গল্প- ভূমিকার ভুমিকায়

ভূমিকার ভুমিকায়
– সঞ্চিতা রায়(ঝুমকোলতা)

 

 

ভূমিকা রায়ের আজকে খবরের কাগজে অনেক বড় একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গানের শ্রোতা আজ সারা পৃথিবী জুড়ে। আর তাঁর গানের ছাত্রীরা কেউবা রিয়েলিটি শো তে প্রথম, কেউবা সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কাছে গান শিখে অনেকেই আজ জীবনে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত।
সাংবাদিক- আপনার ছোট বেলার কথা বলুন ভূমিকা- যৌথ পরিবারে ভীষণ আদরের মেয়ে ছিলাম। অনেক ভাইবোনের সাথে ঠাকুমা, দাদু, জেঠিমা-জেঠু, বাবা-মা পিসিদের স্নেহ আদরে বেশ কেটেছে ছোটবেলা।
‘গান শিখেছিলেন ছোটবেলায়?’
‘আমার জেঠু, কাকু, বাবা সবাই ভালো গাইতেন, মা’ও গান জানতেন। তাই সঙ্গীত মুখর পরিবেশেই আমার বড় হওয়া।’
সাংবাদিকরা চলে গেছেন অনেকক্ষণ। বাংলায় অনার্স করার পর বড়ির সবাই চাইলো, বিয়েটা দিয়ে দিতে ,আপত্তি করেনি ভূমিকা। নির্মাল্যকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল ভূমিকার। হ্যাঁ, খুব সুখী হয়েছিল তারা। দু’বছর পর সৌজন্য এল। ভীষণ খুশী ভূমিকা ও নির্মাল্য। ভীষণ যত্নে বড় করতে লাগলো ছেলেকে। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন। নির্মাল্যর কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। আর কোনো চাকরি পেল না নির্মাল্য। আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতে হতাশা গ্রাস করলো নির্মাল্যকে। একটা বেসরকারী স্কুলে যোগ দিল ভূমিকা। কিন্তু সৌজন্য যে বড়ই ছোট তখন। বাধ্য হয়ে ছোট ব্যবসা করার কথা ভাবতে শুরু করলো ভূমিকা। দু’বছর পর নির্মাল্যর আকস্মিক মৃত্যুতে ছেলেকে নিয়ে ভীষণ অসুবিধায় পরে গেল ভূমিকা। নিজের গয়নাগুলো বিক্রি করে ছোট করে ব্যবসা শুরু করলো ভূমিকা। স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে ব্যবসায় মন দিল। বেসরকারী স্কুল তো, বড়ই কম মাইনে ছিল। বাবা-মা, জেঠু আরো সবাই আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভূমিকার ছিল প্রবল আত্মসম্মান । কারুর সাহায্য ছাড়াই নিজে কিছু করার চেষ্টা করতো সব সময়। ব্যবসার পাশাপাশি ছেলেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সেই পড়িয়েছে। গৃহশিক্ষকতাও করেছে পাশাপাশি । তার ভাল৬লাগার জগৎ গান করা, আঁকা সব হারিয়ে গেল জীবন থেকে। একা মা হিসাবে একমাত্র ছেলেকে সবটুকু দিয়ে দিল। নিজে কম খেয়ে ছেলেকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াত। হ্যাঁ, সেই অর্থে ছেলে তাকে নিরাশ করেনি। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। বড় অঙ্কের মাইনে তার। কিন্তু !

