু চায়ের কাপে চুমুক দিল কি না সেটা শ্রীতমা নজর রাখছে। অতনু বিভোর হয়ে আছে মা’র ছবি বুকে নিয়ে, ভাবছে…
-মা তোমার গা দিয়ে কী মিষ্টি গন্ধ বের হয়, কেন বলো তো?
-ওরে গলাটা ছাড়, রুটি বেলতে দে, তোর বাবা অফিস যাবে। টিফিন করে দিতে হবে তো।
-না ছাড়বো না, আগে বলো কোন মিষ্টির গন্ধ বের হয় তোমার গা থেকে?
-তুই বল, আমি কি করে বলবো। তুই তো দিনরাত আমার গায়ের গন্ধ শুঁকিস।
-রসগোল্লা ?
-কি বললি! রসগোল্লার গন্ধ?
-মিষ্টি গন্ধ মা..
-এখন থেকে বইয়ের গন্ধ শোঁকো, আমি তোমার গা থেকে ডাক্তারের গন্ধ যেন পাই।
-এখন তো মাত্র তেরো মা। এখুনি ডাক্তারের গন্ধ?
-বড় হলে বলেছি, যা বিরক্ত করিস না। স্কুল ছুটি থাকলেই তোর বাঁদরামো বাড়ে।
-তাহলে আর তোমার ছেলের ডাক্তার হওয়া হলো না।
-কেন ?
-বাঁদর কখনও ডাক্তার হয়?
-ওরে দুষ্টু ছেলে
-ধরতে পারে না
-দৌড়াস না পড়ে যাবি…
শ্রীতমা ব্যালকনিতে এসে অতনুকে ধমক দেয়, চা তো গেল বরফ হয়ে। মা’র ছবিটা নিয়ে কি ভাবো বলো তো? কারোর মা কি সারাজীবন বাঁচে বলো। আমার বাবা তো কবে মারা গেছে তখন আমি চার বছরের।ছবিগুলো দেখি, তাই বাবাকে দেখি, বিশেষ কিছু মনে নেই। আবছা মনে পড়ে বাবাকে।
অতনু ছলছল চোখে শ্রীতমাকে বলে, সেটা না, আমি মা’র দেওয়া কথা রাখতে পারিনি এইটাই ভাবায় আমাকে। আমার পেছনে ছুটতে গিয়ে ই তো মা…
-থাক, আর না এবার ওঠো, অফিস যাও।অনেক হয়েছে একই কথা বারবার বলে মনে কষ্ট পাও। বাবাকে দেখে রাখো ওনার তো বয়স হচ্ছে।
-হুম উঠি। খুব বৃষ্টি হচ্ছে না?
-সকাল থেকে শুরু হয়েছে। নিম্নচাপ তিনদিন থাকবে।
-এই তমা একটু এসো না কাছে, আমার খুব কাছে।
-না না টেনেটুনে বসিয়ে আমার গায়ের গন্ধ শুঁকবে একদম না। তোমার মা’র ঠিক আছে। আমার ভালো লাগে না। বদ্ অভ্যাস সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছো। সেদিন আমার মা’র সাথে তুমি, ছি ছি… আমার মা ভাবলো, জামাইয়ের মতিভ্রম হয়েছে।
নেক্সট মান্থে পার্টি আছে। খুব সাবধান।আমার কলেজের বন্ধুরা আসবে। ওদের গায়ের গন্ধ শুঁকতে যেও না আবার, কি মুশকিলে পড়া গেল। তোমার সঙ্গে প্রেম করার সময় কেন যে লাইটলি নিলাম।ভেবেছিলাম আমার গায়ের গন্ধ তোমার খুব ভালো লেগেছে মানে পারফিউমের গন্ধ।এখন দেখেছি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো।
-তমা, কালু আসবে না?
-ওমনি কথা ঘুরিয়ে দিলে, আমি বলবোই যতই তুমি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাও, কাজের মধ্যে এক কলেজ যাওয়া আর আসা, আর গন্ধ শোঁকা, এর তার কাপড়ের আঁচল ধরা, ওড়না টানা ডিসগাস্টিং।
-কালু এলে বলে দিও বাথরুম থেকে ফিনাইলের গন্ধ বের হচ্ছে। আমার নাকে ফিনাইলের গন্ধ গেলে ওয়াক চলে আসে।
-ওমা! তাই নাকি, সেদিনের কথা ভুলি কেমন করে। ঢ্যামনা সাপ যেদিন বাথরুমে ঢুকে ছিল। তুমি তো ফিনাইল ঢেলে সাপটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলে। কি হলো গন্ধ!
-বাটার টোস্ট দাও। খেয়ে অফিস যাই। বাজে বকে শুধু…
-অফিস থেকে বাড়ি আসার সময় কোবরা নিয়ে এসো।
-কী! কোবরা সাপ, এখন সাপদের নিয়ে খেলছো, ভালো বেশ ভালো, খুব ভালো, চমৎকার।
-আরে বুদ্ধু, পারফিউম! বলছি কি কলেজে তো অনেক মেয়ে, তাদের আবার ওড়না নিয়ে টানাটানি করো না তো। সম্মানের দিকটা দেখো কিন্তু, তোমার স্বভাব দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
অতনু শ্রীতমার দিকে তাকিয়ে ওর মা’র ফটো ইজিচেয়ারে রেখে ব্যালকনি থেকে ঘরে চলে গেল।
শ্রীতমা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা হাতে নিয়ে রোমান্টিক স্বরে “অতনু” বলতেই অতনু ব্যালকনির সামনে এসে বললো, আমি কলেজ যাব না আজ।
তমা রেগে গিয়ে বলল, বাথরুমে যাওনি এখনো ?
