অন্ধ তামস
-সুমিতা দাশগুপ্ত
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হওয়ার সুবাদে অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিলো সুনন্দ। প্রেস্, মিডিয়া, ফুলের তোড়া, মিষ্টির বাক্সের স্তূপ জমছে। আত্মীয়স্বজন, আবাসনের পরিচিত অপরিচিত অনেক হাসি মুখ। কেউ বা চায় কাছে এসে হাত মেলাতে, আবার কেউ বা চায় পাশে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে আত্মীয়তা জাহির করতে। এই সব কিছুর মধ্যে, অসম্ভব জেনেও সুনন্দর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার অতি প্রিয় স্নেহময়ী এক বৃদ্ধাকে, এই আবাসনেরই পাঁচতলার বাসিন্দা, লোকে যাঁকে কোনও অজানা কারণে, এই একা থাকা বৃদ্ধাটিকে স্রেফ কুসংস্কারের বশে, অপয়া বলে দাগিয়ে রেখেছে।
তাঁকে এড়িয়ে চলতে সবাই সদা তৎপর। কোনও আনন্দ আয়োজনে তাঁর ডাক পড়ে না, কোনও উৎসবে নেই তাঁর আমন্ত্রণ।শুভকাজে বের হবার সময় সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে পাছে লিফটে তাঁর মুখোমুখি হতে হয়!
সুনন্দকেও তার মা সাবধান করে দিয়েছিলেন, স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো কোনও রকম আলাপচারিতার বিরুদ্ধে, কিন্তু কে না জানে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানব চরিত্রের অমোঘ আকর্ষণের কথা! সুনন্দই বা তার ব্যতিক্রম হয় কী করে!
সুনন্দর আজ আর মনেও পড়ে না, সেই কবে থেকে ওঁর সঙ্গে তার একটা অজানা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে, শিশু বয়সের কৌতূহলে আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি, মাঝে মধ্যে হাসি বিনিময়, তারপর সাহস করে তাঁর কাছে নিয়মিত আনাগোনা লুকিয়ে টুকটাক বাদাম তক্তি, টফি, চকোলেটের উপহার। এইসবই কাছাকাছি এনে তাদের দুজনের মধ্যে অসমবয়সী বন্ধুত্বের একখানা সেতু গড়ে দিয়েছিল।
সুনন্দ’র জন্য, প্রতিদিন উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকা স্বজনহীন বৃদ্ধাটির একক জীবনে সুনন্দই হলো একমাত্র প্রভাতকিরণ, আহ্লাদের আলো। এই লুকোচুরি খেলার গল্প, এখনও পর্যন্ত, কেউ জানে না। তবে আজ সুনন্দ বড়ো হয়েছে। আজই সেই উপযুক্ত সময়, জনসমক্ষে সবকিছু জানানোর এবং একটা জোরালো প্রতিবাদের! হ্যাঁ আজই মিডিয়ার সামনে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়, কথা প্রসঙ্গে সুনন্দ অকম্পিত দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করবে, পয়া অপয়া বলে কিছু হয় না, প্রতিবারের মতো এবারেও ওঁকে প্রণাম করেই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল সুনন্দ এবং এজন্য তার পরীক্ষার ফলাফলের কোনও রকম হেরফের আগেও হয়নি এবারেও নয়। আসলে হবার কথাও তো নয়, যে কোনও যুক্তিবাদী মনই সেকথা স্বীকার করবে। নইলে শিক্ষার কী উদ্দেশ্য? কেবলই কি গোটাকতক সার্টিফিকেটের কাগজ সংগ্রহ করা!
এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের কাছে, এই অন্ধ তমিস্রা কাটিয়ে, নতুন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠার। পারবে না সুনন্দ অন্তত একটি মনকেও যুক্তির আলোয় আলোকিত করতে?