Site icon আলাপী মন

গল্প- রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে

রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

মৃন্ময়ী আর দিগন্তের প্রাণভোমরা ওদের মেয়ে সমাপ্তি। ও লেখাপড়ায় খুব ভালো… নরম, মিষ্টি মন আর খুব বুঝদার। ছোট থেকেই শিক্ষিকা হবার ইচ্ছে ছিলো ওর।ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরেই খাওয়াদাওয়া করে খেলতে বসে যেতো। দুপুরে কিছুতেই মেয়েকে ঘুম পাড়াতে পারতো না মৃন্ময়ী। প্রথম প্রথম চেষ্টা করে পরে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তো। ছোট্ট মেয়ে তখন ওর খেলাঘরের পুতুলগুলোকে সামনে বসিয়ে দিদিমণি সাজতো। পড়াতো, পড়া ধরতো, শাসন করতো, গান শোনাতো, গল্প করতো ওদের সাথে। এমন মিছিমিছি খেলা করতে করতেই কখন যে বড় হয়ে গেলো মেয়েটা! এখন তো ও সত্যি সত্যিই একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের দিদিমণি। মেয়ের আরেকটা শখ গান। খুব ছোট থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছে সমাপ্তি। পরে গুরুজীর কাছে ক্লাসিকালে তালিম নেয়। খুব মিষ্টি গলা সমাপ্তির। ওর গলায় যেন সাতসুর খেলা করে।

এমন মেয়েকে তো উপযুক্ত পাত্রস্থ করা চাই। মৃন্ময়ী আর দিগন্ত চেয়েছিলো যেন ওদের মেয়ে নিজের পছন্দমত জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়। দিনকাল পাল্টেছে। তাদের পুরোনো যুগ তো আর নেই… আজকালকার লেখাপড়া জানা, চাকুরীরতা মেয়েদের ব্যক্তিত্ব অন্যরকমের…তারা অচেনা অজানা ছেলেকে হুট করে বিয়ে করে নিতে চায় না। আগে সবকিছু দেখে ছেলের সাথে মনের মিল হলে তবেই রাজী হয়। আর বাবা-মাও তাতেই মত দেন। কিন্তু এ মেয়ে সেসব পথেই গেলো না। ওর ইচ্ছে বাবা-মায়ের পছন্দসই পাত্রকেই ও বিয়ে করবে। বাবামায়ের উপর পুরো নির্ভরতা ওর আছে। গুরুজনেরা শুধু ছেলে নয় তার পরিবারকে দেখে আর তাদের অভিজ্ঞ চোখ অনেককিছুই ঠিক ভুল বুঝতে পারে যা অনেকসময় প্রেমের রঙিন চোখে ধরা পড়েনা। কিন্তু তাও বাইরে থেকে অনেক কিছুই ভালো লাগে… পরে নানা খুঁত বেরোয়। আসলে একসাথে এক ছাদের তলায় না থাকলে মানুষ চেনা যায় না…এটাই ভাবে মৃন্ময়ী।

সে যা হোক ওরা এক বহুল প্রচারিত দৈনিকে “পাত্র চাই” কলমে বিজ্ঞাপন দিলেন। বহু পাত্রপক্ষ যোগাযোগ করলো। তার থেকে কয়েকজনকে বেছে আলাদা করলেন দিগন্ত।

এর মধ্যে একটি ছেলের বাড়ি সল্টলেকে… ইঞ্জিনিয়ার…ভালো চাকরী করে…সাহিত্য-সঙ্গীত অনুরাগী। এই পাত্রের বাড়িতে প্রথম ফোন করেন দিগন্ত। পাত্রের বাবা ওনাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ করেন। দিগন্ত এক রবিবার সকালেই সল্টলেকে ওদের বাড়িতে যান।বাড়ির নাম দেখেই চমক লাগে…গেটের সামনে নেমপ্লেটে লেখা “সোনার তরী”। বাড়ির সামনে বাগানে সাদা থোকা থোকা ক্যামেলিয়া ফুটে রয়েছে। আরো কত ফুলের গাছ। সবুজ ঘাসে মোড়া লন। মালী বাগানে কাজ করছে আর পাশে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক। দিগন্ত গেটের কাছে দাঁড়াতেই উনি এগিয়ে এলেন…নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন…আসুন আসুন। আমিই অমিতের বাবা দেবাশীষ রায়।

বাড়ির বৈঠকখানা দিব্যি সাজানো-গোছানো। একটা শিল্প ভাবনা আছে…সবকিছুতেই যেন একটা সুন্দর রুচির ছাপ। দিগন্ত অবাক হয়ে দেখলেন একদিকের দেয়াল জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক বিশাল প্রতিকৃতি। দিগন্ত বুঝেই গেলেন এই বাড়ির মানুষজন রবীন্দ্র ভক্ত… সুরুচিসম্পন্ন। আর মনে মনে ভাবলেন যদি বিয়ে হয় মেয়ে এখানে ভালোই থাকবে।

