ট্র্যাজেডি রিটার্নস
-পায়েল সাহু
ভারত বিখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রদীপ্ত সান্যাল একসময় দেশে বিদেশে ছুটে বেরিয়েছেন ইতিহাসের রসদ যোগানের সন্ধানে। জুওলজিক্যাল সার্ভের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন নিয়মিত। তাঁর লেখা বই আজ বিভিন্ন স্কুলের পাঠ্যপুস্তক। যদিও তা নিয়ে তাঁর তেমন গর্ব নেই, একেবারেই মাটির মানুষ এই প্রদীপ্ত সান্যাল।
তবে এখন বয়স হয়ে গেছে, নানারকম রোগে জর্জরিত থাকেন তাই তাঁর স্ত্রী কিছুতেই তাঁকে আর একা কোথাও ছাড়েন না। প্রদীপ্তবাবুও মেনে নিয়েছেন তবে ঘরে বসেই পড়ে চলেন বিভিন্ন জার্নাল।
কিছুদিন যাবৎ পুরোনো কলকাতার ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে এমন এমন তথ্য পেয়েছেন তাতে তিনি কিছুতেই নিজেকে আর ঘরে বন্দী করে রাখতে পারছেন না। রাতের ঘুম উড়ে গেছে পুরোনো অভ্যাসে। মনে মনে প্ল্যান করে চলেছেন কি বলে বাড়ি থেকে বেরোবেন কারণ সত্যি কথা বললে তিনি কখনোই অনুমতি পাবেন না।
অবশেষে ডাক্তারের appointment এর নাম করে বেরিয়েই পড়লেন একদিন।
উদ্দেশ্য ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন অঞ্চল তবে এখনকার জনবহুল অঞ্চলে তিনি কতটা আবিষ্কার করতে পারবেন তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা তাঁর।
কিছুটা ঘোরাঘুরির পর প্রয়োজনীয় তথ্য তেমন না পেয়ে অবশেষে ঢুকে পড়লেন পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে, তখন প্রায় বিকেল।
এখানেই তার শেষ আশা, যদি কিছু প্রমাণ পান।
সিমেট্রি এমনিতে ফাঁকাই তবে এই শেষ বিকেলে কেমন যেন গা ছমছমে। দিনের আলো এখনও রয়েছে তবু কিছুটা অস্বস্তির অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে চললেন ভেতরের দিকে।
আচমকাই চোখে পড়ে এক অতি বৃদ্ধ জরাজীর্ণ মানুষ বসে আছে একটি সমাধির সামনে। মানুষটির পোশাক একদম ইংরেজ সাহেবদের মতো, প্রদীপ্ত বাবুর মনে হলো ইনি বোধহয় কোনো ব্যান্ড পার্টির লোক, আর সেই uniform-এ চলে এসেছেন প্রিয়জনকে শ্রদ্ধা জানাতে। মানুষটির সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছায় প্রদীপ্ত বাবু এগিয়ে যান তার দিকে।
“এই যে শুনছেন? আপনি কি ব্যান্ডপার্টির বাজনাদার? একমাত্র ওই ব্যান্ডপার্টিগুলোই এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে ইংরেজ আমলের এই পোশাক” সহাস্য মুখে কথাগুলো বলতেই কবরের ওপরে বসে থাকা ঘোলাটে দৃষ্টির মানুষটি বলতে থাকেন “১৫ই জুন, ১৭৫৬ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নবাব সিরাজের সৈন্য। টানা পাঁচ দিন যুদ্ধের পর অধিকাংশ ইংরেজ সৈন্য পালিয়ে যায় আর বাকিরা আত্মসমর্পণ করি, আমাদের সকলকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ২০শে জুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভিতর ১৫ ফুট বাই ১৮ ফুটের একটি ঘরে একসাথে আটকে রাখা হয়। পরদিন ২১শে জুন নবাবের আদেশে যখন কয়েদঘরের দরজা খোলা হয় তখন ১৪৩ জনের মধ্যে মাত্র ২৩ জন বেঁচে ফিরেছিলাম, বাকিরা শোচনীয়ভাবে মারা গেছিলো দমবন্ধ হয়ে, মানুষের ভারে, ঘাম, বমি আর মলমূত্রের গন্ধে নরক হয়ে ওঠা পরিবেশে। সেই ঘর থেকে বেঁচে ফিরেছিলাম, লিখে গেছিলাম সেই কুখ্যাত ‘ব্ল্যাকহোল ট্রাজেডি’।
অবাক হয়ে শুনে প্রদীপ্ত সান্যাল বুঝতে পারেন লোকটির মাথার গন্ডগোল আছে কারণ তিনশো বছরের বেশি সময় আগের কথা বলছেন, তিনি যদি সেই লোক হন তাহলে তো তাঁর বেঁচে থাকাই উচিৎ নয়, কিছু না বলে আস্তে আস্তে উঠে পিছন ফিরে চলে আসতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে হতে কবরের ওপরের নামের ফলকটা দেখতে যেতেই দেখেন জ্বলজ্বল করছে Jhon Hallowell এর নাম, যেন এই মাত্র বসানো হয়েছে ফলকটা।
বেশ ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি পা চালাতেই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যান মাটিতে, আর সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করেন তার ওপর যেন প্রচুর মানুষের শরীর, বহু চেষ্টা করেও কিছুতেই যেন সরাতে পারেননা, চারপাশে যেন প্রচুর ভিড়, দুর্গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ, ক্রমশ চাপ বাড়তে থাকে তাঁর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শরীরটার ওপর।
শুধু কোনোমতে ঘাড় কাত করে দেখতে পান সামনে দাঁড়ানো সেই বৃদ্ধ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
সমস্ত শক্তি দিয়ে তার ওপর ভর দিয়ে থাকা ছায়াশরীরগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ করতে করতে একসময় নিস্প্রাণ হয়ে পড়ে প্রদীপ্ত বাবুর দেহ।
পরদিন সকালে সারা শহর চমকে ওঠে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রদীপ্ত সান্যালের মৃত্যুর খবরে।
“ইতিহাসবিদ প্রদীপ্ত সান্যালের অস্বাভাবিক মৃত্যু। পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির কাছে তাঁর মৃতদেহটি পাওয়া যায়, তাঁর মৃত্যু হয়েছে দমবন্ধ হয়ে। শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন না থাকলেও তাঁর পাঁজর, কোমর এবং পায়ের হাড় ভাঙা ছিলো।”
(ঐতিহাসিক ঘটনার দিন তারিখগুলি সংগৃহীত)