মিসক্যারেজ
–লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
আরে বাবা আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে বলে ছিল ফার্স্ট আওয়ারে আসতে। বাড়িতেই সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
ওগো শুনছো, তাড়াতাড়ি একবার এসে আমার আধার কার্ডটা দিয়ে যাও।
রান্নাঘর থেকে উচ্চ স্বরে আওয়াজ এলো, আমার হাত জোড়া। খাটের গদির নিচে আলমারির চাবির গোছাটা আছে। তুমি আমার আলমারিটা খুললেই দেখতে পাবে একটা টিনের চকোলেটের বাক্স আছে। ওর মধ্যেই রাখা আছে তোমার আমার আধার কার্ডগুলো।
শম্ভু বাবু অগত্যা গদির নিচ থেকে চাবির গোছাটা বের করে সহধর্মিনীর আলামারিটা খুলল। খুলেই তো অবাক। ফিসফিস করে বলে উঠল, এতো শাড়ি! এরাই যা গাদাগাদি ঠেসাঠেসি করে রয়েছে সেখানে কি আর আমার প্যান্ট জামারা জায়গা পায়!
দুজনের দু’টো আলাদা আলমারি না হলে কি চলে সুরভীর। যাক গে এবার দেখি চকলেটের বাক্স কোথায়?
একটু এদিক ওদিক উঁকি মারতেই একদম নীচের থাকে দেখতে পেল বাক্সটা। এটা তো ভ্রমরের পাঁচ বছরের জন্মদিনের চকলেটের বাক্স। কোনো জিনিসটা ফেলতে মন চায় না সুরভীর। নিজের মনেই হাসতে হাসতে বলল কথাগুলো শম্ভু বাবু।
বাক্সটা খুলতেই দেখে বেশ কিছু পুরানো পোস্ট কার্ড, এনভেলব, ইনল্যান্ড লেটার রয়েছে। তারই মধ্যে উঁকি মারছে আধার কার্ডগুলো। নিজের আধার কার্ডটা পকেটে পুরে বাক্সটা বন্ধ করতে যাবে হঠাৎ একটা চেনা হাতের লেখা কাগজ দেখতে পেয়ে থমকে গেল।
বাক্সের একদম নিচের দিকে রয়েছে ভাঁজ করা কাগজটা। কাগজটা হাতে নিয়ে কৌতুহলবশত ভাঁজগুলো খুলে ফেলল।
বেশ বড় বড় হরফে স্পট হাতের লেখায় লিখেছিল চিঠিটা মৃদুলা। মৃদুলা হচ্ছে শম্ভু বাবুর একমাত্র বোন।
সম্বোধন করেছিল এইভাবে,
প্রিয় বৌদি,
জানি না তুমি বেঁচে ফিরে আসবে কিনা? কিন্তু সত্যি বলছি তোমাকে ছাড়া আমি অচল। যেদিন শাঁখা পলা খুইয়ে সাদা শাড়ি পরে আবার ফিরে এলাম বাপের বাড়িতে। সেদিন তুমি অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে মা’কে বলেছিল, মা মৃদুলাকে রঙিন শাড়িটা পরতে দিই। ওর এই বিবর্ণ চেহারা যে আমি সহ্য করতে পারছি না।
মা বরং বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তোমার যত অনাসৃষ্টি কথাবার্তা বৌমা। এই সদ্য বিধবা হয়েছে মৃদুলা। এর মধ্যেই রঙিন শাড়ির কথা ভাবছো! বলি সমাজ সংসারের কথা তো একটু ভাববে। ওর শ্বশুর বাড়িতে জানতে পারলে কি ভাববে!
সেদিন তুমি বলেছিলে, মৃদুলা আর শ্বশুরবাড়ি ফিরবে না। যে মানুষটার জন্য শ্বশুরবাড়িতে থাকতে যাওয়া। সেই মানুষটাই যখন রইল না তখন কিসের আশায় ওমন শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকা।
মা দাঁত খিঁচিয়ে বলে ছিল, মৃদুলার মেয়ে তো আর বানের জলে ভেসে আসে নি। বারোমাস মামা বাড়িতে থাকলে ঠাকুমা দাদুর কাছ থেকে আর কিছু পাবে ভ্রমর দিদিভাই?
