
অনুবাদ- বেগুনের গুণ (কৃষণ চন্দর)
বেগুনের গুণ (কৃষণ চন্দর)
–বর্ণালী জানা
বরমপুরে হাতে অনেক দিন কোনো কাজবাজ নেই। ঘরে খাবার-দাবার নেই। দুদিন ধরে পেটে কিল মেরে পড়ে রয়েছি। পকেটে শুধু পঞ্চাশটা পয়সা পড়ে রয়েছে। বউকে গিয়ে বলি… ‘হ্যাঁ গো, ঘরে দু-এক মুঠো আটাও কি নেই? আজকের দুপুরটা চালিয়ে নেওয়া যাবে না?’
‘যা আটা আছে তা দিয়ে মাত্র চারটে রুটি হবে’।
‘ঠিক আছে, চলে যাবে’?
‘কী করে চলবেটা শুনি?’
পকেট থেকে পয়সাটা করে বউয়ের হাতে দিই… ‘যাও বাজারে গিয়ে বেগুন কিনে আনো। একটু বেগুন ভর্তা হলে দুপুরটা চলে যাবে’।
‘সে না হয় হল? তা রাতে কী খাবে শুনি? হরিমটর?’
‘আরে চটছো কেন? ঐ ওপরে যিনি বসে আছেন তিনি সব ইন্তেজাম করে দেবেন’।
কথা বলতে বলতেই কাচের বাক্সটার দিকে চোখ চলে যায়। বাক্সের ভেতর প্লাস্টার অফ প্যারিসের একটা ছোট্ট তাজমহল। বিয়ের পর পর অনেক সাধ করে বউকে কিনে দিয়েছিলাম। আগ্রায় তাজমহল দেখতে গিয়ে এটা কিনেছিলাম। ভালোবাসা এক আজব কিসসা। বিশেষ করে বিয়ের ঠিক পর পর। চোখে সবকিছুই রঙিন লাগে। কুড়ি টাকার এই উপহার পেয়ে বউ তো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল! এখন কাচের বাক্সের ভেতরের এই ঝুটা তাজমহলটাকে দেখলেই বেচে দিতে ইচ্ছে করে। দুটো পয়সা তো আসবে। কিন্তু একথা বললেই বউয়ের মুখ চুন। পরমুহূর্তেই তার মুখ ঝামটা… ‘এটা আমার সুহাগের চিহ্ন। কিন্তু এটা আমি হাতছাড়া করব না’।
অগত্যা ইনিয়ে বিনিয়ে বউকে আবার শান্ত করতে হয়… ‘আচ্ছা আমরা এটা বেচব না। অন্য কিছু বেচব। ঐ ওপরওয়ালা নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবেন । এখন বাজারে গিয়ে বেগুন কিনে আনো তো দেখি । খিদেয় মরে যাচ্ছি’।
বাজারে গিয়ে বউ কয়েকটা কালো বেগুন নিয়ে ফিরল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে কাটাকুটি করতে বসল। একটা বেগুন মাঝামাঝি কেটেই থেমে যায়…হাত থেকে চাকুটা ছিটকে পড়ে।
আমি উঠে যাই… ‘কী হল? কী ব্যাপার?’
‘দেখো গো! বেগুনের ভেতর কী যেন সব লেখা!’
বেগুনটাকে নেড়েচেড়ে দেখি। বেগুনের বীচিগুলো এমন ভাবে সাজানো মনে হচ্ছে যেন আরবিতে কেউ ‘আল্লা’ লিখে রেখেছে।
আমি যে পূর্বিয়াঁ মহল্লায় থাকি সেখানে অর্ধেকের বেশি ঘরই আমাদের মতো হিন্দু। বাকিদের মধ্যে মুসলমানই বেশি। তবে কয়েকঘর খ্রিস্টানও রয়েছে। বেগুনের ভেতর আল্লার অধিষ্ঠানের খবর মহল্লায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আল্লার এই চমৎকারি দেখতে আমার বাড়িতে কাতারে কাতারে লোক এসে জোটে। তবে হিন্দু আর খ্রিস্টানরা মুখ বেঁকায়। তাদের এইসব অলৌকিক ব্যাপারস্যাপারে বিশ্বাস নেই। কিন্তু মুসলিমদের তো আছে! হাজি মিঁয়া আচ্চান এসে আল্লার দর্শন করে পাঁচ টাকা নজরানা দিলেন। বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র জপলেন।
বেগুনটা এখন ভীষণ দামি! একে সামলেসুমলে রাখতে হবে! কাচের বাক্স থেকে ছোট তাজমহলটাক বের করে তার জায়গায় বেগুনটাকে সাজিয়ে রাখলাম। একজন ভক্ত এসে বাক্সটার নীচে একটা সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়ে গেল। তারপর আমাদের মুন্নান মিঁয়া এসে কোরাণ পাঠ শুরু করে দিল।
আশেপাশের সব জায়গা…সমস্তিপুর, মেমনপুরা, বৈজওয়াড়া, কামানগড় থেকে শুরু করে সাইলান মিঁয়ার চক, মহল কোঠিয়ারান থেকে পিল পিল করে আল্লার নেক বান্দারা এই চমৎকারি দেখতে ছুটে আসে।
একজন বলেন… ‘আমাদের ধর্মের মহিমা দেখেছ! একজন কাফেরের ঘরে আল্লা দেখা দিলেন!’
