চন্দ্রপ্রভা
-সুব্রত হালদার
ছেলেটা সেই উড়িষ্যা বর্ডার, হাতিবাড়ি থেকে উঠেছে। কোথায় নামবে তা কে জানে। কখন থেকে ভাড়া চাইছি। প্রত্যেকবারই নির্বিকারে তার দিকে তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যাবতীয় প্রকৃতিপ্রেম কি বাসে উঠে চাগাড় দেয়। তার কথায় কোন আমলই দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে ছেলেটার ভাবগতিক ঠিক নেই। ভাড়া মেরে দেবার ধান্ধা কি না বোঝা যাচ্ছে না। বাচ্চা ছেলে। তেরো থেকে পনেরোর মধ্যে হবে। একবার জিজ্ঞেস করেছে, তার সঙ্গে আর কেউ আছে কি না। ডাঁয়ে বাঁয়ে দু’দিকে বড় করে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছে তার সঙ্গে কেউ নেই। তাদের বাসটা যাবে সেই ঝাড়গ্রাম। পঁচাত্তর টাকা ভাড়া। অত টাকা মাগনা ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি ! ওই সিটে অন্য কেউ বসলে তো পুরো ভাড়া পাওয়া যায়। তার উপর ছেলেটা তাকে কিছু বলছে না। ছেলেটাকে নিয়ে কি করবে ভেবে উঠে পারছে না। ইতিমধ্যে বেশ ভিড় হয়ে গেছে বাসে। তা সামলাতে বেশ হিমসিম খেতে হচ্ছে তাকে। একজন অপোক্ত প্যাসেঞ্জারের জন্যে ভিড়ে কাজ করতে তাকে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। চোখ গেল সেই ছেলেটার দিকে, “এই ছেলেটা, তুই কোথায় যাবি, কখন থেকে জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছিস না। ভাড়া দে, ভাড়া দে !” মনে হচ্ছে এ ছোঁড়ার কাছে পয়সা নেই। তাই পকেটে হাত ঢুকছে না। বরং ওকে তুলে এই দুর্বল মানুষটাকে ওই সিটে বসালে তার সুবিধা হবে। এবার শক্ত হল কন্ডাক্টর, “এই খোকা, ওঠ সিট থেকে। ওঠ ওঠ ! আর এক মুহূর্ত তোকে সিটে বসতে দেব না। ওঠ।” তারপর অসুস্থ ভদ্রলোককে বলল, “দাদা, আপনি ওই সিটে গিয়ে বসুন।” পরিস্থিতি যে তার অনুকুলে নেই সেটা বুঝতে পারে বাবুল। কোন বিরূপতায় না গিয়ে সিট থেকে উঠে গেটের কাছে চলে আসে। কন্ডাক্টর আবার তাকে ভাড়া চাইলে চুপ করে থাকে। একটা সময় গাড়ি এসে থামে বেলপাহাড়ি পেরিয়ে বেশ খানিকটা দূরে শিলদা হাইরোডের মোড়ে। তখনই কন্ডাক্টর বাবুলের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “এই ছেলে, তোর কাছে ভাড়া নেই তো? জানিস না, ভাড়া না দিয়ে বাসে চড়া যায় না? যা, নেমে যা। সারা দিন তোদের মত কয়েকজনকে যদি মাগনা বাসে চড়তে দিতে হয় তো মালিক ফেল হয়ে যাবে। মালিক ফেল হলে আমারও চাকরি থাকবে না। তোর মত বেয়াড়াদের জন্যে আমি কাজ খোয়াতে যাবো কেন?” বলে কন্ডাক্টর ছেলেটার ডানা ধরে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। এতে বাবুল কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সেইসময় বাস থেকে নামছিল এক ভদ্রমহিলা। এই ঘটনার সবটাই সে পরখ করে ছেলেটার প্রতি দয়াপরবশ হল, “এই ছেলে, তোর কাছে পয়সা নেই ? কোথায় যাবি তুই ? বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস নাকি? পড়াশোনা করিস?” উত্তরে বাবুল বলল, “ক্লাস এইটে।”
-মানে বাবা-মার বকাবকি খেয়ে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিস। তাই তো ? বাচ্চারা ভুল করলে বড়রা তো শাসন করবে। তাই বলে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে কেউ ? যা। মাথা গরম না করে বাড়ি যা। কোথায় বাড়ি তোর ?