-না,কলেজ যাব না, মুড ভালো নেই।
-বাড়িতে থেকে কি করবে,ৎকলেজ যাও মন মেজাজ ঠিক থাকবে,পকেটটাও ঠিক থাকবে, সরকার তো তোমার মুড দেখে মাইনে দেয় না।
-একদিন না গেলে কি হয়!
-কী সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে, তুমি আমার মুডটাই নষ্ট করে দিলে।
-একটু কাছে এসো না তমা, ভীষণ একা একা লাগছে।
-জড়াবে না একদম, দিনের বেলা এটা-
-তমা আমাদের বিয়ে ক’মাস হলো?
-পাঁচ মাস, কেন?
-হানিমুনে যাওয়া হলো না আমাদের, কোথায় যেতে চাও বলো, নিয়ে যাব।
-আমার মা আমাদের হানিমুনে যাওয়ার কথা বলতে তুমি তো কলেজের দোহাই দিয়ে কাটিয়ে দিলে, আজ হঠাৎ, এ কথা!
-তোমারও তো শখ আহ্লাদ আছে।
–ষহা হা হা মরে যাই, যাও স্নান করে নাও, কলেজ যাবে।
শ্রীতমা ব্যালকনি থেকে ঘরে চলে গেল,
অতনু বৃষ্টির ফোঁটা হাতে নিয়ে নিজের মুখে চোখে দিচ্ছে।
বৃষ্টি পড়লেই মা আমাকে স্কুলে যেতে দিত না, সর্দিকাশি পাছে হয়, এখন কি বৃষ্টি কি ঝড়, মা ছাড়া সবই কেমন যেমন বেমানান, আচ্ছা, একটু পড়ে গেলেই কি কেউ মারা যায়, কত লোকে তো দিনরাত পড়ে কেউ তো মারা যায় না, আমার মা’ই কেন মরলো, বিশু’র মা কেন মরলো না, খাট থেকে পড়ে গেল।
শ্রীতমা ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করতেই অতনু বাথরুমে ঢুকে গেল।
আকাশের মুখ ভার আজ। কালো মেঘে আকাশ ছেয়েছে, বৃষ্টির নাম গন্ধ নেই,
বৈশাখের পনেরো তারিখ এলেই অতনুর বাবা শিবপ্রসাদ বাবু কেমন যেন হয়ে যান। আজ পনেরোই বৈশাখ, শিবপ্রসাদ অতনুর মা’কে বিবাহ করে “ভালবাসার নীড়ে” উঠেছিলেন সেই একত্রিশ বছর আগে।আসল কথা হল আজ শিবপ্রসাদ বাবু ও সরমা দেবীর বিবাহবার্ষিকী। সরমা দেবীকে দেওয়া কথা রাখতে শিবপ্রসাদ বাবু হালেহাল হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ছেলেকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি তার মনের কষ্ট। শ্রীতমা তো মজার ছলে গতকাল শ্বশুর মশাইকে বলেই দিল, “বাবা, মা মারা গেছে সতেরো বছর হলো এখনও বিবাহবার্ষিকী পালন করবে, লোকজন যে যাচ্ছেতাই করে বলে তোমার সম্বন্ধে। ছেলের বিবাহবার্ষিকী পালন হবে, মৃত মায়ের কি বিবাহবার্ষিকী পালন হয়।পারেোও বটে বাবা তুমি।”
শিবপ্রসাদ বাবু খবরের কাগজে মুখ রেখে বললেন, বৌমা তুমি এসবের মানে বুঝবে না।আমার ভালবাসার নীড়ে ভালবাসার মানুষটা আজও আছে কিন্তু, ভালবাসার নীড়টা মাথা তুলে তাই আজও দাড়িয়ে আছে। যেদিন তোমার স্বামীকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবে সেদিন লোকজনদের তুচ্ছ কথা তোমার কানে ঢুকবে না। ঠিক যেমন আমার ঢোকে না।
আমি যখন তোমার শাশুড়ি মা’কে বিবাহ করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম তখন সরমা সতেরো বছরের। নিজের হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল ভালোবাসার নীড়কে, আজও সে আছে আমার মনে, আমার শয়নে স্বপনে।
শ্রীতমা ঠোঁট বেকিয়ে বলে, লোক হাসানো একেবারেই আমার ভালো লাগে না, যাক গে সে কথা, বাবা তুমি বাড়িতে থাকবে আজ, আমি বেরোবো।
শিবপ্রসাদ বাবু্ কিছু বলার আগেই তমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
অতনু অনেক রাতে বাড়ি ফিরে দেখল শ্রীতমা বাড়িতে নেই।
অতনু বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে টিভি চালিয়ে টিভি দেখতে লাগলো। ঘন্টা খানেক পর শিবপ্রসাদ বাবু বাড়ি ফিরলেন।
অতনু ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে?”