অন্যজন বলে… ‘এটাই আমাদের আল্লার ইচ্ছা! কাফেরগুলোকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন’।
লোক যত বাড়ে তত বাড়ে নজরানা। একেবারে হরির লুঠ! প্রথম পনেরো দিনেই সাত হাজার টাকা! তার মধ্যে থেকে তিনশো টাকা গাঁজাখোর সেইন করম শাহ—এর হাতে দিই। কারণ সেই তো চব্বিশ ঘণ্টা, এই অমূল্য রত্নটা পাহারা দেয়।
দিন কুড়ি পর ভিড় পাতলা হয়ে এল। মানুষের উৎসাহ এখন কমতির দিকে। একদিন সেইন করম শাহ যখন গাঁজার নেশায় গভীর ঘুমে তখন আমি বাক্স থেকে বেগুনটাকে একটু নেড়ে নেড়ে উলটে পাল্টে বউয়ের কাছে নিয়ে আসি… ‘দেখো তো এবার কী লেখা রয়েছে?’
দেখে তো বউয়ের চোখ ছানাবড়া। মুখ দিয়ে কথাই সরে না। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে কোনোমতে সে বলে… ‘হরে কৃষ্ণ! নিজের চোখকেও যে বিশ্বাস যায় না! কোথায় এখানে আল্লা লেখা! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দেবনাগরীতে ‘ওম’ লেখা রয়েছে। এ যে ঈশ্বরের অসীম কৃপা’!
সেই রাতেই বেগুনটা নিয়ে পণ্ডিত রামদয়ালের বাড়ি গেলাম। বেগুনটাকে এবার একটু উলটিয়ে তাঁর সামনে রাখলাম।
পণ্ডিতমশাই হতভম্ব… ‘এ যে ‘ওম’, আমাদের ‘ওম’। মুসলমানগুলো তবে এতদিন ধরে আমাদের ঠকাচ্ছিল’!
পণ্ডিত মশাই এসে করম শাহকে ধাক্কা মেরে ঘুম থেকে তুললেন। কটমট করে তার দিয়ে চাইলেন…যেন ভস্ম করে দেবেন। তারপরই ঘাড়ধাক্কা… ‘এখান থেকে দূর হ ভতভাগা ভণ্ড পামর। আমাদের ধর্মকে তুই অপবিত্র করেছিস! আমাদের ‘ওম’-কে তুই ‘আল্লা’ বলে চালাচ্ছিস!’
মহল্লায় হিন্দুদের মধ্যে খুশির উল্লাস। বেগুনের মধ্যে আল্লা নেই, ওম রয়েছে। পণ্ডিত রামদয়াল এবার তাঁর দায়িত্ব বুঝে নেন। শুরু হয় পূজা-পাঠ, আরতি, ভজন, সংকীর্তন। ঠাকুরের জন্য প্রণামী, দামী পট্টবস্ত্র আর রাশি রাশি অলংকার এসে জমা হয়। প্রণামীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ টাকা পণ্ডিতজির হাতে তুলে দিই। যতই হোক তিনি অনেকে খাটাখাটনি করছেন। একটু তোয়াজে তো রাখতেই হবে। আমি ন্যায্য কথার মানুষ। সমাজের গরিবগুর্বো মানুষের কথা আমার চেয়ে বেশি কেউ ভাবে না।
বেগুনের মধ্যে আল্লা, ওম-এ রূপান্তরিত হয়েছেন। এমন অলৌকিক কাণ্ডের কথা কে কবে শুনেছে! বাড়িতে সব আচার্য, মোহান্ত আর স্বামীজিদের ঢল। তাদের মুখে ধর্মযুদ্ধ জয়ের তৃপ্তি। পানিপতের তিনটে যুদ্ধ হারার পর মুসলমানগুলোকে অবশেষে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া গেছে… মুখে একেবারে ঝামা ঘসে দেওয়া আর কি। শহরে এখন দুটো শিবির। দুই শিবিরই বলে তাদের ধর্মই সেরা। বাকিরা কাফের, বিধর্মী। আগে মহল্লার মানুষের মধ্যে কত মিলমিশ ছিল। এখন শুধু রেষারেষি। সবার চোখে সন্দেহ। সবার মনে অবিশ্বাস। একেবারে দমবন্ধ করা পরিবেশ।
হিন্দুরা বলে… ‘ওটা আসলে আমাদের ওম’।
মুসলমানেরা বলে… ‘হরকিজ নয়। উনিই আমাদের আল্লা রসুল’।
-‘ওম’
-‘আল্লা’
-‘হরি ওম তৎসৎ’
‘আল্লা হো আকবর’
পরের মাসে প্রণামী বাবদ জুটল পঁচিশ হাজার টাকা।
তারপর ভক্তদের উন্মাদনা থিতিয়ে এল। আবার কিছু একটা খেল দেখাতে হবে। একদিন রাতে আবার হাতসাফাই করতে হল। রামদয়ালজি তখন ঘুমে অচেতন। আমি এই ফাঁকে বাক্স থেকে বেগুনটাকে বের করে আবার একটু উলটে পালটে বউয়ের সামনে ধরলাম… ‘ভালো করে দেখো তো? কী লেখা আছে এতে?’