-হাতিবাড়ি।
-সে তো অনেক দূর রে ! সেই গোপিবলস্নভপুর পেরিয়ে আরও কত দূর ! তোর মনে বাড়ির প্রতি এত রাগ যে এই বয়সে কোন ভয়ডর না পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস ! তারপর নিজের ব্যাগ থেকে ছোট্ট মানিব্যাগটা বার করে সেখান থেকে টাকা বার করে বলল, এই নে, এই টাকাটা রাখ। পরোটা দোকানে কিছু টিফিন করে ফিরতি বাসে বাড়ি ফিরে যা। এই টাকায় তোর গাড়ি ভাড়া হয়ে যাবে। বলে ভদ্রমহিলা নিজের কাজে চলে যায়।
দিদিটা তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলল বটে কিন্তু সে কিসের টানে বাড়ি ফিরবে? মা তো তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। বলল, “যে ছেলে তার বাবাকে মারধর করে সে ছেলে কুলাঙ্গার। সে ছেলে বাড়িতে থাকার থেকে না থাকাই ভাল।” অথচ মা খুব ভাল করে জানে কেন সে বাবার গায়ে হাত তুলেছে। তবু মা তার সঙ্গে না গিয়ে বাবার হয়ে কথা বলল আর তার সঙ্গে এমন খারাপ আচরণ করল। মা তার সন্তানকে কাছে টেনে না নিয়ে মাতাল বরের হয়ে কথা বলল। তাকে দূরে যখন ঠেলে দিল তখন সে কেমন করে বাড়িমুখো হবে ? কোনদিন সে আর বাড়ির ও-মুখ হবে না। তাতে তার যা হয় হবে।
সেই ভোর-রাতে সে বাড়ি ছেড়েছে। এতটা বেলা হয়ে গেল। পেটে কিছু পড়েনি। খিদেও পেয়েছে। দিদিটা যে টাকা দিয়েছে হাত দিয়ে পকেটে চেপে নিশ্চিত হয়ে একটা পেটাাই পরোটার দোকাছে ঢুকে জানলো এক’শ গ্রাম পরোটার দাম দশ টাকা। এই পরোটা খেলে পরে পেটে গিয়ে তা ফোলে, মানে পেটটা ভরাট হয়ে যায়। অনেকক্ষণ আর খিদে লাগে না।
এবার বাসটায় উঠে বসার জায়গা থাকলেও বসল না বাবুল। সিটের সামনে হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কন্ডাক্টর বসতে বলেছে কয়েকবার। তার কথা সে কানে নেয়নি। সে তো জানে বাসের ভাড়া দিতে পারবে না। তাই মাগনা সে সিট দখল করবে না। খানিক পরেই ফাঁকা সিটগুলো ভরে গেল। মনে মনে আশ্বস্ত হল, এবার আর কন্ডাক্টর বলতে পারবে না ভাড়া না দিয়ে সিট দখল করে আছে। তবু ভাড়া না দিয়ে যে বাসেই চড়া যায় না তা সে জানে। কন্ডাক্টর তাকে যেখানে সেখানে নামিয়ে দিতে পারে। ভাবতে ভাবতেই তার কাছে ভাড়ার তাগিদ এসে গেল। তার কাছে থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে কন্ডাক্টর অন্যদিকের কাজ সেরে এসে আবার চাইল। তখন বাবুল বলল, “আমার কাছে পয়সা নেই।”
-কোথায় যাবি ?
-ঝাড়গ্রাম।
-ঝাড়গ্রাম অনকটা রাস্তা। ভাড়াও অনেক। এতটা রাস্তা মুফতে আমি তোকে নিয়ে যেতে পারবো না। সত্যি কি তোর কাছে পয়সা নেই? দেখি তোর পকেট ! বলে প্যান্টের উপর চাপ দিয়ে দেখতে দেখতে বলে, এই তো পকেটে টাকা আছে খুচরো পয়সা ঝনঝন করছে। দে গাড়ি ভাড়া ?