‘বাবু আমার জন্য একটা পেঁপে আনবি আজ? মাংস দিয়ে খুব পেঁপে খেতে ইচ্ছা করছে রে’
‘তুমি জানো পেঁপের এখন কত দাম? আমাকে ফ্ল্যাটের ইএমআই দিতে হয়, অত পারবো না! পাশ থেকে বৌমার গলা ‘বাবা তো একটা বাড়িও রেখে যায়নি, সবই আমাদের করতে হচ্ছে অথচ লোলা দেখ’
‘কিন্তু বাড়িটাতো আমি তোকে পড়ানোর জন্যই বিক্রি…’ কথাটা শেষ করতে দিল না ছেলে।
‘ছাড় তো ওসব সব বাবা-মা’ই সন্তানের জন্য করে, নতুন কি করেছো তুমি? চোখের জল আসে ভূমিকার। বাড়িটা থাকলেও হয়তো নিজের মত করে যেভাবে হোক জীবনটা কাটিয়ে দিত। ছেলে একই কোম্পানিতে চাকরিরতা বান্ধবীকে বিয়ে করেছে। তিয়াসা বোস। তিয়াসা আর সৌজন্য একসঙ্গে গাড়ি করে অফিস যায়, একসঙ্গেই ফেরে। রাতে খেতে বসে, ‘এ কী খাবার বানিয়েছে তোমার মা? এত কম তরকারী!’
‘সারাদিন কী করো বসে বসে? আমার বউ সারাদিন খেটে আসার পর কি রান্নাও করবে?’
‘বাবু আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না একটা রান্নার লোক রাখ না!’
‘আমার কি টাকার গাছ দেখেছো?’ এইরকম নানা ঘটনায় জর্জরিত হতে হতে ভূমিকা খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে দেখলো কোনো একটা ছোট পরিবারে বাচ্চা দেখা আর রান্নার জন্য লোক লাগবে। ভূমিকার মনে হল এই ভাবে অসম্মানিত হওয়ার চেয়ে খেটে খাওয়া ভাল। ফোন করলো। দেখা করতে গেল এবং কাজটা নিল। ‘তুমি কি আমার মান সম্মান সব নষ্ট করে দেবে? শেষে এই কাজ! কোনো দরকার নেই।’
‘আমাকে যে তোর কথা শুনতেই হবে এমন তো কথা নেই। তুই যদি রোজ আমার অসম্মান করতে পারিস, তোর সম্মান নিয়ে ভাবার দায়িত্ব আমার নয়। পারলে আমায় আটকা, আমারও কিন্তু মহিলামহল আছে।’ দৃঢ় কণ্ঠ ভূমিকার। ফোনটা বাজছে… অতীতে হারিয়ে যাচ্ছিল ভূমিকা। “ঠাম্মি আজ আমার একটু দেরী হবে, চিন্তা কোরো না কিন্তু।’
সাজির ফোন। হ্যাঁ, এই সাজিকেই ছোটবেলা থেকে দেখাশোনা করে বড় করে তুলেছে। আজ সে সাজির নিজের ঠাম্মি হয়ে উঠেছে।

দরজার বেলটা বাজালো ভূমিকা- ‘আপনারা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তাই এসেছি। ‘ছোট্ট সাজি ভূমিকার কোলে পিঠে মানুষ হচ্ছে। সাজির বাবা, মা, সাজি সবাই ভূমিকাকে খুব ভালোবাসে। সাজির বাবা মা ভূমিকাকে নিজের মায়ের মতই দেখে। সাজি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। একদিন সাজির বায়না সে গানের রিয়েলিটি শো তে যাবে। অডিশান দেবে। ‘কিন্তু তুই তো সেই ছোটবেলা কিছুদিন গান শেখার পর আর শিখিস নি কি করতে যাবি?’
‘আমাকে যেতে দাও।’
সে কী! সাজি অডিশানে সফল হয়েছে। তার চেয়েও আশ্চর্য রিয়েলিটি শো তে সে প্রথম হয়েছে। মঞ্চে সবাই যখন হাততালি দিচ্ছে, সাজি তার গুরু মা’কে সামনে আনে। হ্যাঁ, ভূমিকাই তার গুরু মা। অনেক অনেক অভিনন্দন শুভেচ্ছা আর পুরস্কার পায় তারা।

