কবি জীবনানন্দ দাশ, সাহিত্যের আঙিনায়
আমি যেভাবে তাঁকে পেয়েছি
-সুনির্মল বসু
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল,
নাটোরের বনলতা সেন।
তিনি বলেছিলেন, সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।
১৮৯৯ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম, পূর্ববাংলার বরিশাল জেলায়।
পিতা সর্বানন্দ দাশগুপ্ত এবং জননী মহিলা কবি কুসুমকুমারী দাশ। কুসুমকুমারী দাশ কবি হিসেবে তাঁর সমকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি কবিতা লিখেছিলেন,
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি জীবনানন্দ দাশ। শৈশবে পড়াশোনা করেছেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স নিয়ে বি.এ পাস করেন। এবং পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাস করেন।
চাকরি জীবনে বিভিন্ন পেশায় কাজ করেছেন। দুই বাংলার বিভিন্ন কলেজে স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু কোথাও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, ঝরা পালক। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, বনলতা সেন। এই গ্রন্থটি সিগনেট প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। গ্রন্থটির প্রচ্ছদপট এঁকেছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। বনলতা সেন একটি কাল্পনিক নারী চরিত্র। হয়তো এই চরিত্রের মধ্যে কিছু বাস্তবতা থাকতে পারে। কারণ, জীবনানন্দ দাশের জীবনে এক সময় প্রেম এসেছিল। কবি এই কবিতায় লিখেছিলেন,
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, রূপ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূর সমুদ্রের পারে যে নাবিক হারায়েছে দিশা, দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে, অন্ধকারে, বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন, পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
জীবনানন্দ দাশ বিবাহ করেছিলেন লাবণ্য গুপ্তকে। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। কারণ, সংসারের আর্থিক অনটন। দূর অতীতে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া শোভনার সঙ্গে অতীতে কবির একটা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ লেখেন, বেলা অবেলা কালবেলা, মহাপৃথিবী, রূপসী বাংলা, সাতটি তারার তিমির এবং ধূসর পান্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থ।
তিনি ছিলেন বরাবরই প্রচারবিমুখ মানুষ। উপন্যাস লিখেছেন, মাল্যবান, সতীর্থ ও কারুবাসনা।
তাঁর লেখাগুলো অধিকাংশই প্রকাশিত হতো, প্রগতি, কল্লোল ও কালি কলম পত্রিকায়।
এছাড়া, বেশকিছু প্রবন্ধগ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন। কেন লিখি, লিটারারি নোটস, প্রভৃতি লেখা প্রবন্ধ গ্রন্থ।
অনেকে তাঁকে বলেছেন, তিমির হননের কবি। কেউ কেউ বলেছেন, নির্জনতার কবি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, চিত্র ধর্মী কবি।
তিনি লিখেছিলেন, “হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,”
একদিকে প্রকৃতি চেতনা, অন্যদিকে ইতিহাস চেতনা, আবার স্বাদেশিক চেতনা, বারবার তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে।
চিত্রকল্প ব্যবহার করতে গিয়েও, তাঁর প্রতিভার অনন্যতা বারেবারে প্রমাণিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে আর্থিক ক্ষেত্রে অসফল মানুষ তিনি। অথচ, কবিতায় বারবার জীবনের মহৎ চালচিত্র অনুপম সুন্দর ভঙ্গিতে তুলে ধরতে পেরেছেন।
হৃদয়ের গাঢ় অনুভূতি মিশিয়ে কি সুন্দর ভাষায় লিখেছেন,
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, নাটোরের বনলতা সেন।
১৯৫৪ সালের ২২ শে অক্টোবর কোলকাতার শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
ইতিপূর্বে ল্যান্সডাউন রোডে তিনি ট্রাম দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ছিলেন। মারা যাবার আগে, কবি জীবনানন্দ দাশের শেষ সংলাপ ছিল, ধূসর পান্ডুলিপি সারা আকাশ জুড়ে।
তাঁর মৃত্যুর শেষদিকে স্ত্রী লাবণ্য দেবী হাসপাতালে আসতেন না। কবির মৃত্যুর পর বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যকে তিনি অনেক কিছু দিয়ে গেছেন, আমাকে কি দিয়ে গেলেন?
যে ট্রামের ধাক্কায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কবি, সেই ট্রাম চালকের সেদিন ছিল চাকরির শেষ দিন। বাড়িতে অশান্তি ছিল, ছেলেকে নিয়ে। ছেলে বি,কম পড়ে। পড়ার বই ছেড়ে, জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে। ভদ্রলোক ছেলেকে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পর এদেশে আর কোনো কবি আছেন নাকি। ছেলে জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই দেখিয়েছিল।
সেদিন বারবার ঘন্টি বাজানো সত্বেও, যে ভদ্রলোক ট্রাম লাইন থেকে সরে যাননি, এবং ট্রামের ধাক্কায় পাঁজরে আঘাত পেয়েছেন, তিনি যে বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ, এই সংবাদটি পরে জানতে পেরেছিলেন তিনি।
শ্মশানে কবির মরদেহ এলে, তিনি মালা কিনে ছেলের হাতে দিয়ে বলেন, তুই মালাটা ওনার গলায় পরিয়ে দে। এখানে এত মানুষ, ওনাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন, আমি ভুল বলেছিলাম বাবা, রবীন্দ্রনাথের পর, উনি এদেশের অনেক বড় কবি।
কবি ভাবনার স্বাতন্ত্র্যে, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে, ধূসর পৃথিবীর চিত্র অঙ্কনে, অতীত ইতিহাসের মানচিত্রে হেঁটে চলা একজন অতিশয় সংবেদনশীল মরমী কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ।
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্যে যে পরিবর্তনের বাঁক এলো, তা এসেছিল, কবি জীবনানন্দ দাশের হাত ধরে।
তাঁর লেখা বিখ্যাত কতগুলি কবিতা হলো, রূপসী বাংলা, অদ্ভুত আঁধার এক, আট বছর আগের একদিন, মুহূর্ত, শ্যামলী, কমলালেবু, আকাশলীনা, তিমির হননের গান, সময়ের কাছে প্রভৃতি।
জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের জন্য তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন। তাঁর কবিতা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশেষ করে, ফরাসি ভাষায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুবই সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর রচিত কাব্য উপন্যাস ও প্রবন্ধ নিয়ে বিভিন্ন রকমের গবেষণা চলেছে।
ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনের ব্যর্থতা ছিল তাঁর নিজস্ব, অথচ, কবিতায়, উপন্যাসে ও প্রবন্ধে তিনি হাজার তারার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
এক জীবনে বহু জীবনের কাজ করে গিয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। মনে প্রানে একজন হৃদয়বান কবি তিনি। বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন,
সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।
কবি জীবনানন্দ দাশ কিন্তু সেদিনের পৃথিবীতে ইতিহাসের সরণি ধরে হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর সড়কপথে একাকী নিঃসঙ্গ হেঁটে গিয়েছিলেন।