-বন্ধুর বাড়ি গেছিলাম। ডিনার করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। তুই কিছু খেয়েছিস। বৌমা ফিরল নাকি?
-তমা এখনও ফেরে নি। বাবা তোমার গা থেকে কেমন গন্ধ বেরোচ্ছে। আমার কাছে দাঁড়িয়ে থেকো না।
শিবপ্রসাদ বাবু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, কি জবাব দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ইনিয়ে বিনিয়ে যা হোক করে বললেন এখনও তোর গন্ধ শোঁকার হ্যাবিটটা গেল না। আর কতদিন তোর এই ছেলেমানুষি চলবে। আমি কি রেস্তারাঁ বা বারে গেছি যে আমার গা থেকে মদের গন্ধ পাচ্ছিস। গন্ধ গন্ধ আর ভালো লাগে না। একাকিত্ব আমাকে শেষ করে দিল।
অতনু টিভির ভলিউম কম করে দিয়ে বলল, মা মারা গেছে সতেরো বছর হল, আমাকে হোস্টেলে রেখে এলে।
আমি বাড়ি এলাম একবছর হল। আমাকে জোর করে বিয়ে দিলে, আমার উৎপাত তুমি সহ্য করলে কবে বাবা? একমাত্র ছেলেকে নিজের কাছে রাখলে না। একাকিত্ব তোমার লাগবেই তো বাবা। মা মরার সাথে সাথেই ছেলেকে পর করে দিলে। তোমার জামা, মা’র শাড়ির গন্ধ শুঁকে শুঁকে আমি বড় হয়েছি। সতেরো বছর, ভাবো,
শিবপ্রসাদ বাবু ছেলের কথা শুনে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
শ্রীতমা বাড়ি ফিরল রাত বারোটায়,
শিবপ্রসাদ বাবু বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন। একমাত্র সন্তানকে ভালো রাখতে গিয়ে বিশাল বড় ভুল করে ফেলেছেন তিনি।অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন তিনি প্রতিদিন, প্রতি রাত।
শ্রীতমাকে আসতে দেখেই অতনু ডিনার না করে শোওয়ার ঘরে চলে গেল। শ্রীতমা চেঞ্জ করে নাইট ড্রেস পড়ে অতনুর সামনে এসে দাঁড়াতেই অতনুর তমার ওপর রাগ ঘেন্না এক নিমেষে বিছানার চাদরে মিশে গেল।
শিবপ্রসাদ বাবু ছেলেকে জলে ফেলেছেন মনে করে বিছানা থেকে উঠে সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। রাত নিঝুম চাঁদের আলো জ্যোৎস্নার সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলা খেলছে। এই খেলা খালি চোখে দেখা যায় না। প্রেমে আষ্টেপিষ্টে যদি কেউ বাঁধা পড়ে তবেই এই খেলা সে দেখতে পাবে।শরীর শরীরকে ছুঁতে পেলেই প্রেম। সেটা তো আসল প্রেম নয়। শরীর থাকবে এক দিকে আর প্রিয়জনের ভাবনায় রাত জাগবে দুজন ভালবাসার মানুষ দুই দিকে।
তমা বিছানায় শুয়ে অতনুকে বুঝাচ্ছে, মা বাবা কারোর সারাজীবন বেঁচে থাকে না ।মেনে নাও।আমাদের বিয়ে একবছর হতে চলল। এবার আমরা ভাববো অন্য কিছু, নতুন কেউ আসবে। ঘরময় ছুটে বেড়াবে।খেলবে তোমাকে জ্বালাবে। অতনু তমাকে জাপটে ধরলো। তমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তমা অতনুর হাত ছিটকে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। অতনুও লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলো, তমা অতনুর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। অতনু যেন হিংস্র পশু হয়ে উঠেছে। তমাকে ছিঁড়ে খাবে এখুনি।
-ছেড়ে দাও অতনু।
-তোমাকে ছেড়ে দেব। তাহলে আমাকে কে জ্বালাবে?
-ছাড়ো বলছি।
-তোমাকে ছিঁড়ে খাব।
-আমি তোমার কাছে থাকবো না। ডিভোর্স দেবো তোমাকে। ইতর লোক। কলেজের চাকরিটা তোমার থাকবে না।
-না থাকুক
তমা অতনুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। অতনুর পৈশাচিক আচরণে তমার চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে তমার চোখ খুলল। বিবস্ত্র তমা অতনুর মুখে থুথু ছিটিয়ে নাইটি পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শিবপ্রসাদ বাবু ছাদে পায়চারি করেন রোজ ভোরবেলা। আজ ওনার বিবাহবার্ষিকী তাই ছাদে যাননি। সরমার ছবিতে মালা ফুল চন্দন দিয়ে সাজাচ্ছেন। খুব সকালে স্নান সেরে নিয়েছেন উনি।
তমা ব্যালকনিতে বসে আছে। শিবপ্রসাদ বাবু অনেকক্ষণ পর লক্ষ্য করলেন, তমা মনমরা হয়ে বসে আছে।
-বৌমা কি হল, সকালের শুভেচ্ছা জানালে না তো?
