খুশীর রঙ
-তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়
জীবনে রঙের তো কোন অভাব ছিলো না অপর্ণার। রামধনুর সাত রঙের মেলায় ও ছিলো রঙীন এক প্রজাপতির মতো। বাবা-মায়ের আদরের ছটপটে মেয়েটি লেখাপড়া করে একটা চাকরী যোগাড় করেছিলো প্রাইভেট ফার্মে।জীবন বেশ চলছিলো তরতরিয়ে। বাড়ির দায়দায়িত্ব তেমন কিছু ছিলো না… নিজের উপার্জিত অর্থ নিজের খুশীমতো খরচ করতে পারতো সে। বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা,আড্ডা,শপিং করে বেশ মজায় কাটছিলো দিন। পিছন ফিরে তাকালে অপর্ণার মনে হয় সেই দিনগুলোই তার জীবনের সোনালী দিন ছিলো। এত স্বাধীনতা তাড়াতাড়ি হারাতে চায়নি সে…তাই বিয়ের বয়স একটু বেড়েই গেছিলো। যদিও এখনকার দিনে অল্পবয়সে কোন মেয়েই’বা বিয়ের ফাঁদে পড়তে চায় যদি তার সামনে এমন একটা খোলা আকাশ থাকে?
যদিও মা তাড়া দিতেন… প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে বলতেন –দ্যাখ, মেয়েদের সঠিক সময়ে বাচ্চা হওয়াটা জরুরী নয়তো পরে নানা সমস্যা হয়। অপর্ণা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতো আগে বিয়ে না আগে বাচ্চা??
মা উত্তরে বলতো –“জানিসতো এখন মর্ডান মেডিকেল ব্যবস্থায় বিয়ের আগেই বাচ্চার চিন্তা করে মানুষ, যারা দেরী করে বাচ্চা নিতে চায় তারা ওভাম সংরক্ষণ করে। যত বয়স বাড়ে ওভামের কোয়ালিটি খারাপ হতে শুরু করে।”
সত্যিই আমার মা কত্ত জানে! এই কথা বলে আরো হাসতো অপর্ণা। তারপর বলতো–” অত চিন্তা কোরোনা, তোমার মেয়ে বুড়ি হবার আগেই বিয়ে করবে।”
শুনে মা চুপ করতেন।
অবশেষে ব্যাঙ্ক চাকুরে তপনের সাথে বিয়ে হয়েছিলো অপর্ণার। বিয়ের পরেও তিন-চার বছর বেশ হেসেখেলে,ঘুরে বেড়িয়ে রোমান্স করে কাটিয়ে দিলো ওরা। তারপর বাচ্চা নিলো। সুন্দর একটা ফুটফুটে দেখতে বাচ্চা হ’লো ওদের। কিন্তু বাচ্চাটা একটু বড় হতেই ওরা বুঝলেন বাচ্চা স্বাভাবিক নয়। কানে শুনতে পায়…তাকায় কিন্তু কথা বলতে পারেনা। মুখ দিয়ে লালা ঝরে শুধু। ডাক্তার বলেন বাচ্চার বুদ্ধির বিকাশ হয়নি ঠিকঠাক। একথা শুনে অপর্ণা-তপনের মাথায় হাত। এইসময় ছেলেকে ঠিকমত দেখাশোনার জন্য চাকরীটাও ছাড়তে হোলো অপর্ণার। তারসাথে ছেলের জন্য যোগ হলো এক তীব্র মানসিক কষ্ট। সন্তানকে বড় করতে গিয়ে বিষন্নতা গ্রাস করলো অপর্ণাকে।বিষন্নতার রঙ বোধহয় কালো। সেই কালো ছায়া ওদের সংসার,ওদের দাম্পত্য সম্পর্ককেও বিষিয়ে তুলেছিলো। আশেপাশের আত্মীয়পরিজন অপর্ণাকে দুষতে লাগলেন। অপর্ণা ভাবলো সবই তার খারাপ কপাল… নয়তো…।
পাশের বাড়ির রীমা বউদি একদিন বললেন–অপর্ণা ওকে “হ্যাপী হোম” বলে যে শিশু বিকাশ কেন্দ্র আছে… ওখানে ভর্তি করে দাও। ওরাই কথা, লেখাপড়া, খেলাধূলা,হাতের কাজ সব শেখাবে যত্ন করে। আমার বোনের ননদের ছেলেকেও দিয়েছিলো।এখন নিজের কাজ দিব্যি সব পারে… দিয়েই দেখো।