-না, ওই ক’টা টাকা আমার আছে। শিলদায় এক দিদি আমাকে দিয়েছে। ওটা দিলে আমার আর খাওয়া হবে না। ওটা আমি দিতে পারবো না। বলে পকেটের যে অংশে টাকা ক’টা আছে সেখানে মুঠো মেরে ধরে রাখল বেপরোয়া বাবুল।
-ভাড়া যখন তুই দিতে পারবি না তখন আমিও তোকে বাসে চড়তে দিতে পারবো না। একটু বড় তো হয়েছিস। চোদ্দ-পনেরো হবে। পকেটে পয়সা যখন নেই খেটে খেতে পারিস না। গতর খাটালে পয়সার অভাব হয়? না লোকের মুখ-ঝাপটা খেতে হয়! এক্ষুণি নেমে যা তুই। এই লোধাশুলি মোড় এসে গেছে। নাম-নাম-নাম? গাড়ী তোর জন্যে কতক্ষণ দাঁড়াবে, নাম ?
বাস থেকে নেমে খানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল বাবুল। কোনদিকে যাবে বা কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। চার মাথার মোড়ের বাঁদিকের রাস্তা ধরে বাজার পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে যেতে যেতে বাজার শেষ হয়ে গেল। এরপর রাস্তার দুপাশে গাছগাছালি আর তার ফাঁকে মাঝে মাঝে লোকের ছোটবড় কাঁচা পাকা বাড়ি। অট্টালিকাও উঁকি মারতে দেখে সেই গাছপালার ভেতর থেকে। সামনে প্রশস্ত রাস্তা জঙ্গল পেরিয়ে দিগন্তে মুখ লুকিয়েছে। আর এগিয়ে কি বা হবে। ফিরে আসে জমজমাট দোকান-বাজার এলাকায়। একটা চা-দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে এসে বসে। খানিকক্ষণ বসে থাকার পর দোকানির চোখ যায় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা চা-বিস্কুট কিছু খাচ্ছে না আবার বেঞ্চ দখল করে বসে আছে। অর্ডারি খদ্দেররা বসতে পারছে না। গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে দোকানি বলল, “এই ছেলেটা তখন থেকে বসে আছিস। চা খাবি? না খেলে যারা খাবে তাদের বসতে দে।” শোনা মাত্র উঠে পড়ল সে। আবার উল্টো পথে বাজার ফুঁড়ে এগিয়ে চলল। এইদিকটা বাজার রাস্তার দু’ধার দিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ছোটবড় নানান সামগ্রীর দোকান। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এসেছে। ওর জানা জঙ্গল এলাকায় সূর্যমামার সতেজ বিকিরণ হঠাৎ নিভে সন্ধে নামার পথ করে দেয়। আবার ফিরে আসে চার মাথার মোড়ে। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই এদিকে প্যসেঞ্জার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে যদি কোন বাসে চড়ে ঝাড়গ্রাম চলে যাওয়া যায় তো শহরে একটা কোথাও মাথা লুকোতে পারে।
বাবুলের কপাল খারাপ, ঝাড়গ্রামে যাওয়ার কোন বাসই এল না। সন্ধে নেমে গেছে। খিদেও পেয়েছে। একটা চপ-ঘুঘনি-মুড়ির দোকানের সামনে এল। দোকানটায় বেশ ভিড়। ও লক্ষ্য করছে খদ্দেররা চপ-মুড়ি, ঘুঘনি মুড়ি বা মুড়ি আলুরদম কত দাম দিয়ে কিনছে। যেটা সবচেয়ে কম হবে সেটা ও কিনে খাবে। ঘুঘনি-মুড়িই সবচেয়ে কম, আট টাকা। দোকানদারকে বলল,“ঘুঘনি-মুড়ি দিন তো?” বলে অনেকক্ষণ হয়ে গেল সে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরের লোক এসে নিয়ে চলে যাচ্ছে দোকানদার তাকে আর দিচ্ছে না। দোকানদারটা একা লোক। ওদিকে আবার সে চা-ও বিক্রি করছে। সবদিকের খদ্দের ছাড়তে সে হিমসিম খাচ্ছে। তারপর খদ্দেরের খেয়ে যাওয়া এঁটো ডিশও তাকে