আরো চমক বোধহয় বাকী ছিলো! দেবাশীষবাবুর সাথে কথা বলতে বলতেই কফি আর স্ন্যাকসের ট্রে নিয়ে হাজির ওনার স্ত্রী। তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন দিগন্ত। এ যে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মালিনী রায়! যাকে টিভির পর্দায় প্রায়ই দেখেন দিগন্ত। বেশ উত্তেজিত হয়েই দিগন্ত বলেন–কী আশ্চর্য!! অমিত আপনার ছেলে?দেবাশীষবাবুতো একবারও আপনার কথা বলেননি।

অত্যন্ত শান্ত, ভদ্র মালিনীদেবী ঈষৎ হেসে বললেন- আমার কথা আর তেমন কী বলার আছে? আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথের চরণাশ্রিত…তাঁকে আশ্রয় করেই আমাদের দিনযাপন। তিনিই আমাদের আরাধ্য দেবতা, সুখে, দুখে, ভালোবাসায়, রাগে,অভিমানে তিনি আমাদের সাথে রয়েছেন। তিনি আছেন বলেই আমরা আছি।

মালিনীদেবী আরো বলেন- আপনার মেয়েকে আমাদের পছন্দ হয়েছে…একজন শান্তস্বভাবের গান জানা মেয়েকেই চাই আমাদের ছেলের জন্য। বুঝতেই তো পারছেন! আর কোনো চাহিদা নেই। তবে অমিতকেও দেখুন…ও আমার ছেলে বলে বলছিনা…অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখুন… আজকালকার দিনে এমন ছেলে সত্যিই দুর্লভ।

অমিত বাড়িতেই ছিলো। ওর সাথেও আলাপ করলেন দিগন্ত। বেশ হাসি ভরা মুখ অমিতের। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় খানিকটা মুখ দেখেই মানুষ চিনতে পারেন দিগন্ত। ছেলেটাকে দেখে… ওর সাথে কথা বলেই বেশ ভালো লাগে দিগন্তের।

এবার মালিনীদেবী আরো অবাক করে দিয়েই একটা প্রস্তাব রাখেন দিগন্তবাবুর কাছে… বলেন- সামনের সপ্তাহেই মেয়েকে নিয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে যান আমাদের বাড়ি। একেবারে মেয়ে দেখাও হয়ে যাবে… আবার মেয়েও আমাদের বাড়ি, পরিবেশ সব দেখে যেতে পারবে। অমিতের সাথে আলাপও হয়ে যাবে। আমি সব ব্যাপারে মেয়েদেরকে আগে প্রাধান্য দিই…লেখাপড়া জানা আজকালকার মেয়েদের তো নিজস্ব কিছু পছন্দ অপছন্দ থাকে। আর দেখবেন বাড়ির মেয়েরা, বৌরা ভালো থাকলে বাড়িটাও উজ্জ্বল হয়…বলে মৃদু হাসলেন মালিনী। এত বড়, গুণী একজন শিল্পী অথচ এতটুকু অহংকার নেই। যেন মাটির মানুষ। নিজে হাতেই খাবার পরিবেশন করছেন…চা করে আনছেন!

ওদের সবার সাথে আলাপ করেই বেশ ভালো লাগে দিগন্তের।

পরের সপ্তাহেই সমাপ্তি আর মৃন্ময়ীকে নিয়ে দিগন্ত আবার যান সোনার তরীতে। ওদের আলাপচারিতায়, গানে, গল্পে ভরে ওঠে সোনার-তরী। সমাপ্তির মিষ্টি গলার গান শুনে খুব খুশী হন মালিনী। বলেন, এবারে আমার সোনারতরী পুর্ণ হয়ে উঠবে।

কথায় কথায় মালিনী সমাপ্তিকে বলেন-আমার ছেলের শুধু একটাই অসুবিধা… সেটা যদি তুমি মানিয়ে নিতে পারো… তাহলেই বিয়ের সব ঠিকঠাক গুছিয়ে ফেলবো।

সমাপ্তি একথায় একটু ঘাবড়ে যায়।বাবামায়ের দিকে একটু থতমত ভাবে তাকায় সে… তারাও যেন একটু ভাবনায়।

কচি কলাপাতা রঙের চুড়িদার, কানে গলায় হাল্কা গয়না, ছোট্ট টিপ, ছিমছাম সাজে দারুণ দেখাচ্ছে সমাপ্তিকে। দূরে অমিতের সাথে চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলো অমিত।

মৃন্ময়ীই জিজ্ঞেস করলেন ঠিক কী ব্যাপারে অসুবিধা?

মালিনী উত্তরে বললেন- সেরকম কোনো বড় ব্যাপার নয়… তবে আমার ছেলেকে মাঝেসাঝে বিদেশে যেতে হয় অফিসের কাজে… তখন সমাপ্তিকে একলা থাকতে হবে।

মৃন্ময়ী তাড়াতাড়ি বলেন- একলা কোথায়?আপনারা আছেন … স্কুল আছে … গান আছে আর রবিঠাকুর আছেন।

মালিনী বলেন- ঠিক তাই। দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি… এই গান গাইলেই অমিতবিহনে দিনগুলো চট করে কেটে যাবে।

সবাই একযোগে হেসে উঠলেন। লজ্জারাঙা সমাপ্তির চোখ তখন লুকিয়ে একপলকে ছুঁয়ে দিলো অমিতকে। অমিতও যেন এতদিন ধরে খুঁজছিলো এই দু’টি চোখ।

Exit mobile version