আকাশমুখী
-পাপিয়া ঘোষ সিংহ
সকালে চোখ খুলেই অপু জানলার দিকে তাকালো, আকাশের মুখ ভার। মনটা খারাপ হয়ে গেল, তবুও সে গা ঝারা দিয়ে উঠে পড়লো দৈনন্দিন কাজ তো করতেই হয়। সকালে ছাদে গিয়ে সে রোজ আকাশ দেখে,তার সাথে কথা বলে অপু রোজ তার দিন শুরু করে। আজও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু আজ যেন সবতেই কিছু খারাপ ইঙ্গিত। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মুখভার দেখে অপুর খুব খারাপ লাগে, এবং অপুর মনের জমানো অভিমান জানাতেই আকাশ রাগে ফুঁসে উঠলো। এ যেন অন্য আকাশ। এ আকাশ অপুর অচেনা। বড়ো কষ্ট পেয়েছে অপু আজ। এত রাগ,এত গর্জন- বিনা মেঘে! বৃষ্টির আভাসও নেই।
অপু- অপর্ণা বোস, চাকুরিরতা মধ্যবয়সী। মফস্বলেই বেড়ে ওঠা, সেখানেই থাকা। সাদাসিধে অথচ দাম্ভিক অপু বড়ো ভালোবাসে ঘর গোছাতে। সবকিছু সাজিয়ে রাখায় তার কাজ। কিন্তু কেন যে এই সাজানো সবকিছু মাঝে মাঝেই উলোটপালোট হয়ে যায়, অপু বুঝতেই পারে না। অপু খুব কাজ পাগল, রান্না করা, গাছ লাগানো অপুর হবি। অপু কথা খুব বেশি বলতে না পারলেও মানুষজন খুব ভালোবাসে।
একবার অপুর তখন সদ্য যৌবন। সরস্বতী পূজোর ঠিক আগেই অপু ব্যস্ত নানা কাজে,হঠাৎ তার চোখ পড়লো আকাশের দিকে। কি সুন্দর ঝকঝকে বসন্তের উচ্ছাস। কি নির্মল! ব্যাস সেই শুরু তার আকাশের প্রতি প্রেম। তারপর থেকে অপু আকাশের। কিন্তু আকাশ ঘনঘন রূপ বদলায়। কখনো মেঘ,কখনো বিদ্যুৎ, কখনো চাঁদ কখনো বা সূর্য আকাশকে অধিকার করতে চায়, মাঝে মাঝেই অপূর খুব কষ্ট হয়। তার মনে হয়,স্বচ্ছ নীল আকাশ শুধু তার, তবু কেন সেখানে মেঘেদের ভীড়, তারাদের অধিকার, চাঁদের আকর্ষণ? প্রশ্নেরা ভীড় করে অপূর মনে।
প্রকৃতি প্রেমিক অপু কিন্তু চাঁদ, তারা, মেঘেদের আলাদা করে খুব ভালোবাসে।অসংখ্য তারারা যখন মিটিমিটি চায় অপূর মনে হয় এ যেন হাতের মুঠোয় স্বর্গ। জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো যখন ব্যালকনিতে পড়ে, অপু হারিয়ে যায় তেপান্তরের মাঠে রূপকথার দেশে। মেঘেরা যখন উড়ে আসে তখন অপুর মন সিক্ত হয়। তবুও এই সবাই যখন সবটাই করে আকাশকে ঘিরে তখন অপুর খুব কষ্ট হয়। অপু তার আকাশের বুকে মাথা রাখার জায়গা খুঁজে পায়না। মুক্ত আকাশকে কখনও অপু নিজের করে পায়না, কখনও তার স্পর্শ পায়না।
অনেক অভিমানে অপু মাঝে মাঝেই আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে চাই। সঠিক ঠিকানায় পাঠালেও কখনো সে চিঠি আকাশের কাছে পৌঁছয় না।শুধুই দিশা হারিয়ে ফেলে। এখন অপু অন্তহীন অপেক্ষায়। কবে তার মনের কথা বুঝবে তার আকাশ। কবে ঐ উচ্চতা কাটিয়ে ধরায় নেমে মিলিত হবে অপুর সাথে? কবে অসীমতা কাটিয়ে সসীম হয়ে উষ্ণতা ছড়াবে অপুর ভালোবাসায়।
অপুর মাঝে মাঝে মনে হয় আকাশ বড়ো অহঙ্কারী। সে সর্বদা তার উচ্চতা সম্পর্কে সচেতন। বুদ্ধিমতি অপু বুঝতে পারে,আকাশমুখী হয়ে উঠছে সে। নিজের অস্তিত্ব, কাজ, ভালোলাগা সব যেন একে একে হারিয়ে ফেলছে, অপু তার মনকে বাঁধতে চায়। তবুও ভালোবাসার বন্যা কি আর বাঁধে আটকায়। সে চলে তার আপন প্রবাহে। অপুর স্থির বিশ্বাসে বেঁচে থাকে, নিখাদ ভালোবাসার জয় নিশ্চিত। একদিন সমস্ত মায়াজাল ছিঁড়ে উচ্চতা কমিয়ে নীলাভ আভার সাথে আসবে সে তার অপূর কাছে। বুকে করে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ঐ সুদূরে। ভালোবাসার জয় অবশ্যম্ভাবী।