ধুতে হচ্ছে। সেইজন্যে খদ্দেরও জমে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে এলাকায় এই দোকানের নাম আছে। নাহলে এতটা অপেক্ষা করে লোকে মাল কিনতো না। এবার একটু গালা বাড়িয়ে অনুরোধ করে বাবুল “আমারটা দিন না। খিদে পেয়েছে” বলাতে এবার দোকানদার ভদ্রলোকের দৃষ্টি তার দিকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে একবাটি মুড়ি-ঘুঘনি দিয়ে অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার কাছ থেকে পয়সাও নেবার যেন সময় যেন তার নেই। অথচ এই পয়সার জন্যেই তার দোকানদারি।
খাওয়া শেষ করে বাবুল তার এঁটো ডিশটা পড়ে থাকা অন্য ডিশের উপর রাখতে গিয়ে কেন যেন থমকে গেল! রাখল না সেখানে। কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে কি ভাবল কে জানে নিজেই নিজের ডিশটা ট্যাব কলের কাছে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে অন্য ধোয়া বাসনের সঙ্গে রেখে দিয়ে পকেটে হাত ঢোকালো খাবারের দাম দেবার জন্যে।
এত ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলেটার আচরণ দোকানি, পান্নালালের নজর এড়াল না। মনে তার খটকা লাগল! এত খরিদ্দার আসছে খাচ্ছে ঠকাস ঠকাস করে এঁটো বাটি-ডিশ রেখে হাতধুয়ে হাতজল ঠোঁটে মুখে বুলিয়ে দাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে। এ ছেলের মনে কি বোধ জেগে উঠল যে সকলের একদম উল্টো পথে হাঁটল! নিশ্চয়ই ছেলেটা অন্য ধাঁচের। আর মনে হচ্ছে এ এখানকার নয়। পরিযায়ী। বাচ্চাটার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে পয়সা নিতে গিয়েও না নিয়ে বলল, “দাঁড়া খোকা, তোর কাছ থেকে একটু পরে দাম নিচ্ছি। তোর তাড়া নেই তো? বাস তো বন্ধ হয়ে গেছে। কাছাকাছি কোথাও যাবি। এই ভিড়টা সামলে নিয়ে তোরটা নিচ্ছি।”
খানিক অপেক্ষা করে বাবুল উপযাচক হয়ে বলল, “বাবু, আমি এই এঁটো ডিশগুলো পরিষ্কার করে দেবো?” বলেই সে বাবুর অনুমতির অপেক্ষা না করেই ডিশগুলো পাঁজা মেরে নিয়ে কলধারে গিয়ে মাজামাজি করতে শুরম্ন করল। পান্নালাল এই অপরিচিত ছেলেটাকে বাধা দেবার সুযোগই পেল না। আবার ব্যস্ততায় তার কাছে গিয়ে কিছু বলা কওয়ার সময়ও এখন তার নেই। কাউন্টারে এখনো এতটা খদ্দেরের চাপ। মনে মনে ঠিকই করে নিল, ছেলেটার সঙ্গে পরে যা কথা বলার বলবে। ও এখন কিছু বাসন ধুয়ে তাকে যোগান দিলে বরং তার দোকানদারি করার সুবিধাই হবে। সে একটু দম নিয়ে কাজ করতে পারবে। হুড়োহুড়িতে কোন খদ্দের পয়সা মেরে দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। ভিড়ের সময় এমন কেস তো রোজই হয়। ছুটকোছাটকা কিছু বদ খদ্দের থাকে যারা এই ভিড়ের সুযোগটা নিয়ে খাবার খেয়ে পালিয়ে যায়। পয়সা মারার উদ্দেশ্য নিয়েই তারা আসে। ছেলেটা তার ভালই করল। এমন ছেলে তো সে কোনদিন দেখেনি ! এত বছর সে এই কারবার করছে। কোনদিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি সে হয়নি। একটু অবাকই হল পান্নালাল।
দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার হয়ে গেল। পান্নালালের বয়স প্রৌড়র সীমা পার হয়ে বার্ধক্যের পথে। আর বাবুল ভরা যৌবনে টৈটুম্বুর। মালিক আর বেশি খাটাখাটনি করতে পারে না বলে বাবুলের কাঁধে দোকান সামলানোর পুরো ভার। বাবুল ছাড়া একটা দিন দোকান চলে না। কাঁচামাল আনা থেকে মাল তৈরী করা খদ্দের সামলানো, সব দায়ভার তার উপর। সে নিজেই পান্নলালাকাকুকে খাটাখাটি করতে দেয় না। ক্যাশ সামলাবার দায়িত্ব দিয়ে মালিকের যথাযথ সম্মানের আসনে বসিয়ে রেখেছে। বাস্তবে নিজের বাবার থেকেও বেশি সম্মান এবং শ্রদ্ধার আসনে সে তার মণিবকে বসিয়ে রেখেছে। একটা দিনও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ঘটাবে বা কেন! এই মানুষটা তাকে সেদিন আশ্রয় না দিয়ে তার জীবন কোন দরিয়ায় ভেসে যেত তা কে জানে। মালিক যেমন জানতো না একটা উটকো ছেলেকে তার দোকানে ঠাঁই দেবে আর বাবুলও একটা আশ্রয়ের খোঁছে বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল। ঘটনাক্রম যেন কেমন করে দুই বিন্দুকে এক করে দিল।
কত অশান্তিকে গায়ে মেখে কেবলমাত্র পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মোহে সে দাঁতে দাঁত চেপে বাড়িতে টিকে ছিল। না হলে বাড়ির ওই পরিবেশে কোন সুস্থ মনের কেউই থাকতে পারে না। একটা ঝরঝরে সাইকেল ভ্যান টেনে সারাদিন বাবা যা রোজগার করে দিনের শেষে মদ-চুল্লু গিলে টলতে টলতে বাড়িতে আসে। ওই পর্যন্ত যদি হত তাহলে সমস্যা তেমন তীব্রতর ছিল না। কিন্তু বাড়ি এসেই মায়ের উপর হম্বিতম্বি, মারধোর, অকথ্যভাষায় গালাগালি। তার মা-ও যেন বাবার হাতে অকারণে মার খেয়ে খেয়ে মার-ঘ্যাঁচড় হয়ে গেছে। গালাগালি দেয় আবার ঘরেও ঢুকতে দেয়। খাবার মনমত না হলে থালা উল্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার করে দেয়। কাঁইমাই করে মা আবার সেগুলো কুড়িয়ে ঘর পরিষ্কার করে দেয়। তবে বাবা কিন্তু কোনদিন তাকে কোন কথা বলত না। বরং উল্টে টলতে টলতে তার সামনে এসে বলত,“পড়ছিস বাবা। পড়।” সংসারে টাকাপয়সাও দিত না। ঝি খেটে মা যা রোজগার করত তাতেই তার পড়াশোনা আর খাওয়াদাওয়ার খরচ চলত। সেদিন কেন যেন বাবা অন্যদিনের মত মাতাল-বাবা ছিল না। সন্ধেতে মা রান্না করছে। হঠাৎ বাবা, “তুই শালী লোকের কাছে বলে বেড়িয়েছিস, আমি মাতাল? আমি মাতাল তার প্রমাণ দিতে পারবি? না দিতে পারলে এই হাতে কি আছে দেখতে পাচ্ছিস? এটা দিয়ে মেরে তোকে শেষ করে দেব।” বলে একটা গরু বাঁধার খোঁটা নিয়ে মায়ের পিঠে বাড়ি মারতে শুরু করে। আর মা যন্ত্রণায় তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। মায়ের এই অবস্থা দেখে কোন সন্তান চুপ করে থাকতে পারে? পড়া ছেড়ে দৌড়ে এসে বাবুল টলমলে মাতাল বাবার হাত থেকে খোঁটাটা কেড়ে নিয়ে যে হাত দিয়ে তার মাকে মারছিল সেই হাতে সপাটে দুটো বাড়ি মারতে বাবা একদম কাবু! গায়ে তো এতটুকুও শক্তি নেই। কাবু তো হবেই। যন্ত্রণায় কাৎরাতে কাৎরাতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে বাবা। বাবুল অবাক হয়ে গেল, এত মার খাওয়ার পরও মা মাটির কলসি থেকে জল নিয়ে বাবার হাতের উপর একটা সূতির কাপড় চেপে তার উপর জল ঢালতে ঢালতে তাকে তীব্রভাবে বকাবকি করতে লাগল, “লজ্জা করে না। এই তুই লেখাপড়া শিখছিস। বইয়ে লেখা আছে বুঝি, গুরুজনদের এইভাবে পেটাতে হয়! তাই যদি থাকে তো অমন লেখাপড়া তোর করতে হবে না। ছিঁড়ে ফেল বইয়ের ওই পাতাগুলো। আমি তোর পড়ার খরচ দিতে পারব না। বেরিয়ে যা তুই আমার বাড়ি থেকে। অমন বেয়াদপ ছেলের মুখ আমি আর দেখতে চাই না। এক্ষুণি তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি।”