তমা গম্ভীর ভাবে বলল, শুভ সকাল বাবা।
শিবপ্রসাদ বাবু তমার কাছে এসে বললেন, গলাটা ভারি কেন তোমার, আর তোমার চেহারার এ কি অবস্থা হয়েছে!
তমা কান্নায় ভেঙে পড়লো, বাবা তোমার ছেলে পিশাচ হয়ে গেছে, আমি এখানে থাকবো না। আমি নর্দমার কীটের সঙ্গে থাকতে পারবো না।
-বৌমা চুপ করো। কোথায় সে?
-ঘরে
-আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে, দুপুরে খাবে। তোমাকে বলা হয়নি তুমি অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছো। যাও ফ্রেশ হয়ে নাও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এসব হয়েই থাকে।
-বাবা তুমি বলছো!
-হ্যাঁ, তুমি রাত করে বাড়ি ফিরো না আর। অতনুকে বোঝার চেষ্টা করো, কাল পানের জন্য রাত এগারোটায় পানের দোকানে যেতে চাইছিল অতনু। তুমি বাড়ি থাকলে তুমি বাধা দিতে। আমার কথা এখন কী ও শুনবে।
তমা চোখের জল মুছে বলল,পান খেয়েছে!
-আমি তো ঘরে চলে গেলাম জানি না
-পান খেতে আমি বারণ করেছি।
-তুমি সময় দাও ওকে, তাহলে আর সমস্যা থাকবে না। যাও ঘরে যাও
অতনু ঘুমের ঘোরে তমা তমা আমাকে জড়িয়ে ধরো আমি পড়ে যাচ্ছি, তমা দশতলা থেকে পড়ে যাচ্ছি ধরো ধরো,,,
তমা ঘরে ঢুকে অতনুর চোখে মুখে জল ছিটালো। অতনু চোখ খুলে তমাকে দেখলো।
তমা, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় গেছিলে? আমাকে কে যেন ছাদ থেকে ফেলে দিচ্ছিল
তমা মুখ ঘুরিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল।অতনু বাথরুম থেকে বেরিয়ে বৈঠকখানা ঘরে এল। ওর মা’র ছবি ফুলমালা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো আছে। অতনু মা’র ছবি হাতে নিয়ে হাসছে।
তমা শিবপ্রসাদ বাবু অবাক হয়ে গেল অতনুর হাসি দেখে।
অতনু ফটোটার গন্ধ শুকলো, তারপর ফটোটা সারা শরীরে আলতো করো বোলাচ্ছে। তমা আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে ব্যালকনিতে চলে এল। শিবপ্রসাদ বাবু অতনুর কাছে আসতেই অতনু ফটোটা টেবিলে রেখে চোখ মুখ চুলচকিয়ে বলল, বাবা তোমার গা দিয়ে কাল রাতে কিসের গন্ধ বের হচ্ছিল?
শিবপ্রসাদ বাবু ছেলের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেন। তমা চায়ের ট্রে নিয়ে বলল, বাবা তোমার জামাতে কাল আমি পারফিউম স্প্রে করে দিয়ে ছিলাম। কী মিষ্টি গন্ধ।
অতনু চিৎকার করে উঠলো, বাজে গন্ধ আই হেট দিস স্মেল।
শিবপ্রসাদ বাবু অতনুকে বললেন, ঠিক আছে যাও স্নান সেরে এসো, লোকজন আসবে। বেশি কথা বলবে না। যাও, আর একটা কথা শিশিরের পানের দোকান থেকে যদি আর একটাও পান খেয়েছো তমাকে আমি ওর মা’র কাছে রেখে আসবো।
অতনু মাথা চুলকিয়ে বললো, না বাবা আমি আর খাব না। খুব কষ্ট হয় পান খেলে। তমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শিবপ্রসাদ বাবু মৃদু হেসে মনে মনে বললেন, প্রেম করেছো দুজনে আমি শুধু বিয়ে দিলাম, দোষটা আমার হলো।
শিবপ্রসাদ বাবু তিন দিন হল বাড়ি ফেরেন নি। তমার শরীর খারাপ। অতনু কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে ডাক্তার ডাকতে গেল, কিছুক্ষণ পর অতনু ডাক্তার বাবুকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরলো।
ডাক্তার তমাকে দেখে বললেন, তমা মা হতে চলেছে।
অতনুর মুখ ভরা হাসি।
তমা মা হবে, অতনু নিজের মা’কে চোখের সামনে বারবার দেখছে, মা রান্নাঘরে কাজ করছে।
-আমায় ছুঁতে পারে না, ধরো ধরো
-দুরন্তপনার শেষ নেই।
-একটু আদর করো মা।
-বড় হচ্ছো, লেখাপড়ায় মন দাও
-আমি তোমায় ভালবাসি, আর কাউকে না
পড়াশোনাকেও না!