বৌদির কথামতো ওরা গেলো হ্যাপী হোম এ। ওখানকার ডাক্তার পরীক্ষা করলেন জয়কে।অপর্ণাকে বললেন–চিন্তা করবেন না।ওকে অনেক ভালোবাসা আর সময় দিতে হবে আপনাকে।দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওখানে অপর্ণা দেখলো ওর ছেলের মতই নানাবয়সের অনেক বাচ্চা আছে।তাদের কেউ কেউ ঠিক করে হাঁটাচলাও করতে পারেনা। ওদের সবার সাথে মাকেও থাকতে হয় ওখানে।মায়েদেরও মাঝে মাঝে ক্লাস হয়…সেখানে মায়েদেরও গাইডলাইন দেওয়া হয় কীভাবে তারা বাচ্চার সাথে ব্যবহার করবেন।বাচ্চাকে সামলাবেন।
অত বাচ্চার কষ্ট দেখে আরো যেন কান্না পেয়ে গেলো অপর্ণার।ওদের সবার মায়েদের মুখগুলোও যেন কেমন করুণ… ঠিক অপর্ণার মতই।ও ভাবলো যেসব বাচ্চারা স্বাভাবিক,সুস্থ সেসব বাচ্চার মায়েরা কত লাকী অথচ তারাই পরীক্ষায় বাচ্চা দু’এক নম্বর কম পেলে কত শাসন ধমক অত্যাচার চালান বাচ্চাদের উপরে। ওরা ভাবতেই পারবেনা এই বাচ্চাগুলোর মায়েরা শুধু বাচ্চার আধোবুলি ফোটার অপেক্ষায় কাটিয়ে দেন কতো বছর!!
ওর চোখের জল দেখে ওখানকার এক টিচার এগিয়ে এলেন –বললেন আমরা তো আছি…সব শিখে যাবে আপনার বাচ্চা…শুধু ধৈর্য্য চাই…মনের বল চাই।মন নরম হলে আর কথায় কথায় চোখের জল ফেললে হবেনা। দেখুন ওদের… কত বড় বড় ছেলেমেয়ে হাঁটতে পারেনা…মায়েরা কোলে কোলে নিয়ে আসেন…কত্ত কষ্ট করেন…তাও হাসীমুখে থাকার চেষ্টা করেন।আমরা বলেছি আপনারা কাঁদলেন মানে আপনারা হেরে গেলেন।এখানে মায়েরা একসাথে গল্প করেন। রান্না করে এনে নিজেদের মধ্যে খাওয়াদাওয়া করেন।ছেলেমেয়েকে এখানে আমাদের কাছে রেখে নিজেরা একটু বেড়িয়ে আসেন…কেনাকাটা করেন….হাসীতে মজায় থাকেন।আমরা সেটাই বলি।নিজেরা ভালো না থাকলে বাচ্চাদের ভালো রাখবেন কি করে শুনি??
অপর্ণা ওদের কথা মেনে চলতে লাগলো।অন্য বাচ্চার মায়েদের সাথে আলাপ হলো।তাদের সাথে সুখদুঃখের গল্প করে মনটাও হাল্কা হলো।সবাই এখানে একে অপরের দুঃখের ভাগীদার।
এমন করেই প্রায় ছ’মাস কেটে গেলো।অপর্ণা জয়ের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে।ও একটু একটু শব্দ করতে পারে,কথা বুঝতে পারে,কমিউনিকেট করতে পারে।আর রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি রঙ করে।এসবই টিচারদের অসীম ধৈর্যের ফসল। অবশ্য অপর্ণাও আছে ছেলের সাথে।ও তো মা…ওকে তো পারতেই হবে…এ ও যেন এক জীবন যুদ্ধ।
সেদিন ছাদে ছেলেকে নিয়ে ঘুরছিলো অপর্ণা।মাথার উপর আকাশটা আজ একটু বেশীই নীল।হঠাৎ জয় মুখ দিয়ে ছোট্ট একটা শব্দ করে উঠলো।অপর্ণা চমকে উঠলো…জোরে চিৎকার করে বললো কি বললি সোনা??!!!ছেলের মুখ দিয়ে আবারো ছিটকে বেড়িয়ে এল আধো আধো একটা শব্দ “মা”। মায়ের খুশী যেন ছড়িয়ে পড়লো ওই গোটা আকাশে, বাতাসে।আর মনটা ঝকমক করে উঠলো খুশীর সোনালী রঙে।।