বাড়ি থেকে তার পালিয়ে আসার কারণ শুনে মলিকের হৃদয়টা তখন কেমন যেন বিগলিত হয়ে পড়েছিল তার প্রতি। নিজের সন্তানের মত বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “জানিস ছেলে, মোটামুটি ঠিক তোর বয়সী আমার একমাত্র সন্তান পল্লব আজ দু’বছর হল ভেদবমিতে চিকিৎসার অভাবে আমাদের কোলছাড়া হয়ে উপরে চলে গেল। এই অজ পাড়াগাঁয়ে কোথায় এইসব চিকিৎসার ব্যবস্থা ? সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইনের দরকার ছিল। সারারাত পায়খানা-বমি। নুন-চিনির জলে বাগ মানছে না। হাতুড়ে বলল, ঝাড়গ্রাম হাপাতালে নিয়ে যেতে। অত রাতে গাড়িঘোড়া কোথায় পাবো! সন্ধে নামলেই তো এলাকা সুনসান। এখান থেকে ঝাড়গ্রাম তো দু-এক কিলোমিটার নয়। কুড়ির মত। নিরম্নপায়ে ধানঝাড়া আগড়ে খড় পলিথিন আর বিছানা বিছিয়ে আমরা জনা চারেক মাথায় করে ছুটলাম। অতটা রাস্তা উজিয়ে যখন হাসপাতালে গেলাম তখন ছেলে আমার নেতিয়ে একদম নিঃসাড়! ডাক্তার জবাব দিয়ে দিল। এখন মনে হচ্ছে উপরওয়ালা আমার সেদিনের আর্তনাদ শুনেছিল। তাই আমার পল্লবের পরিপুরক করে তোকে পাঠিয়েছে।
সেই দিন থেকে বাবু তাকে ছেলের মত ভালবাসে। একটা একটা দিন গড়ানের সাথে সাথে নিজের হাতে ধরে তাকে কারবারের যাবতীয় অলিঘুঁজি শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। সময় সময় আবেগতাড়িত হয়ে বলেছে, “আমার যাবতীয় বিদ্যাবুদ্ধি তোকে উজাড় করে দিলাম। তুই যদি তা গ্রহণ করতে পারিস তো আজীবন টেকসই রাখতে পারবি নিজেকে। আমাদের আর কে বা আছে। এখন তুই তো আমাদের সর্বস্ব। আমাদের অস্থাবর স্থাবর যা কিছু আছে সবই তোর জিন্মায় চলে যাওয়াটা যে কেবল উপযুক্ত সন্ধিক্ষণের অপেক্ষায়।” ইনিই তার জীবনের আসল শিক্ষাগুরু। তাই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, কোনদিন কোন অনুকুল-প্রতিকুল পরিস্থিতিতে সে তার এই শিক্ষাগুরুকে ভুলে যাবে না। প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে সে রক্ষা করবে। নাহলে এত বছর এখানে থেকে তার ধর্ম-বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষা সে পেল তা তো বৃথা হয়ে যাবে। অনেকদিন থেকেই বাবুল মনে মনে পান্নালাল কাকুকে ধর্ম-পিতা হিসেবে মেনে নিয়েছে। অপেক্ষা করছে সেইদিনের জন্যে যেদিন সে মুখ ফুটে ওনাকে ‘বাবা’ বলে ডাকতে পারবে। কাকিমাকে ‘মা।’
এই বাবা-মায়ের কথা যখন ভেতর থেকে উগরে বেরিয়ে এল তখনই তার চোখের সামনে ভেসে এল আজন্ম কৈশোরের জীবনকথা এবং তার জন্মদাত্রী মায়ের কথা সঙ্গে বাবাও ! মনে নাড়া দিতেই অবসাদের একটা দমকা প্রবাহ যেন তার সত্ত্বাকে গলিয়ে দিতে লাগল ! ভেতর থেকে একটা তীব্র বেগ যেন তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল। কেমন আছে, কোথায় আছে তার মা? তার বাবা? যে মানুষটা সর্বার্থে মাতাল হলেও তার উদ্দেশ্যে একবারও কটু শব্দ উচ্চারণ করেনি!