-ওরে পাজি ছেলে
-এই আমি শুলাম মা, ডাকবে না কিন্তু।
-অতনু স্নান সেরে নে, স্কুলে যাবি না, পায়েস দেবো টিফিনে।
-পায়েস টিফিনে দিও না মা, বাড়ি এসে আয়েস করে বসে খাবো পায়েস, পুরো এক
জামবাটি
-হা হা এক জামবাটি, পারবি তো খেতে, না খেতে পারলে কান মোলা খেতে হবে।
-তাই খাবো মা
তমা বিরক্ত হয়ে বলল, “তাই খাবো মা মানে” তুমি কি মা’র সাথে কথা বলছিলে?
আমাদের প্রথম সন্তান আসছে। তোমার কোনো ফিলিংস নেই।
অতনু একদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, বাবার কোন খবর পেলাম না। খুশির খবরটা বাবা পাবে তো।
তমা বিছানা থেকে ধীরে ধীরে উঠে বলল, বাবার জন্য আমারও চিন্তা হচ্ছে, দেখো তো বেল বাজছে, এতো রাতে কে এল আবার!
অতনু তমার গালে হাত বুলিয়ে দরজা খুলতে গেল।
-বাবা তুমি কোথায় ছিলে, কত চিন্তা করছি তোমার জন্য, ইস সেই পঁচা গন্ধ তোমার জামা থেকে বের হচ্ছে। কোথায় যাও আর এই গন্ধ নিয়ে বাড়ি ফেরো।
তমা চিৎকার করে বলল, কে এল বাবা,
অতনু কোন উত্তর দিল না।
শিবপ্রসাদ বাবু জুতো খুলতে খুলতে বললেন, বৌমা আমি। অতনু জল দিবি এক গ্লাস, পিপাসা পেয়েছে।
অতনু রেগেমেগে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
শিবপ্রসাদ বাবু সোফায় বসে রইলেন। তমা বিছানায় বসে অস্থির হয়ে পড়ছে। কখন শ্বশুর মশাইকে খুশির খবরটা দেবে।
রাত দশটায় শিবপ্রসাদ বাবু ফ্রেশ হয়ে তমার ঘরে গেলেন।
তমা বিছানা থেকে উঠে বসে বললো, বাবা আর চিন্তায় ফেলো না। যেখানে যাবে বলে যেও, তুমি দাদু হচ্ছো।
শিবপ্রসাদ বাবু চমকে উঠলেন! কি বললে বৌমা, তোমার মা’কে খবরটা দিতে হবে, যাই
-কোথায় যাবে? আমার মা না অতনুর মা’র ছবি,কাকে খবরটা দেবে বাবা?
-তোমার শাশুড়ি মা, তমা মুখ বিকৃত করে রইলো।
পরের দিন সকাল বেলায়
শিবপ্রসাদ বাবু খয়েরি রঙের পাঞ্জাবী পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আছড়াচ্ছেন।অতনু ওর বাবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেল,বাবা এতো সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছে। এবার গোয়েন্দা গিরি করতে হবে দেখছি।
-কি রে কী ভাবছিস। ভেতরে আয়, গন্ধ কেমন পাঞ্জাবীটার, বল, আজকে আমি খুব খুশি।
-সে তো বুঝতে পারছি। কিন্তু যাচ্ছো কোথায়?
-অতো জানার দরকার নেই তো তোমার।তমাকে দেখে রাখো, বাবা হচ্ছো গন্ধ গন্ধ করে পাগলামি বন্ধ করো। বিরজুর দোকানে কি হয়েছিল? যাচ্ছেতাই কাণ্ড করলে। সবাই কি তোমার মা, শাড়ির আঁচল টেনে গন্ধ শোঁকো। মানুষের মতো মানুষ দেখতে হয়, অনেককেই পেছন থেকে দেখলে চেনা মনে হয়। তাই বলে সামনের চেহারাটা দেখবে না।
-তুমি রাতে কোথা থেকে আসো বাবা, কী বিচ্ছিরি গন্ধ তোমার জামা থেকে বের হয়
-তুমি তো গন্ধ বিশারদ। কলেজের চাকরি ছেড়ে দাও। গন্ধ নিয়ে গবেষণা করো
-সে তো করবোই বাবা। ।সাবধানে যেও।
আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টির সম্ভাবনা প্রবল। শিবপ্রসাদ বাবু ছাতা না নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন। গন্তব্যে পৌঁছাতে শিবপ্রসাদ বাবু বেশ তাড়াহুড়ো করছেন।প্রথমে অটো ধরবেন তারপর ট্রেন। ট্রেন থেকে নেমে আবার অটো। বৃষ্টির জলে পাঞ্জাবি ভিজলেও শুকিয়ে যাবে। কারণ পাঞ্জাবিটা ফিনফিনে।
শিবপ্রসাদ বাবু অটো থেকে নেমে ট্রেনে উঠলেন। ওনার মনে হচ্ছে কেউ ওনাকে ফলো করছেন।
-ও দাদা ভেতরে ঢোকেন। হিরো হওয়ার শখ যাইনি এখনও, বয়স তো তিন কুড়ি পেরিয়ে গেছে।
শিবপ্রসাদ বাবু বেশ রেগেই বললেন, আমার চার কুড়ি হয়ে গেছে কাকু। আমি যদি হিরো হই তাহলে আপনিও কারণ দুজনেই ঝুলছি
একটা ছোকরা ছেলে হো হো করে হেসে বললো, কি দিলেন কাকু, কোথায় নামবেন কাকু?
