রাতের কালো
-উজ্জ্বল দাস
কলকাতায় একটা চায়ের কোম্পানিতে কাজ করার সূত্রে রোজ ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরোতে হয়, ফিরতে ফিরতেও প্রায় রাত নটা। এভাবেই অভ্যস্ত মসলন্দপুর স্টেশন অন্তর্গত রসুই গ্রাম নিবাসী শম্ভুনাথ মন্ডল। হেসে খেলেই দিন গুজরান এককথায়।
কোনো এক হেমন্তের সকালে শিরশিরানি হাওয়ায় বেশ ফুরফুরে মনেই পৌঁছে ছিলেন অফিস। কাজকম্ম সেরে সারাদিন পর যখন বাড়ির পথে রওয়ানা হলেন তখন সন্ধে। ভিড় বাসের হাতল ধরে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে তো ওনার চোখ কপালে উঠেছে। থিকথিক করছে কালো মাথা। ট্রেন অবরোধ। সারাদিন অফিস সামলে, ফেরার সময় এ যে মহা বিপদ। কিন্তু উপায় নেই। এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। খাবারও নেই। সাকুল্যে সঙ্গে রয়েছে আধ বোতল জল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন শম্ভুনাথবাবু। এদিকে অবরোধ উঠে ট্রেন কখন চালু হবে তার বিন্দুমাত্র আভাস নেই এই জনারণ্যে। শিয়ালদহ থেকে মসলন্দপুর প্রায় দেড় ঘন্টার জার্নি। অগত্যা ট্রেনের অপেক্ষাই ভরসা।
একটা পিলারের গায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শম্ভুনাথবাবু চোখ দুটো বুজে সবে হালকা ঝিমিয়ে নিচ্ছিলেন। হঠাৎই যেন কানে এলো ট্রেনের নাম ঘোষণা হচ্ছে মাইকে। একটু আশার আলো দেখলেন শম্ভুনাথবাবু। ক্লান্ত শরীরটাকে টানতে টানতে ঘোষণা মতো এগিয়ে চললেন প্লাটফর্মের দিকে। আর যাই হোক অন্য দিনের মতন নিশ্চয়ই ট্রেনটা একটু আধটু ফাঁকা থাকবে এ আশা করা বিলাসিতা। এদিকে ঘড়ি বলছে প্রায় পৌনে বারোটা।
ভিড় ঠেলে কোনও রকমে এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালেন একটা কম্পার্টমেন্টে। গাদাগাদি লোকারণ্যের মাঝখানে শম্ভুনাথবাবু ট্রেনে যে উঠতে পেরেছেন এটাই ওনার কাছে বড় অংকের লটারি। এরপর একের পর এক স্টেশন আসছে আর গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে বহু নিত্যযাত্রী। এইভাবে একটা সময় ঘড়ির দিকে তাকালেন রাত একটা কুড়ি। মসলন্দপুর নামতে আরও কুড়ি পঁচিশ মিনিট তো বটেই।
শুনসান মসলন্দপুর স্টেশনে নেমে দেখলেন হাতেগোনা পনেরো কুড়ি জন কিংবা তারও কম। সারাদিন ভাগ্য পরিহাস করলেও মাঝরাতে যেন কপাল খুলে গেল। গোটা পাঁচেক সাইকেল ভ্যান শেষ গাড়ির প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাবার জন্য লাইনের ধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। তার মধ্যেই একটা ভ্যান রিক্সায় চেপে বসলেন শম্ভুবাবু।
ক্লান্ত বিষণ্ণ মনে ঘুটঘুটে অন্ধকারে গিয়ে নামলেন চারঘাট। এখান থেকে রসুই গ্রাম প্রায় মিনিট চল্লিশ হাঁটা পথ। শুরু করলেন হাঁটা। কোথাও আল পথ তো কোথাও মোরামের লাল রাস্তা। হঠাৎই দেখলেন বড় ঝিলপাড় চলে এসেছে সেখান থেকে বাড়ি হাতেগোনা মিনিট সাতেক। হনহনিয়ে পা চালালেন। একটু এগোতেই সামনে দেখলেন মেজো শালা পরেশ দাঁত বের করে এগিয়ে এসেছে।
-আরে, জামাইবাবু যে? এত রাতে!
-এই অফিস থেকে ফিরছি। আর বোলো না। প্রাণে যে বেঁচে আছি এই অনেক।
-কেন কেন?
-সারা কলকাতা স্তব্ধ। কথায় কথায় এরা ট্রেন অবরোধ করবে।
-ইসসস, কী ভোগান্তি…
-তারপরে তুমি এখন এত রাতে! কি করছো?
এক গাল হেসে উত্তর পরেশের- আরে জামাইবাবু আপনি দেখছি সবই ভুলে যান।
-হ্যাঁ সত্যিই, আমার আজকে আর মাথার কোন ঠিক নেই কথাটা বলে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন…
হঠাৎই যেন শম্ভুনাথ বাবুর ঘোর কাটলো। মনে পড়ে গেল গোটা গ্রাম যখন কলেরা রোগে উজাড় হয়ে যাচ্ছিল পরেশও তখন বাদ পড়েনি। দেড় মাস আগে মারা যায় পরেশ।
তাহলে এতক্ষণ…
সাহসে ভর করে একবার পেছনে তাকালেন শম্ভুবাবু। নিকষ কালো অন্ধকার আর ঝিঁঝিঁ পোকারা কানে তালা লাগিয়ে গিলতে আসছে। দমকা একটা ঠান্ডা হাওয়া কানের গোড়ায় এসে সজোরে ধাক্কা মারলো, দেখতে পেলেন না কাউকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।