একটা বলিষ্ট চেহারার সুদর্শন যুবক তাদের বাড়ির সামনে এসে ঘোরাঘুরি করছে। বেড়া ঘরের জানালা দিয়ে সেটা দেখতে পাচ্ছে বৃদ্ধা সরলাবালা! তারপর আবার পাড়ার ওইদিকে চলে গেল। আবার ফিরে এসে তাদের বাড়ি টপকে অন্যদিকে। এই চলে যাবার সময় তার বুকটা কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মত চড়াৎ করে উঠল। কে এই চাঁচাছোলা সুন্দর ছেলেটা ? এ কি তার কেউ হবে। ভেতরটা তোলপাড় করতে শুরম্ন করেছে ! এ তার সেই ছোট্ট খোকা নয়তো ? এবার সরাসরি তার ঘরের আগড়ের দরজার সামনে এসে ক্যাঁচ করে শব্দ করে ঠেলে ফাঁক করে মুখ বাড়াতে বৃদ্ধা বলল, “কে বাবা তুমি? কাদের বাড়ি খুঁজছো তুমি? মনে হচ্ছে তুমি অন্য কারোর নয় আমাদের বাড়ি খুঁজছো। বুড়ো হয়েছি। চোখে তেমন দেখি না। তাই।” এবার একটা যুবক হাত তার পা দুটো স্পর্শ করতেই যেন রক্ত-আগুনে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চলকে উঠলো! “কে রে বাবা! তুই আমার বাবুল! তুই আমার সেই ছোট্ট খোকা, বাবুল!” বলে তার ওই বিশাল শরীরটাকে জড়িয়ে ধরতে না পেরে পরনের জামা মুঠো মেরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল! সঙ্গে সঙ্গে পাশে পুরোনো কাঁসার ঘটিতে রাখা জল নিয়ে মায়ের কোলে শুইয়ে চোখে মুখে ঝাপটা দিতে থাকে। চোখ-মুখে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, “মা, আমি বাবুল নই আমি তোমার সেই ছোট্ট বাবু গো মা। যে নামে তুমি আমায় ডাকতে। আমি সেই বাবু। তোমার কিচ্ছু হয়নি মা। এই দেখো না তুমি এক্ষুণি ঠিক হয়ে যাবে। ভাল হয়ে যাবে। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি মা। আর তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না মা।” সন্তানের সেবায় মা আত্মস্থ হয়ে সুস্থ হলে বাবুল জিজ্ঞেস করে,“মা, বাবা ?” কাঁদতে কাঁদতে বলল, “মা কি বলল না বলল আর তুই রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলি বাবা। একবারও ভাবলি না যে মা-বাবা কোনদিন সন্তানকে মন থেকে দুচ্ছাইভাবে বকাবকি করে না। সন্তানদের বাবা-মা বকে। সে অধিকার তাদের আছে। ওরাই তো সন্তানদের প্রথম গুরু। তুই চলে যাবার পর তোর বাবা যেন পাগলের মত হয়ে গেল। মদ খাবার বহর আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে দিল। সব সময় আমাকে গালাগাল দিয়ে বলতে থাকল, “আমার ছেলে আমায় মেরেছে তা তোর বাবার কি শালী। আমি মদ খেয়েছি, অন্যায় করেছি। আমার বাবা আমাকে শাস্তি দিয়েছে। তাতে তোর চোদ্দপুরুষের কি আসে যায়। ওটা আমার বাপ বেটার ব্যাপার। তুই আমার বাবাকে ঘর