শিবপ্রসাদ বাবু আমতা আমতা করে বললেন- ক্যানিং
-ভালো, ভেতরে ঢুকে যান, বসার জায়গা আছে। চাইলে ঘুমাতেও পারেন। আমি ডেকে দেব আপনাকে, যান ভেতরে যান। বেকার গুঁতোগুতি করে কী লাভ।
-তার মানে এই ছেলেটি আমাকে ফলো করছে, অতনুর কাজ এটা। বেশ কয়েক দিন ধরে ও আমাকে সন্দেহ করছে। আমিও সাত সেয়ানার এক সেয়ানা। ক্যানিং-এ নামবো না। আগের স্টেশনে নেমে অটো করে যাব।
-কী ভাবছেন কাকু? যান ভেতরে।
-হ্যাঁ যাই
শিবপ্রসাদ বাবু জানলার ধারে বসার জায়গা পেলেন, বসলেন। শিবপ্রসাদ বাবু মনে মনে বলছেন, একি সবাই আমাকে দেখছে কেন। বেশি ঝলমলে হয়ে গেল না কি পাঞ্জাবিটা।শিবপ্রসাদ বাবু অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন।
বছর পঞ্চাশের এক মহিলা তো চোখ সরাচ্ছেনই না শিবপ্রসাদ বাবুর দিক থেকে।কিছুক্ষণ পর ঐ মহিলা শিবপ্রসাদ বাবুকে বললেন আপনি শিবুদা, যদি কোন ভুল না হয় আমার তাহলে আপনি আমাদের শিবুদা।
শিবপ্রসাদ বাবু বিড়বিড় করে বললেন আমাদের শিবুদা মানে কতজনের রে বাবা।চুলটা হাত দিয়ে সেট করে শিবপ্রসাদ বাবু বললেন আপনি কে? আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো।
-তার মানে আপনি শিবপ্রসাদ…
-হ্যাঁ
-সরমাদি এখন কেমন আছে? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে? একবার যদি দেখতে পাই…
-ও তো নেই!
-কোথায় গেছে?
-কুষ্ঠ রোগে মারা গেছে। সতেরো বছর আগে। আপনি কে? আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো!
-মৌমিতা দত্ত,চিনতে পারলেন নিশ্চয়ই
-মৌমিতা! এখানে এসে বসো, তোমাকে চিনতে পারিনি। কালো চুলগুলো লাল হয়ে গেছে তো। চোখে চশমা।
মৌমিতা শিবপ্রসাদ বাবুর পাশে বসলেন। ট্রেন চলছে তার গতিতে।
মৌমিতা শিবপ্রসাদ বাবুর হাত ধরে বসে অনেক কথাই বলছেন।
অতনু কেমন আছে শিবুদা? বিয়ে করলো না কি গন্ধ নিয়ে রিসার্চ করছে?
-মানে?
-রেগে যাচ্ছো কেন শিবুদা। অতনুর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল এক বছর আগে তখনও ও ব্যাচেলার ছিল। হোস্টেলে দেখা হয়েছিল। আমার শাড়ির আঁচলের গন্ধ শুঁকছিল অনেক ক্ষণ ধরে, ঐ কথাবার্তা হলো।
শিবপ্রসাদ বাবু ঢোক গিলে বললেন, অতনু তোমার ঠিকানা জানে?
-হ্যাঁ, বলেছি তো। তুমি ক্যানিং যাচ্ছো তো শিবুদা
-তুমি কি করে জানলে?
-যেই ছেলেটাকে বললে ক্যানিং যাবে, ও আমার ছেলে। আমরাও যাচ্ছি ক্যানিং। ভালোই হলো একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।
-ও আচ্ছা। ভালো ভালো…
-সরমা দি’র চলে যাওয়া মন থেকে মেনে নিতে পারছি না, সতেরো বছর আগে, কী সব দিন ছিল।
-জন্ম হয়েছে মৃত্যুর জন্য, আমি তো মেনে নিয়েছি।
শিবপ্রসাদ বাবু উঠে দাঁড়াতেই মৌমিতা বললো, এর পরেরটা ক্যানিং শিবুদা, বসো বসো একসঙ্গে যাব তো।
শিবপ্রসাদ বাবু বিড়বিড় করে বললেন, কিছু একটা ভাবতে হবে।
ক্যানিং স্টেশনে নেমে শিবপ্রসাদ বাবু বললেন, মৌমিতা তোমরা এগোও, আমি আসছি।
মৌমিতা হেসে বলল, একদিন যেও শিবুদা আমার ফ্লাটে, অতনু ঠিকানা জানে।
-হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাব।
মৌমিতা চলে গেলে লম্বা শ্বাস ফেলে শিবপ্রসাদ বাবু অটোতে বসলেন।
যা ভাবা হলো তাই। ঝমঝম করে আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অটো বেশ তাড়াতাড়ি চলছে। আধ ঘন্টার মধ্যে শিবপ্রসাদ বাবু গন্তব্যে চলে এলেন।
-ভিজে গেছো তো!
-হ্যাঁ, ঐ আর কি…
-ছাতা নিতে কি অসুবিধা হয় তোমার বুঝি না বাপু
-আজকাল সবাই আমাকে সন্দেহ করে বুঝলে।
-ভগবানকে কেউ সন্দেহ করে বুঝি?
