গল্প- সুখের বাসা

সুখের বাসা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

সাত সকালে সন্দীপের ঘর থেকে প্রেশার কুকারের সিটির আওয়াজ শুনে বেলা মাসিমা ওনার স্বামী মলয় বাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, শুনতে পাচ্ছো সিটির আওয়াজ? ঠিক সাত সকালে উঠে স্বামীর জন্য রান্না বসিয়ে দিয়েছে। বেটাছেলে রোজ দিন হাত পুড়িয়ে খাবে। এটা কি ভালো দেখায়! এই জন্যই তো আমি উঠেপড়ে সন্দীপের বিয়ের ঘটকালিটা করলাম লীলার মেয়ে মামনির সাথে।
মলয় বাবু বললেন, যাক বাবা সন্দীপকে আর হাত পুড়িয়ে খেতে হবে না। সত্যি গিন্নি তুমি ঘটকালিটা করে খুব ভালো করেছ। মা-বাবাকে ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে একা থাকে। ছেলেটা বড্ড বেশি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল চাকরি করতে এসে।
প্রায় তিন বছর হলো ছেলেটা আমাদের বাড়িতে ভাড়া এসেছে। তখন থেকেই দেখি রোজ রেঁধে খায়। ছোট্ট গ্যাসতেই কি সুন্দর ব্যবস্থা করে রান্নাবান্না করে কিন্তু।
বেলা তোমার মনে আছে সন্দীপ প্রথম বার যখন আমাদেরকে চালের পায়েস করে খাইয়ে ছিল। কি সুস্বাদু হয়েছিল সেটা। আজও মুখে লেগে আছে।
বেলা মাসিমা রসিকতা করে বলেন, দেখে তো শিখতে পারো এইটুকু ছোট ছেলেটার কাছ থেকে। আজ পর্যন্ত ঠিক করে লিকার চাটুকু করতে শিখলে না। দু’কাপ চায়ের জল দিলে তা ফুটে ফুটে এক কাপ হয়ে যায়।
মলয় বাবু দুঃখ করে বলেন, সত্যি গিন্নি এই বুড়ো বয়সে বুঝতে পারি যে আমার রান্নাবান্নার একটু জ্ঞান থাকলে তোমার কত উপকার হতো।
বেলা মাসিমা বলেন, আর দুঃখ প্রকাশ করে হবে কি! যখন শেখার বয়স ছিল ভুলেও রান্নাঘরের ছায়া মাড়াতে না। ছাড়ো সেইসব অতীত কথা। এখন বাজার থেকে একটু ঘুরে এসো। পুনকো শাক আর চুনো মাছ আনবে কেবল। অতিরিক্ত সবজি এনো না। গরমে বেশি রান্না করতে পারবো না। এই বলে বাজারে যাওয়ার জন্য নাইলনের ব্যাগটা মলয় বাবুর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
মেন গেটটা খুলে রাস্তায় পা বাড়াতে যাবেন মলয় বাবু তখনি পিছন থেকে আওয়াজ এলো, মেসোমশাই বাজারে যাচ্ছেন? দাঁড়ান আমিও আসছি।
সন্দীপ ওর রুমের বাইরে রাখা চপ্পলটা পায়ে গলিয়ে বেশ হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো। রাস্তায় যেতে মলয় বাবু জিজ্ঞাসা করেন, কি কেমন লাগছে নতুন দাম্পত্য জীবন?
সন্দীপ লাজুক হেসে বলে, বেশ। আগে একা ছিলাম। মাসে দুই একবার বাজারে গেলেই চলে যেত। আর এখন পারলে রোজই বাজার করে নিয়ে এসো- এটা ওটা।
-তা যা বলেছো। আমাকেই দেখো সকাল হলেই বাজারের থলি নিয়ে রোজ বের হতেই হবে। আজ মাছ নেই তো কাল ডিম নেই। তারপর তো মুদীর দোকানে পারলে দুই বেলা ছুটতে হবে।
তবে বিয়ে করে একটাই সুখ বুঝলে সন্দীপ। তাহলে তিন বেলা বেশ মনের মতো খাওয়া দাওয়া পাওয়া যায়। কি বল তুমি?
সন্দীপ খানিকটা উপহাসের সুরে বলে, ভালো বললেন মনের মতো খাওয়া দাওয়া।
মলয় বাবু গলায় খানিক উৎকণ্ঠা নিয়ে এসে বলে, কেন কেন এমন কথা বলছো তুমি?মামনি কি তোমার মনের মতো খাবার দাবার রান্না করে না?
-মনের মতো খাবার দাবার দূরে থাক মেসোমশাই। মামনি তো রান্নাবান্নার কিছুটি জানে না। না জানে ভাতের মাড় ফেলতে, না জানে আট মাখতে, না জানে সবজি কাটতে ঠিকঠাক।
চশমাটা নাকের ডগায় সামান্য নামিয়ে মলয় বাবু বলেন, তাহলে এই একমাস ধরে রান্নাবান্না কে করছে ?
-কে আবার এই অধম।
-বল কি! তোমার মাসিমা তোমার কষ্টের কথা ভেবেই তার বান্ধবীর মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের সম্বন্ধটা করেছিল। কিন্তু এখন দেখছি তোমার কষ্ট তো বিন্দুমাত্র কমে নি।