তখন দাদা যদিও বলেছিল, মৃদুলার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা খুব যে স্বচ্ছল তা তো নয়। রোজগার তো করতো আমাদের জামাই তুফান। সেই যখন রইল না তখন আর ওখানে পড়ে থেকে কাজ নেই বোনের।
দাদার কথা মায়ের পছন্দ না হলেও মুখে আর কিচ্ছুটি বলে নি সেদিন। আমার ভ্রমরের সব দায়িত্ব তোমরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিলে।
স্বামী শোকে কাতর হয়ে আমি প্রায় বিছানা নিয়েছিলাম। আমার যে একটা দু’ বছরের ছোট্ট মেয়ে আছে তা প্রায় ভুলতেই বসে ছিলাম।
তুমি আমার মেয়েকে স্নেহ আর যত্ন দিয়ে আগলে রাখতে সারাক্ষণ। কিন্তু সেই আমিই আজ তোমার চরম ক্ষতি করে দিলাম।
সত্যি বলছি বৌদি তোমার প্রাণনাশের চেষ্টা আমি বিন্দুমাত্র করিনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমার পেটের সন্তানটা যেন না থাকে। কি সাংঘাতিক স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম সেই মুহূর্তে। নিজের সুখের প্রতি এত লোভ আমার। ছিঃ ছিঃ। এই রকম একটা নীচ কাজ আমি করে ফেললাম। আমার যে নরকেও স্থান হবে না। ভগবান যে আমাকেও দগ্ধে দগ্ধে মারবেন।
চিঠিটা পড়তে পড়তে শম্ভু বাবু রাগে কাঁপতে শুরু করেছেন। মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠছে। মনে হচ্ছে এখুনি ছুটে গিয়ে মৃদুলাকে ঘর থেকে টেনে বের করে দেওয়া উচিত। নিজের মনে মনে বলে উঠলেন, দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষলাম শেষ পর্যন্ত।
চিঠিটা এখনও শেষ হয় নি। রয়েছে আরো কয়েকটা লাইন। কিন্তু বাকি লাইন কটা পড়ার মতো ধৈর্য আর শম্ভু বাবুর নেই। উনি চিৎকার করে ডাকলেন সুরভীকে।
স্বামীর হঠাৎ এমন তীব্র চেঁচানি শুনে সুরভী তো বেশ ভয় পেয়ে গেল। হাতের কাজ ফেলে, কোনো রকমে রান্নাঘরটা ভেজিয়ে পড়ি কি মরি করে ছুটে এলো নিজেদের রুমে।
সুরভীকে আসতে দেখেই শম্ভু বাবু চিঠিটা দেখিয়ে বলে, এটা কি গিন্নি?
চিঠিটা দেখে সুরভীর গলা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। মনে মনে বলে, সর্বনাশ। আমার এত বছরের লুকিয়ে রাখা চিঠিটা ওর হাতেই পড়ল। হে ভগবান এখন কি করে মানুষটাকে সামাল দেবো আমি।
সুরভীকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার ধমকে উঠলেন শম্ভু বাবু, চিঠিটা নাচিয়ে বললেন, এটার মানে কি?
সুরভী ছুটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো। তারপর অনুনয়ের সুরে বলে, প্লিজ লক্ষ্মীটি একটু কম চিৎকার চেঁচামেচি করো। ঠাকুরঝি পূজোতে বসেছে।
-খুনী, আসামী, ভন্ডদের পূজো ভগবান গ্ৰহন করে না। এটা নিঃশ্চয় তুমি জানো।
সুরভী শম্ভ বাবুর হাত থেকে খপ করে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে বলে, এই চিঠিতে ঠাকুরঝি যা লিখেছে তা কিন্তু ষোলো বছর আগের ওর স্বীকারোক্তি। ও তো ওর নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত।সেই অনুতাপ থেকেই চিঠিটা লিখেছিল সেদিন ও ভগবানের কাছে।
-তোমাকে কি চিঠিটা মৃদুলা নিজ হাতে দিয়েছিল?