-ভগবান কেন, কর্তব্য পালন করছি, আর করবোও
-তুমি আর ছোট হয়ো না কারোর কাছে, আমি তো মানুষ বুকটা আমার দগ্ধে দগ্ধে শেষ হয়ে গেল।
অতনু তোমায় খুব ভালোবাসে তাই না! বাবা ছেলের ভালোবাসা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
-তুমি উত্তেজিত হয়ো না, ক’টা রইলো আর।
-তিনটে,
-খুব গন্ধ ছড়াচ্ছে তো, সে আসেনি এখনও?
-বৃষ্টি পড়ছে তো তাই আসেনি হয়তো, আসবে ঠিকই।
-আজ একটা সুখবর দেবো। তবে লক্ষ্মী মেয়ের মতো খাবারটা খেয়ে নাও।
-বলো না, কি সুখবর আমি উতলা হয়ে আছি বলো না,
-অতনু বাবা হতে চলেছে, তুমি ঠাকুমা আমি দাদু
-ও ভগবান! এতো সুখ দেবে বলে তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছো, অতনুর ছবিটা বুকে জড়িয়ে রাখি, একবার ছেলের গালে চুমু খাবো, একবার অতনুকে দেখবো,
-সরমা উত্তেজিত হওয়া ভালো না।
-আমি যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছি, আর না এবার আমাকে মরতে দাও। মরার আগে একবার ছেলেকে দেখতে চাই, ওকে স্পর্শ করবো।
-তুমি বাঁচবে আমার জন্য, সারা দুনিয়া একদিকে তোমার আমার ভালোবাসা একদিকে।
-পঁচা গন্ধ গায়ে মেখে যখন বাড়ি যাও ছেলে কিছু বলে না?
-বলে তো, ছেলে বলে কোথায় যাও রোজ রোজ দু তিন ধরে বাড়ি ফেরো না।
-মা মা করেই পাগল ছেলে আমার, ও যদি জানতে পারে আমি বেঁচে আছি। পঁচা গন্ধ গায়ে মেখে এখনও বেঁচে আছি।
-কোনোদিন অতনু জানবে না ওর মা বেঁচে আছে। তুমি মরলেও ও জানবে না। ও এই গন্ধ সহ্য করতে পারবে না। পাগল হয়ে যাবে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
-কুষ্ঠ রোগী হয়ে তোমার সরমা আর কতো বছর বাঁচবে বলতে পারো। কুড়িটা আঙ্গুলের মধ্যে তিনটি আঙুল আছে, দু’ এক দিনে তাও খসে পড়বে।
-আহ্ সরমা, আর বলো না আমি সহ্য করতে পারছি না। তিলতিল করে আমরা দুজনে মরছি। অতনুকে বলেছিলাম তোর মা মারা গেছে, ছোট ছিল তাই কোন প্রশ্ন করেনি।বড়বেলায় বললে হাজারটা প্রশ্ন করতো।হয়তো তোমার মৃতদেহ দেখতে চাইতো
–তুমি ঠিক কাজ করেছো। আমার শরীরের এই দুর্গন্ধ ও সইতে পারতো না। ঘেন্না করতো আমাকে। আমার শাড়ির আঁচল, কোথায় আমার শাড়ির আঁচল কোথায়?
-সরমা শান্ত হও, তোমার শাড়ি পড়া মানা।তুমি সুস্থ হবেই।
-আমি তো সুস্থ,শুধু শরীরে পঁচা গন্ধ আর হাতে পায়ের আঙুল নেই। তুমি আমাকে এখনও ভালবাসো। দেখোতে একটা ছায়া মতো দেখলাম, কেউ তো আসার নেই। তবে কি যমদূত এল আমাকে নিতে?
শিবপ্রসাদ বাবু দরজার সামনে এসে সবদিক দেখে বললেন, মনে হয় পর্দাটা উড়ছে তুমি ভয় পেও না অতনু এখন কলেজে আছে।
সরমা আমি অতনুর সন্তানের ছবি তুলে তোমাকে দেখাবো।
-বৌমা ভালো আছে তো, পেটটা বড় হয়েছে
-দুর পাগলী, আমি বৌমার পেটের দিকে তাকাই না কি?
-তুমি তো বাবা তোমার আবার লজ্জা কিসের। ঐ দেখো আবার দেখলাম, কে যেন লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছে।
-ভ্রম হচ্ছে তোমার, এই বাড়িতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই।
-কেন জানি মনে হচ্ছে… অতনু এসেছে। ছেলেকে একবার দেখিয়ে দাও, কত যুগ হয়ে গেল ছেলেকে দেখিনি, কেমন গড়ন হলো খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, ছবিতে আর কত আসে।
-ছেলে তোমাকে দেখে যদি তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকতে যায়, তখন কি হবে, গ্রিলের গরাদের ভেতর তুমি থাকো, দুর থেকে আমি তোমাকে দেখি, তোমার সাথে কথা বলি, বাড়ি গেলে ও আমার জামার গন্ধ পেয়ে ওয়াক তোলে, সামনাসামনি দেখলে ও সহ্য করতে পারবে কি?