-মেসোমশাই আগে একা থাকতাম নিজের মতো যা হোক ফুটিয়ে নিতাম। এখন তো সেটি হবার জো নেই। আমার যেসব খাবার পছন্দ মামনির তা ঠিক তেমন পছন্দ নয়।অগ্যতা দুটো পদ রান্না বেশি করতে হচ্ছে।
এতো গেল রান্না বান্নার কথা। মামনি কাপড় জামাও কাচতে পারে না ঠিক ভাবে। একদিন আমার অফিসের প্যান্ট জামা ধুতে দিয়েই বুঝে গিয়েছি মামনি কোনদিন এইসব কাজ করে নি তেমন ভাবে। অগত্যা নিজের জামা কাপড়ও ধুচ্ছি সঙ্গে বৌয়ের’ও।
মলয় বাবু বলেন, দেখো সন্দীপ একটা কাজ তুমি করতে পারো। তুমি ইনসটলমেনটে একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে নাও। আমার একটা চেনা ইলেকট্রনিক্স-এর দোকান আছে। তুমি বললে ওদের একটু বলে রাখবো।
-মেসোমশাই আমার তো আর বিরাট কিছু মাইনে নয়। এই তো বিয়ে করতে গিয়ে দুই তিন লাখ টাকার চুনা লাগলো। এর মধ্যে মামনিকে এখানে নিয়ে আসার পর থেকেই এটা ওটা সংসারের জিনিস পত্র রোজ কিনতে হচ্ছে। মোট কথা খরচা লেগেই আছে। প্রতি মাসে EMI দেওয়া একটু চাপের হয়ে যাবে। তার থেকে হাতে কেচে নেওয়াই ভালো।
-সে তো বটেই। ব্যাচিলার যখন মানুষ থাকে তখন আর ক টাকা খরচ হয়। বিয়ে করলেই তো খরচাপাতি বাড়ে। যাক গে এখন আর কি করবে। বিয়ে যখন করেই ফেলেছো একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নাও মামনিকে। আমি তোমার মাসিমাকে বলবো যে তুমি সন্দীপের কষ্ট কম করতে গিয়ে কষ্ট তো আরো বাড়িয়ে তুলেছো।
সন্দীপ আঁতকে উঠে বলে, না না মেসোমশাই মাসিমার কোনো দোষ নেই। মাসিমা আর কি করে জানবে মামনি গৃহকর্ম কিছুই জানে না। জানেন তো আজকাল বিয়ের আগে মেয়েদেরকে তেমন ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা মোটেই ভালো দেখায় না যে সে ঘরের কাজকর্ম কিছু জানে কিনা।
-তা যা বলেছো সন্দীপ। আমাদের সময় তো এখন আর নেই। তখন মেয়ে দেখতে গিয়ে জেনে আসার সুযোগ থাকত পাত্রী গৃহকর্ম কিছু জানে কিনা।
তারপর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলয় বাবু বলেন, তোমার ভালো করতে গিয়ে তোমার ঝামেলা আমরাই বাড়িয়ে দিলাম।
-ছিঃ ছিঃ মেসোমশাই এমন করে বলবেন না। বিয়ে করে হয়তো আমার ঘরের কাজটা এখন বেশি করতে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আগে আপনাদের দশ বাই বারো রুমটাকে কেবল একটা ঘর বলে মনে হতো। এখন মনে হয় একটা সংসার।
আগে অফিস থেকে ঘরে ফেরার তাড়া থাকতো না। আর এখন বিকেল চারটা বাজলেই ঘড়ি দেখতে শুরু করি। মামনি যেন একটা বিরাট চুম্বক। যার টানে অফিস থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসি। মামনি দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেই অফিসের সব ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। তারপর যখন এক গ্লাস জল কিংবা শরবত আমার সামনে ধরে তখন মনে হয় এই শহরে কেউ তো আছে যে আমার অফিস থেকে ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকে। তারপর যখন আমার ব্যাগ, জামা প্যান্টের পকেট হাতড়ে বেড়ায় তখন মনে হয় এতদিনে আমার চাকরি করা সার্থক হলো। নিজের জন্য রোজগার করে তেমন আনন্দ নেই। পুরুষ মানুষ তো রোজগার করে বৌ বাচ্চার জন্য, পরিবারের জন্য। আমার উপার্জিত অর্থ শুধু আমার একার নয় এখন।তার ওপর মামনিরও অধিকার আছে।
মাঝে মধ্যে মামনি যখন মানচিত্রের ন্যায় রুটি বানায় তখন মনে হয় কেউ তো চেষ্টা করে যাচ্ছে ভালোবাসা দিয়ে রুটি গড়ার। সত্যি বলছি মেসোমশাই বিয়েটা না করলে টেরই পেতাম না দায়িত্ব বোধ কাকে বলে, কিভাবে করতে হয় কর্তব্য, কি ভাবে উজাড় করে ভালোবাসতে হয় কাউকে আর সর্বোপরি জানতেই পারতাম না কি ভাবে বাঁধতে হয় ঘর।

Loading

Leave A Comment