-না গো না। আমি নার্সিংহোম থেকে ফিরে আসার মাস খানেক পর কিছুটা সুস্থ হয়ে যখন ঠাকুর ঘরে যাই। তখন ঠাকুরের সিংহাসনের কাপড়টা পাল্টাবো ভেবে ওটা তুলতে গিয়ে দেখি হলুদ কাপড়ের নিচে রয়েছে একটা ভাঁজ করা কাগজ। চিঠিটা পড়ে সেদিন আমিও চমকে উঠে ছিলাম।
আর সব থেকে আশ্চর্য হয়ে ছিলাম যে মৃদুলা ইচ্ছে করে বাথরুমে সাবান জল ফেলে রেখেছিল। যাতে আমি পা পিছলে পড়ে যেতে পারি।
শম্ভু বাবু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আজও চোখের সামনে তোমার অসহায় মুখটা ফুটে ওঠে আমার মাঝে মধ্যেই। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলে তুমি তখন। বাথরুমের মধ্যে এমন ভাবে পড়ে গিয়েছিল যে দেওয়ালের কিনারায় লেগে কপালটা ফেটে গিয়েছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বাথরুমের সাদা মার্বেলগুলো । হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতেই তুমি পথেই জ্ঞান হারালে। আমি সমানে তোমার চোখে মুখে জলের ছিটা মারছিলাম। কিন্তু তোমার জ্ঞান ফিরে আসেনি তখন। নার্সিংহোম-এ পৌঁছানো মাত্রই ডাক্তার তোমাকে ও.টি-তে নিয়ে যেতে বলল। ঘন্টা দেড়েক পরে ডাক্তার বাবু বিষন্ন মুখে জানালেন, ‘মা কে বাঁচাতে পারলেও বেবিকে পারলাম না এবং পরবর্তীতে ম্যাডাম প্রেগন্যান্ট হতে গেলে বেশ কিছু কমপ্লিকেশন দেখাও দিতে পারে। আই মিন মিস ক্যারেজ হতেও পারে ।’
সেদিন আমার মতো শক্ত পুরুষ মানুষের চোখও জলে ভরে উঠেছিল।মাও খবরটা শুনে দুঃখ পেয়েছিল খুব। তবুও মা সেদিন তোমাকেই দুষে ছিল।মা আক্ষেপ করে বলেছিল, বৌমার তো সবেতেই অনাসৃষ্টি কান্ড কারখানা। মৃদুলাকে সাদা শাড়ি পরতে দিল না কোনোদিন। একাদশী করতে দিল না একদিনও। মাছ মাংস ডিম সব খাওয়ানো চাই বিধবা ননদকে। এত অনাচার করলে কি আর ধর্মে সয়। ভগবান একদম টের পাইয়ে দিল। মিসক্যারেজ হয়ে গেল।
শম্ভু বাবু সুরভীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যখন এই চিঠিটা পেলে তখন আমাকে কিচ্ছুটি কেন জানালে না?
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরভী বলল, যাকে ভগবান সব দিক থেকে মেরে রেখেছে। তাকে আর নতুন করে কি শাস্তি দেবে মানুষ। যে ছোট্ট শিশুটা পৃথিবীর আলো দেখতেই পেল না। তার জন্য দুঃখ করে মনের কষ্ট বাড়িয়ে কি লাভ হতো। বরং ভগবান যখন ভ্রমরের মতো একটা ফুটফুটে মেয়ের দায়িত্ব আমাদেরকে দিয়েছে তখন ওকেই মন প্রাণ দিয়ে লালন পালন করা ভালো নয় কি?
চিঠির শেষ লাইনগুলো নিঃশ্চয় তুমি পড়োনি। পড়লে আর ঠাকুরঝির শাস্তির কথা ভাবতে না।
ঠাকুরঝি লিখেছিল, বৌদি আমি যখন শুনলাম তুমি মা হতে চলেছো তখন আমার মনে একটা ভয় তৈরি হলো। এই ভয়টা ছিল আমার মেয়ে ভ্রমরকে নিয়ে। দুবছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে মামা বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার পর থেকেই ও তোমাদের চোখের মণি হয়ে উঠেছে। দাদা তো অফিস থেকে ফেরার পথে ভ্রমরের জন্য কিছু না কিছু আনবেই রোজ। আর তুমি তো ভ্রমরের যশোদা মা। আমার থেকে বেশি ও তোমার কাছে আবদার করে।
সেইখানে আর একটা বাচ্চা এলে আমার মেয়ের আদর যে কমে যাবে। তোমাদের ভালোবাসাও কমে যাবে ধীরে ধীরে। এইসব ফালতু কথা ভাবতে ভাবতে আমার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়। আর এই কান্ড জ্ঞানহীন, অনৈতিক কাজটা করে ফেলেছি বৌদি তোমার সাথে। প্লিজ ভগবান আমাকে ক্ষমা করে দিও। বৌদির সামনে গিয়ে এইসব কথাগুলো বলার সৎ সাহস আমার নেই। তাই তোমাকেই লিখে জানালাম সব কথা।
শম্ভু বাবুও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি ভাবতেই পারছি না আমার নিজের বোন আমাদের সঙ্গে এমন কাজ করল!
সুরভী শম্ভু বাবুর গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, মন খারাপ করো না। আমাদের নিজেদের সন্তান না হলেও ভ্রমর কিন্তু আমাদের সন্তানেরও বেশি।এতো বাধ্য, বিনয়ী মেয়ে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।
নাও আর দেরি করো না। ভ্রমর টিউশনি থেকে সোজা ব্যাঙ্কে চলে যাবে বলেছে। মেয়েটার আজ প্রথম ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে। খুব আনন্দ ওর।
পর মুহূর্তেই শম্ভু বাবুকে অনুরোধের স্বরে সুরভী বলে, প্লীজ ঠাকুরঝি’র এই স্বীকারোক্তির কথা তুমি আমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যাক্তি কেউ না জানে। এত বছরের পুরানো কথা আর খুঁচিয়ে ঘা করার দরকার নেই।
শম্ভু বাবু হালকা দু’চোখ বন্ধ করে স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিলেন, ঠিক আছে। তাই হবে। ক্ষমার চেয়ে বড় ধর্ম আর কিছু নেই যে সংসারে।