হারমোনিয়ামটা অনেক দিন কোনো কাজে লাগছিল না। একদিন ভূমিকা সাজিকে বলে,’আমাকে একটু বাজাতে দেবে? আমার জীবন থেকে তো বহুদিন গান হারিয়ে গিয়েছে, দেখি পারি কিনা! এত দিন চর্চা না থাকা সত্বেও ধীরে ধীরে গলা খুলে যায় ভূমিকার। ‘আমায় শেখাবে ঠাম্মি?’ গোপনে চলতে থাকে সঙ্গীত চর্চা। তারপরটা ইতিহাস। আজ অনেক অনেক বাবা, মা তাদের ছেলে মেয়েদের গান শেখাতে চান ভূমিকার কাছে। ভূমিকার আজ অনেক অনেক সফল ছাত্র ছাত্রী। ভূমিকা নিজেও আজ বড় সঙ্গীত শিল্পী। সাজির বাবা-মায়ের কাছে ভূমিকা মায়ের মত। আর সাজি তো তার নয়ন মণি। নিজের নাতনী । শিল্প যে শিল্পীর কাছ থেকে হারিয়ে যায় না, তার বড় প্রমাণ ভূমিকা। তবে সাজিই তার অনুপ্রেরণা। তার গানের স্কুলের নাম সাজি। বিনা পারিশ্রমিকেও অনেককে শেখায় ভূমিকা। আর্থিক দিক থেকে যারা পিছিয়ে তাদের জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা করেছে সে।

আজ ভূমিকাকে বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করা হবে সমাজে তার অবদান ও তার সঙ্গীত প্রতিভার জন্য। সৌজন্য অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। না, সাড়া দেয়নি ভূমিকা।

অনুষ্ঠান চলছে। সামনের সারিতে সৌজন্য আর তিয়াসা। একে ওকে বলছে ‘ইনি আমার মা।’ অনুষ্ঠানে যখন পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা চলছে, ভূমিকা বলে- ‘এক মিনিট, আজ আমার সব কিছু আমার নাতনী আর আমার ছেলে আর বউয়ের কল্যাণে। আমি তাদের মঞ্চে ডাকতে চাই। লোভে চোখ চিকচিক করে ওঠে সৌজন্য তিয়াসার।

কিন্তু এ কাদের নাম বলছে ভূমিকা! অর্পণ রায়, দিব্যা রায়(সাজির বাবা মা) ও সাজি। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তাদের। মঞ্চ আলো করে ভূমিকা ও সাজিরা।
‘শুধু রক্তের সম্পর্কে কিছু হয় না, আত্মিক সম্পর্কটাই আসল। আজ এই তিন জনের ভালোবাসা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এরাই আমার ছেলে, মেয়ে(বৌমা)ও নাতনী। সব মা বাবাকেই বলছি, অবশ্যই সন্তানকে সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করুন, কিন্তু নিজের জন্যেও সময় রাখুন, নিজের ভবিষ্যতের কথাও একটু ভাবুন, তা না হলে সন্তান যদি পেশাগত সফল হয় কিন্তু প্রকৃত মানুষ না হয় বাবা মা পরবর্তী তে বড় অসহায় হয়ে যায়। যেমনটা আমি হয়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভালো আমি সত্যি করে প্রকৃত মানুষ সন্তানকে কাছে পেয়েছি। নাই বা হলাম তার গর্ভধারণী তবু সে, তারা আমার জীবনের চলার পথের আলো। আমি যখন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলাম ঈশ্বর এই আলো আমায় পাইয়ে দেন। হ্যাঁ, সবাই নিজের আত্মপরিচয় গড়ে তুলুক। আবার বলছি, বাবা মায়েরা সন্তানের সাথে সাথে নিজের ভবিষ্যতের কথাও একটু ভাবুন। হারিয়ে যেতে দেবেন না নিজের প্রতিভা। সারাদিনে একটু সময় নিজের জন্যেও রাখুন। একটু হলেও নিজের কথা ভাবুন। সবাই খুব খুব ভাল থাকুন। সারা প্রেক্ষাগৃহ হাততালিতে ভরে উঠলো।

Loading

One thought on “গল্প- ভূমিকার ভুমিকায়

Leave A Comment