গল্প- নিষ্পত্তি

নিষ্পত্তি
লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

-চলো না আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি।
-পালাবো কেন? আমরা কি অন্যায় করেছি যে পালিয়ে বিয়ে করতে হবে?
-দেখছো তো আমাদের দুজনের বাড়ি থেকেই তো মেনে নিতে চাইছে না আমাদের সম্পর্কটা।
-তার জন্য পালাতে হবে! কোনো দিন এমন ভাবনা মাথাতেও এনো না।

স্নিগ্ধ তৃণার হাতটা নিজের মুঠির মধ্যে নিয়ে করুণ সুরে বলে, তাহলে কি আমাদের বিয়ে হবে না কোনোদিন?

স্নিগ্ধ’র চোখে তৃণা সেদিন দেখেছিল অসম্ভব রকমের অসহায়ত্ব। চোখের ভাষা পড়তে পারা মোটেই সহজ কাজ নয়। তবে দীর্ঘ সাতটা বছর তৃণা স্নিগ্ধর চোখে চোখ রেখে বুঝতে পেরেছে স্নিগ্ধর মনটা বড্ড নরম। একটুতেই ভেঙে পড়ে।
তৃণা স্নিগ্ধর কাঁধে মাথা রেখে সেদিন বলেছিল, জানি না গো। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে যে ভাবে নিত্য অশান্তি লেগে থাকে। তাতে আমাদের বিয়ে হওয়া সত্যি চাপের।
স্নিগ্ধ তৃণার হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরে বলে, যদি তোমার বাড়ির লোক জোর করে তোমার বিয়ে দিয়ে দেয় অন্য কারোর সঙ্গে?
+আমি কি ছোট বাচ্চা? যে জোর করলেই আমি ভয়ে ভয়ে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়বো!
স্নিগ্ধ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, তৃণা তোমায় ছাড়া আমি কিন্তু বাঁচব না।
তৃণার চোখটাও জলে ভরে ওঠে। কন্ঠ নালী আর্দ্র হয়ে ওঠে। তবুও নিজেকে খানিক সংযত রেখে বলে, একটা কথা তোমাকেও দিতে হবে আজ আমাকে।
-বল কি কথা?
-যতদিন না আমাদের দুই পরিবার রাজি হয় আমাদের বিয়েতে ততদিন কিন্তু আমরা এই রকমই থাকবো। দুজন দুজনের জন্য অপেক্ষা করবো। তুমি কিন্তু মোটেই আমাকে জোর করবে না বিয়ের জন্য।
এবার স্নিগ্ধ খানিক রেগে উঠে বলে, দুই বাড়ির লোক যদি কোনদিন রাজি না হয় তাহলে কি আমরা এইরকম ভাবে দুজন দুজনের শুধু মুখ দেখে জীবন কাটিয়ে দেবো?
-পারবে না তুমি?
-অ্যাই শোনো ষাটের দশকে এই রকম ‘প্লেটোনিক লাভের’ কথা মানুষ ভাবতো। এই একুশ শতকে নয়। এই সাত বছরে আমাকে একটুও কাছে আসতে তুমি দাও নি। একটু চুমু খেতে চাইলেই হাজার নাটক শুরু করে দাও।
বলি আমি কি পাথর! আরে বাবা আমি তো মানুষ। আমার মনেও কামনা বাসনা আছে।যাকে এত বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবেসে আসছি তাকে একটু আদর করতে পারবো না!
তৃণা বেশ বুঝতে পারে তার পাগল প্রেমিক ক্ষেপেছে। তাই স্নিগ্ধকে শান্ত করার জন্য সে বলে, আমি চাই আমাদের প্রথম চুম্বন হবে জাগতিক সব ভালোলাগার উর্ধ্বে। আমাদের প্রথম চুম্বনের রেশ থেকে যাবে আত্মায়। আমাদের প্রথম চুম্বন হবে ঠিক শুষ্ক ধরিত্রীর বুকে বর্ষার অবিরাম বারিধারা।
স্নিগ্ধ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, অনেক হয়েছে তোমার কাব্য। চলো এবার উঠি। আমার মা যদি সামান্যতম টের পায় তাহলেই শুরু হয়ে যাবে অশান্তি।
তৃণা খানিক দুঃখ প্রকাশ করে বলে, আগে মানে আমাদের ছোটোবেলায় কিন্তু আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। আম গাছটা বড় হতেই অশান্তি শুরু হলো।
স্নিগ্ধ বলে, তোমাদের আম গাছের শুকনো পাতায় আমাদের ছাদ ভরে যায়। আর সেই কারণেই প্রতিদিন মাকে ছাদে ঝাড়ু দিতে হয়। সংসারের হাজার কাজের মধ্যে রোজ ছাদ ঝাড়ু দেওয়া একটা বাড়তি কাজ। তাই নিয়ে মা রাগে গজগজ করে।
তৃণা বলে, তোমাদের ছাদে বুঝি আমাদের আম গাছের শুকনো পাতা পড়ে কেবল? একটু সামান্য ঝড় উঠলেই যে আম পড়ে তোমাদের ছাদে। তার বেলায়?