থেকে দূর করে দিলি কেন আগে বল।” তার আগে তুই তো দেখেছিস কত উল্টোপাল্টা বলে আমাকে বকা দিত। আর তুই চলে যাবার পর রোজ রাত্রে এসে ওই একইা কথা বলে চিৎকার করে। সেদিন রাতে বাড়ি ঢুকে অনর্গল বমি করতে থাকে আর তোকে টেনে আমাকে গালাগাল দিয়ে চলে। বমিও থামে না, গালাগালও না। একটা সময় দুটো কাজই একসঙ্গে থমকে গেল। আর বোজা চোখ তার খোলা হল না। এমনিতেই হয়তো ওনার আয়ু বেশিদিন ছিল না। চোলাই ভেতরের কলকব্জা সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। তার উপর তোর চলে যাওয়াটা উনি কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারলেন না।”
ওদের মা-ছেলের দুঃখ-জ্বালার এই বিনিময় কখন যেন ইথার তাদের ঘরের ছিটেবেড়ার ফাঁক দিয়ে চর থেকে চরাচরে ভাসিয়ে দিয়েছে। পাড়াগাঁয়ের মানুষজন একে একে জড়ো হতে থাকে তাদের ঘর উপচে বাইরে পর্যন্ত। কত ভালমন্দ গুনগুন গুঞ্জন মতামত আলোচনা বার্তা চালাচালি হল কতক্ষণ ধরে যেন। বাবুল তাদের যতটা সম্ভব তার অবস্থানের কথা জানিয়েছে। একটা সময় পর সেই ভিড় পাতলা হতে হতে খালি হয়ে যায়। বাবুল ঘর থেকে দেখে কেউ কোত্থাও নেই। এবার কিছুটা স্বস্তিবোধে হাতপা ছাড়াতে বাড়ির বাইরে আসতে দেখে সামনে মোটা আমগাছের আড়ালে একজন দাঁড়িয়ে! বাবুলের ডাকে আড়াল থেকে নিজেকে প্রকাশ করে পরমাই বলল, “আমাকে চিনতে পারছো বাবুলদা? বলোতো আমি কে? বলেই বাবুলের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলল, আমি পরমা! স্কুল থেকে ফেরার পথে তুমি আমাকে কত বিরক্ত করতে মনে আছে? আমি কপট রাগে তোমার সঙ্গে মাঝে মাঝেই কথা বন্ধ করে দিতাম। তুমি তখন আমার পথ আটকে ভূল মেনে নিতে। আমি বলতাম,“হয়েছে হয়েছে। দুষ্টু বেটাছেলে আবার ভুল স্বীকার করে। কত যেন বাধ্য শিশু।”
সেদিনের সেই ছোট্ট পরমা আজ এত বড় হয়েছে ! ও এত সুন্দরী ! যেন চন্দ্রপ্রভা তার মধ্যে থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ! মনে হচ্ছে একটা পরী ডানা কেটে স্বর্গ থেকে নেমে এসে তার সঙ্গে কথা বলছে। মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল বাবুলের। মনে মনে ভাবল, পাড়াগাঁয়ের কত মানুষ এসেছিল। সবাই চলে গেল। পরমা কেন গেল না। তার সঙ্গে কথা বলবে বলে গাছের অবগুন্ঠনে আশ্রয় নিয়েছিল ! সে কি গড়িয়ে আসা এতটা বছর তার জন্যে অপেক্ষা করছিল ? নিশ্চিত ছিল একদিন না একদিন দুষ্টু বাবুলদা ফিরে আসবে ! পরমা তাকে ভালবাসে? প্রকৃতি যদি অখিলে লীন হতে চায় তো সে তার ওমের আধারে সযত্নে লালন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।