‘দেখার কী আছে? ওম লেখা রয়েছে’।
আবার বেগুনটাকে নাড়ানাড়া করে বীচিগুলোকে একটু এদিক ওদিক করে আবার বউয়ের সামনে ধরি… ‘এবার ভালো করে দেখে কী লেখা রয়েছে?’
বউয়ের তো চক্ষু চড়কগাছ… ‘ও মা গো এ কী কাণ্ড! এ যে দেখি ক্রশ চিহ্ন। আরে খেরেস্তানদের ক্রশ গো!’
কোনোমতে বউয়ের মুখটা চেপে ধরি। বেশি চেঁচালে সব ভণ্ডুল… ‘শোনো এখন মুখে কুলুপ এঁটে থাকো। কাল রবিবার। পাদ্রি ডুরান্ডের সঙ্গে একটু পরামর্শ করে দেখি’।
পরের দিন পাদরি ডুরান্ড আরো এগারোজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে পবিত্র ক্রশ সন্দর্শনে আমার কুটিরে পায়ের ধুলো দিলেন। ওম-এর ভোলবদলে তাঁরা তো একেবারে বিগলিত। তাঁরা বুকে বার বার ক্রশ আঁকেন…যীশুর বন্দনাগীত শুরু করে দেন। এবার আমার বাসায় ভক্ত খ্রিস্টানদের জমায়েত। সবাই তারা যীশুর এই মহিমা দেখতে চায়।
শহরে এখন তিনটে শিবির। হিন্দুরা বলে- ওম। মুসলমানেরা বলে- আল্লা। আর খ্রিস্টানদের দাবি এটা তাদের পবিত্র ক্রশ।
শহরে উত্তাপ বাড়ে। প্রথমে পাথর ছোঁড়াছুড়ি…তারপর ছুরি-তরবারি, খুনজখম। সমস্তিপুরায় দুজন হিন্দু খুন হয়ে গেল। সুর্জনপুরায় কাটা পড়ল তিনজন মুসলমান। দিনদুপরের শহরের চৌকে এখন খ্রিস্টানের বুখে ছুরি বিঁধল। পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতে এল।
তার আগেই আমি ভাগলবা। আগে থেকেই আমি সব আঁচ করতে পারছিলাম। বেগুনটাকে পাশের নর্দমার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, বাক্সপ্যাঁটরা গুটিয়ে চলে এলাম বোম্বাই। বেগুনের গুণে বেশ ভালোই রোজগার করেছিলাম। তা দিয়ে একটা ট্যাক্সি কিনে ট্যাক্সিওয়ালা বনে গেলাম।
আমার গল্প শেষ। গল্প শেষ করে শুঁড়িখানার কাউন্টার থেকে দারুর গেলাসটা তুলে এক চুমুকে সাবাড়। হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। কাউন্টারের ওপর গেলাসটা রাখার ফলে একটা দারুণ গোলমতো জল-ছবি তৈরি হয়েছে। পাশেই বসেছিল মহম্মদভাই। সেও আমার মতো ট্যাক্সি চালায়। মহম্মদভাইকে কানে কানে বলি জলের ছাপটকে দেখে মনে হচ্ছে ‘ওম’ লেখা রয়েছে।
মহম্মদবাই বিজ্ঞের মতো কাউন্টারের ওপর গেলাসের ছাপটাকে দেখে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে ওঠে… ‘দূর শালা এটা তোর বরমপুর নয়। এটা বম্বে। এখানে কোনো ওম, আল্লা, ক্রশ নেই। এখানে আছে শুধু রোকড়া। সবকিছু এখানে টাকায় বিকোয়। ফালতু বকে লাভ নেই। রাতে গাড়িটাকে ছোটাতে পারলে পকেটে দুটো পয়সা আসবে।
এই বলেই সে কাউন্টারের ওপর থেকে জলের ছাপটা মুছে দেয়। তারপর হাতটা ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে আমাকে বাইরে নিয়ে আসে।


One Comment
Anonymous
আপনি কি মূল এস্পানিওল জানেন?
Conoces el Espanyol original?