কই আমার মা তখন তো আমগুলো তোমার মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসে না।
স্নিগ্ধ বলে, আমার মা তো বলে, সারা বছর আম পাতা ঝাঁট দেবো আর দুচারটে আম না বলে কুড়িয়ে নিলে অসুবিধার কিছু নেই।
তৃণা হাসতে হাসতে বলে, সত্যিই তো অসুবিধার কারণ হওয়া উচিত নয়। আজ বাদে কাল যখন আমি তোমার বউ হবো তখন তো আমার বাপের বাড়ির আম, কাঁঠাল, জাম, পেয়ারা, বেল, কুল সবই তো তোমাদের বাড়িতে যাবে। না হয় দু’চার দিন আগে থেকেই তোমার মা ওইসব খাচ্ছেন।
স্নিগ্ধ আর কথা না বাড়িয়ে সটান দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল তৃণার দিকে। তৃণা স্নিগ্ধর হাতটাতে ভর দিয়ে পার্কের সবুজ ঘাসের ওপর থেকে উঠে পড়ল। তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করেই পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো।
অটোতে বসেই তৃণা বলে, আজ যা যাচ্ছেতাই রকমের গরম। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে এক দুদিনের মধ্যেই।
অটোওয়ালা উপযাচক বলে ওঠে, শুধু বৃষ্টি নয় ম্যাডাম। মনে হচ্ছে ঝড় উঠতেও পারে।বৈশাখ পরে গেছে। এবার তো একটা আধটা কালবৈশাখী হবেই।
অটো থেকে নেমে স্নিগ্ধ যায় টিউশন পড়াতে আর তৃণা ফেরে বাড়ি। তৃণা বাড়িতে ফেরা মাত্রই ওর মা একটা কাপড়ের মাঝারি সাইজের পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে এসে বলে, এই দেখ তোর স্নিগ্ধদার মায়ের কান্ড।
তৃণা খানিক অবাক হয়ে পলিথিনটার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দেখে, প্রচুর শুকনো আম পাতা।
চোখ গুলো কপালে তুলে সে বলে, মা এর মানে?
তৃণার মা আরতি বলে, এত লেখাপড়া শিখেছিস আর এর অর্থ বুঝতে পারলি না। ওরে হাঁদারাম আমাদের গাছের আম পাতা যেগুলো পড়ে ওদের ছাদে। সেগুলো একসাথে জড়ো করে এই পলিথিনটাতে ভরে আমাদেরকেই দিয়ে গেছে। আর বলে গিয়েছে আমাদের বাড়ি থেকে রোজ যেন আমি কাউকে পাঠাই ওদের বাড়িতে। সে গিয়ে ছাদে ঝাড়ু লাগিয়ে আম পাতা সব কুড়িয়ে আনবে।
কি সাংঘাতিক মহিলা তুই একবার ভেবে দেখ তৃণা। তৃণা বলে, সত্যিই তো মারাত্মক ঝগড়ুটে মহিলা। আরে বাবা গাছের পাতাই তো উড়ে পড়ে। এ তো নোংরা কিছু নয়।
তৃণার বাবা অমিত বাবুও বিরক্ত হয়ে বলেন, সেন বৌদি যেন দিনদিন অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে।
আরতি তো রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে বলে, রোজ দিন এত অপমান ভালো লাগে না। তার থেকে তুমি গাছটা কেটে দাও।
অমিত বাবু প্রায় আঁতকে উঠলেন এই কথা শুনে। তুমি জানো এই গাছটা কতদিনের পুরানো। এটা আমার মায়ের হাতে লাগানো গাছ। আর এই গাছের আমগুলো যেন অমৃত। যেমন দেখতে তেমন স্বাদ। এই লক্ষ্মণভোগ আম গাছ কজনের বাড়িতে আছে বলতে পারো?
আরতি বলে, বলি টাকা দিলেই বাজারে এই লক্ষ্মণভোগ পাওয়া যায়। নিজের বাড়িতেই যে রাখতে হবে অশান্তি করেও তার কি মানে আছে!
অমিত বাবু রীতিমতো হাত নেড়ে জানিয়ে দিলেন কোনো মূল্যেই এই গাছ তিনি কাটবেন না। অগত্যা স্নিগ্ধর মায়ের সঙ্গে অশান্তি লেগেই রইল।
দিন তিনেক পরে হঠাৎ বিকালে পশ্চিমের আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করল। প্রথমে গাছের পাতাগুলো ও ভয়ে নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। আস্তে আস্তে কালো মেঘ কুক্ষিগত করে নিল গোটা আকাশকে। দরজা জানালা বন্ধ করতে গিয়ে রীতিমতো কানে আসতে লাগলো হাওয়ায় শোঁ শোঁ শব্দ। তীব্র গতিতে হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে তৃণাদের বাগানের সব গাছ গুলোকে। তবে সবচেয়ে বেশি দুলে দুলে উঠছে আম গাছের ডালপালাগুলো।