-হসপিটালেই ভালো ছিলাম, কেন যে এই ব্যাবস্থা করলে, নিজেও তো ওয়াক তোলো, যাও বাড়ি যাও বৌমা একা আছে। ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে সাবধানে যেও।
শিবপ্রসাদ বাবু সরমাকে খাবার দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তখন আয়া এলো, শিবপ্রসাদ বাবু আয়াকে সব কিছু বলে অটো ধরে স্টেশনে যাবেন, তখনও বৃষ্টি পড়ছে, সামান্য ঝড় হচ্ছে।
আয়া সরমা দেবীকে বলল, একটা ছেলে রান্না ঘরে বসে কাঁদছে, তোমার স্বামী তো চলে গেল, ছেলেটিকে নিয়ে গেল না কেন?
সরমা দেবী অবাক হয়ে বললেন, ছেলে!
-হ্যাঁ গো, রান্নাঘরে বসে কাঁদছে।
-নিয়ে আয় তো।
আয়া রান্না ঘরে গিয়ে ছেলেটিকে বলল, ভেতরে যে অসুস্থ মহিলা আছেন তোমাকে ডাকছে, চলো।
-গন্ধ চারদিকে মায়ের আঁচলের গন্ধ, মা’র গায়ের গন্ধ- রসগোল্লা হা হা হা
-এই ছেলে চলো।
আয়া টানতে টানতে নিয়ে যাবে ছেলেটাকে
সরমা ছেলেটাকে দেখে চমকে উঠলেন-অতনু! আমার ছেলে, চলে যা বাবা চলে যা।
আয়া বলল, কি বলছো, এই ছেলে তোমার! নাম অতনু ?
অতনু হা হা করে হেসে বলল, আমার মা’র গা দিয়ে রসগোল্লার গন্ধ বের হয়, এখানে পঁচা গন্ধ, ঐ মহিলার গা দিয়ে পঁচা গন্ধ বের হচ্ছে।
আয়া সরমার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো সরমা আর নেই।
এর মধ্যে শিবপ্রসাদ বাবু অটো থেকে নেমে সরমা সরমা বলতে বলতে ঘরের ভেতর ঢুকে অতনুকে দেখে চমকে গেলেন,
অতনু এখানে তার মানে সরমা ঠিক বলেছে,
শিবপ্রসাদ বাবু অতনুর হাত ধরে বললেন, এখানে কেন এসেছিস বল, আমাকে সন্দেহ করিস না? এই দেখ তোর মা, তোর মা’র কাছে আমি আসি, মদ খাইনা বুঝলি, তোর মা’র শরীর দিয়ে পঁচা গন্ধ বের হয়, জানতে চাইতিস না, আমার জামা দিয়ে, গা দিয়ে কিসের গন্ধ বের হয়, দেখ ভালো করে, যা মা’র কাছে যা, মায়ের গায়ের গন্ধ শোঁক।
আয়া মাথা নিচু করে বলল, উনি আর নেই, আপনাকে কে খবর দিল?
শিবপ্রসাদ বাবু আঁতকে উঠে বললেন,
আমি তো সরমার মলমটা দিতে ভুলে গেছিলাম, অটো ভাড়া দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিতেই মলমটা দেখলাম, তাই দিতে এলাম মলমটা।
আয়া শিবপ্রসাদ বাবুকে বললেন, আপনার স্ত্রী নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেন। আর দেরি না করে সৎকারের ব্যবস্থা করুন, হসপিটালের ডাক্তার দেখিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে নিন, পোকা ভিনভিন করবে, শরীরের অর্ধেক তো পচেই গেছে
শিবপ্রসাদ বাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ খুব তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে।
অতনু মা’কে দেখে নে শেষবারের মতো, তোকে মিথ্যা বলেছি পারলে ক্ষমা করে দিস, তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই অন্যায় কাজ আমি করেছি।
অতনু নিজের মনে বলেই চলেছে- আমার মা’র গায়ের গন্ধ কী মিষ্টি, আমার মা’র শাড়ির আঁচলটা কেউ দাও না,কতদিন মা’র শাড়ির আঁচলের গন্ধ শুঁকি নি।
শিবপ্রসাদ বাবু সরমা দেবীর মৃতদেহ সৎকারের জন্য শশ্মানে নিয়ে গেলেন, অতনু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মৃতদেহের দিকে।
অতনু মৃতদেহে জড়ানো শাড়ির আঁচল ধরে বলছে,পঁচা গন্ধ, ইস্ কী পঁচা গন্ধ…
চিতায় তোলা হল সরমা দেবীকে,
চিতায় পুড়ছে অতনুর মা, শিবপ্রসাদ বাবু জ্বলন্ত চিতার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
অতনু চিৎকার করে বলছে, কি মিষ্টি গন্ধ রসগোল্লার গন্ধ কোথায় আমার মা, মা, মা সেই চেনা গন্ধ।
আগুনের লেলিহান শিখা গোল হতে হতে আকাশ ছুচ্ছে,অতনু হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে।
কী মিষ্টি গন্ধ, আকাশে বাতাসে আহা্ কী মিষ্টি গন্ধ…
সমাপ্ত