হাওয়ার সাথে এবার শুরু হলো শিলা বৃষ্টি। দরজা জানালাতে মনে হচ্ছে কেউ ক্রমাগত করাঘাত করে চলেছে। তৃণা যদিও মাঝে মধ্যেই চেষ্টা করছিল দুচারটে যততত্র পড়ে থাকা বরফ কুচি কুড়িয়ে আনতে। শিলা বৃষ্টি হলে শিল কুড়ানোর মজাই আলাদা। প্রায় কুড়ি মিনিট চললো মেঘ বৃষ্টি আর হাওয়ার লড়াই। বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতেই অমিত বাবু বাগানে এসে দেখে এদিক ওদিকে ভেঙে পড়েছে গাছের ডালপালা। তবে আম গাছটার দশা দেখে উনি প্রায় কেঁদে ফেললেন। চিৎকার করে উঠলেন, তৃণা তোর মাকে নিয়ে বাগানে আয় শিগগির।
মাথায় গামছা দিয়ে হাতে টর্চ নিয়ে ছুটে আসে তৃণা ও তার মা। কি রকম অদ্ভুত ভাবে আম গাছটার গোড়াটা গেছে মুচড়ে। আরতি বলে, হ্যাঁ গো আমি গাছটাকে কেটে দিতে বলেছিলাম বলেই কি গাছটা ঝড়ে এইভাবে ভেঙে গেল।
স্নিগ্ধদের ছাদ থেকে স্নিগ্ধর বাবা রমেন বাবু অমিত বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলে, কালবৈশাখীতে আমাদের জলের ট্যাঙ্কের ঢাকনাটা কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল কে জানে? একটু আপনাদের বাগানে দেখবেন।শিল পড়ে সিঁড়ি ঘরের এ্যাটবেসটারটাও গেছে ফেটে। কি বিপর্যয় বলুন তো মশাই।
তারপরই রমেন বাবু বলেন, একি আপনাদের আম গাছটা ভেঙে গেছে!
আরতি বলে, দাদা গাছেরও তো প্রাণ আছে। দিনরাত দুই পরিবারের মধ্যে ওকে নিয়ে যে অশান্তি হতো। তা ও নিশ্চয় টের পেয়ে ছিল।ভালোই হলো আর অশান্তি হবে না।
স্নিগ্ধর মা বাতাসী মুখ বেঁকিয়ে বলে, যা না আম ধরতো তার থেকে বেশিই পাতা ঝড়তো আমাদের ছাদে। আমি একা মানুষ কত রোজ দিন পাতা পরিষ্কার করি বল তো।
আরতি বলে, গাছটা তো আমার শাশুড়ি মায়ের লাগানো ছিল। মায়া পড়ে গিয়েছিল খুব। তাই কাটতে মন চাইতো না তৃণার বাবার। এই কথা বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে আরতি।
স্নিগ্ধর মা হতবাক হয়ে যায়। মনে মনে বলে, এই আম গাছটার প্রতি এদের এতো মায়া ছিল। আমি তো এই গাছটাকে কেটে দেওয়ার কথা রোজ বলেছি। তখন না জানি ওদের কত কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তৃণার মা কোনো দিন আমাকে তেমন কটূ কথা বলে নি।
ঝড়ের তান্ডবের নিদর্শন চতুর্দিকে। কারেন্ট চলে গেছে অনেক ক্ষণ। ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেদিন আর অন্ধকারে রান্না বান্না না করে দিনের ভাতে জল দিয়ে নিল সঙ্গে পেঁয়াজ পোস্ত আর আলুভাতে নিয়ে স্নিগ্ধ আর রমেন বাবুকে ডাকলো বাতাসী।
খেতে বসে রমেন বাবু বলেন,অমিত বাবুদের আম গাছটা ভেঙে গেল শেষ পর্যন্ত। আমগুলো কিন্তু যেমন দেখতে তেমনই খেতে ছিল।
বাতাসী রমেন বাবুর কথাটা না শোনার ভান করে স্নিগ্ধর উদ্দেশ্যে বলে, হ্যাঁ রে স্নিগ্ধ তৃণার এম এ ফাইনাল পরীক্ষাটা কবে?
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে একটু আমতা আমতা করে বলে, কেন মা হঠাৎ তৃণার পড়াশোনা কথা জিজ্ঞেস করছো?
বাতাসী রসিকতা করে বলে, কি ভাবছিস মা বুঝি কিছুই টের পায় না?
লজ্জায় স্নিগ্ধ একেবারে লাল হয়ে উঠলো। তারপর বলে, মা তুমি তাহলে সব জানো?
-ওরে আমি তোর মা হই। ছেলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে আর মা টের পাবে না। তা কি হয়! আগামী বুধবার তোর বাবাকে নিয়ে তৃণাদের বাড়ি যাবো। আশা করি মেয়ের বিয়ের খবরে আম গাছটার শোক খানিক তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে তৃণার মা ও বাবা।

Loading

2 thoughts on “গল্প- নিষ্পত্তি

Leave A Comment